ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের শুদ্ধি অভিযান

প্রকাশিত: ০৯:০৪, ২০ অক্টোবর ২০১৯

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের শুদ্ধি অভিযান

গত ৬ অক্টোবর ২০১৯ সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ক্যাসিনো সম্রাট ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও তার সহযোগী আর এক ক্যাসিনো নায়ক এনামুল হক আরমানকে র‌্যাব গ্রেফতার করেছে। সরকারের চলমান দুর্নীতিবিরোধী কঠোর অভিযানে যারা গ্রেফতার হয়েছেন, তাদের মধ্যে সম্রাট সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজনীতিক। এই গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে জনগণ আশ্বস্ত হয়েছে যে, সরকারের চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে কেউ রক্ষা পাবে না, সে যতই প্রভাবশালী হোক না কেন। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা গত ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশের সব টেলিভিশনের সম্প্রচার উদ্বোধনকালে বলেছেন, জঙ্গী, সন্ত্রাস, মাদক ও দুর্নীতিবিরোধী চলমান অভিযান অব্যাহত থাকবে। অপরাধী যেই হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। দল, আত্মীয়, পরিবার কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। এর আগে গত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ রাতে নিউইয়র্কে এক সাংবাদিক সম্মেলনে চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সামগ্রিক স্বার্থেই এ ধরনের আঘাতের প্রয়োজন ছিল। এমন পরিস্থিতিতে একটা সমাজ এগোতে পারে না। তাই ধরেছি যখন ভালভাবেইে ধরেছি। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। কিছু মানুষ অখুশি হতে পারে, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। সরকারের এই কঠোর মনোভাব এবং দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে জিরো টলারেন্সের কারণে দেশবাসীর মনে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নতুন আশা ও উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেফতারের পর চাাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিসহ নানা অভিযোগে আলোচনায় আসে সম্রাটের নাম। এরই মধ্যে টানা অভিযানে আলোচিত ঠিকাদার জি কে শামীম, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি লোকমান ভূঁইয়া, অনলাইন ক্যাসিনো হোতা সেলিম প্রধানসহ যুবলীগ, কৃষক লীগ ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী গ্রেফতার হলেও সম্রাট ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। শেষ পর্যন্ত ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের ১৯ দিনের মাথায় গ্রেফতার হলেন সম্রাট। সাম্প্রতিক গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হয়েছে রাজনীতির নামে কত কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হচ্ছে। গত ২০ সেপ্টেম্বর ৭ দেহরক্ষীসহ যুবলীগ নেতা পরিচয় দানকারী জি কে শামীম গ্রেফতার হওয়ার পর পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, কাজ পাবার জন্য শুধু দুজন সাবেক প্রকৌশলীকেই ঘুষ দিয়েছেন ১৫০০ কোটি টাকা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এমন সাহসী অভিযান ছিল সময়ের দাবি এবং জনগণের কাক্সিক্ষত স্বপ্ন। চলমান এই দুর্নীতি অভিযান সম্পর্কে কেউ যেন প্রশ্ন তুলতে না পারে, এজন্য অভিযানের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে সরকার নিজের দল থেকেই এই অভিযান শুরু করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, আমি এই কাজটি আমার নিজের ঘর থেকেই শুরু করেছি। চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে গত ১১ অক্টোবর সিলেটের শ্রীমঙ্গল থেকে গ্রেফতার হয়েছেন মোহাম্মদপুরের হাইব্রিড অওয়ামী লীগ নেতা ওয়ার্ড কমিশনার পাগলা মিজান। ইতোমধ্যে বহিষ্কার করা হয়েছে কেন্দ্রীয় যুবলীগের দফতর সম্পাদক কাজী আনিসকে। গত ১৩ অক্টোবর চট্টগ্রামে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে ২৮নং ওয়ার্ড যুব লীগের সিনিয়র সহ-সভাপিত একাধিক হত্যা মামলার আসামি খুরশীদ আহমদ। শুধু রাজনৈতিক শুদ্ধি অভিযান নয়, দুর্নীতি বন্ধ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এই অভিযান প্রশাসনসহ ছড়িয়ে দিতে হবে সরকারের সব সেক্টরে। গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়েছিল। মাঠপর্যায়ে জনপ্রিয়তা, সততা ও সাংগঠনিক দক্ষতাকে গুরুত্ব দিয়ে পুরনো ও নতুনদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী মন্ত্রিপরিষদ গঠনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন বলে মানুষ মনে করে। সততা ও দক্ষ নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে শত বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে আজকে প্রধানমন্ত্রী দেশকে যেখানে নিয়ে এসেছেন, তা আওয়ামী নেতাকর্মীরাও কখনও চিন্তা করতে পারেননি। সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে ৫ জানুয়ারি ২০১৪ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার মাধ্যমে বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত করার ক্ষেত্রে জননেত্রী শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপ কেবলমাত্র তাঁরই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার প্রতিফলন। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনগুলোর ভূমিকা তেমন জোরালো নয়। অথচ সরকারের সফলতা ও অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাওয়ার উন্নয়ন গতি নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ, যুব লীগ ও ছাত্র লীগের কিছু দুর্নীতিবাজ নেতার দ্বারা। শেখ হাসিনার ভাষায় এরা হলেনÑ উন্নয়নের উইপোকা। এই উইপোকাদের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার কর্তৃক পরিচালিত চলমান দুর্নীতি অভিযানে নেতৃত্ব দেয়ায় জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন, এটা নিশ্চিত। নিজ দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে এমন দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনার নজির বাংলাদেশে নেই। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার হাওয়া ভবনের মাধ্যমে দুর্নীতিকে যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল, তখন দেখা গেছে দুর্নীতিবাজদের গ্রেফতার না করে সরকার পুরস্কৃত করেছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবার দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন না এবং সততার সঙ্গে রাজনীতি করেন বলেই তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে এমন কঠোর অবস্থান নেয়ার সাহস দেখাতে পেরেছেন। আওয়ামী লীগ, যুব লীগ ও ছাত্র লীগের দুর্নীতিবাজ নেতাদের চিহ্নিত করে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শুদ্ধি অভিযানের ম্যাসেজটি মূলত উঠে আসে গত ১৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে। ওই বৈঠকে ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ‘মনস্টার’ আখ্যা দিয়ে পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ প্রদান করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। সভায় কিছু যুবলীগ নেতার কর্মকা-ের ব্যাপারেও তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর ১৯ সেপ্টেম্বর ছাত্র লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গণভবনে জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বলেন, ‘ছাত্র লীগের পর যুব লীগকে ধরেছি।’ আমরা অপেক্ষায় আছি, শীঘ্রই শুদ্ধি অভিযান শুরু হবে আওয়ামী লীগে ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলে। শুধু রাজনৈতিক দল নয়, সরকারের প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রতিটি সেক্টরে ছড়িয়ে দিতে হবে এই শুদ্ধি অভিযান, ধরতে হবে সকল দুর্নীতিবাজদের। আওয়ামী লীগে শুদ্ধি অভিযান এ কারণে জরুরী যে, অনেক দুর্নীতিবাজ আওয়ামী লীগ নেতা ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী অনেককে ঠাঁই দিয়েছে। খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও ঠিকাদার মোগল জি কে শামীম গ্রেফতার হওয়ার পর তথ্য বেরিয়ে আসে যে, এরা ফ্রিডম পার্টি ও বিএনপি ভাবাদর্শের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। আরও জানা যায় যে, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া শেখ হাসিনার ওপর হামলা মামলার আসামিও ছিল। ওয়ার্ড কমিশনার পাগলা মিজানও ফ্রিডম পার্টি করত এবং তিনিও শেখ হাসিনার ওপর হামলা মামলার একজন আসামি ছিল। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি লোকমান ভূঁইয়া, যিনি খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর নিরাপত্তা রক্ষী ছিলেন, তিনি কিভাবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করেন? সরকারের বিভিন্ন জায়গায় এ রকম অনেক নব্য আওয়ামী লীগার ঢুকে পড়েছে, যারা সরকারের সুনামকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ করছে। সম্প্রতি গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদত্যাগকারী উপাচার্য খোন্দকার নাসিরুদ্দিন তার অন্যতম উদাহরণ। অতীতে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এই শিক্ষক উপাচার্য হিসেবে পরপর দুবার নিয়োগ পেয়ে যেসব দুর্নীতি ও অপকর্ম করেছেন, তা শুধু সরকারের সুনামকে ক্ষুণœ করেননি, তিনি গোটা শিক্ষক সমাজকে খাটো করেছেন। সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও গ্রহণে এবং বিভিন্ন পদে সরকার যাদেরকেই পাশে নিক না কেন, দেখতে হবে তাঁদের সততা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি কমিটমেন্ট। শেখ হাসিনার দুঃসময় ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে অনেককেই যাদের খুঁজে পাওয়া যায় না সুসময়ে, তারা এতটাই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেন যে তাদের চেয়ে বড় আওয়ামী লীগার আর কেউ নয়। এ ধরনের মানুষদের এড়িয়ে চলতে হবে, এ মানুষেরা সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসে সরকারের ইমেজকে ক্ষুণœ করেছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুকে সত্যিকার অর্থেই যারা ভালবাসেন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হৃদয়ে লালন করেন, তাঁরা যেখানে যেভাবেই থাকুন না কেন পরিশ্রম ও মেধা দিয়ে সততার সঙ্গে দেশ গড়ার কাজে নিজেদের আত্মনিয়োগ করবে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। এসব ব্যক্তিকে সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে। বর্তমান সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক। শুধু তাই নয়, এ সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতার ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ। গত দশ বছর জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার বিদ্যুত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, যোগাযোগ, কৃষি ও অর্থনৈতিক খাতে যে সাফল্য বয়ে এনেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সাফল্য বয়ে আনতে হবে এ সরকারকে। মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা এ সরকারের নিকট যেটি, সেটি হলো দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। তৃতীয়বারের মতো সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেয়ার পর মন্ত্রিপরিষদ গঠনের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর যে দৃষ্টিভঙ্গি ও মিডিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁর যে সাম্প্রতিক অভিমত, তাতে এটি স্পষ্ট যে জনগণের আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশা অনুযায়ী বর্তমান সরকার কাজ করবে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবে। তারই নমুনা হিসেবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নিজের ঘরের ভেতর থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। এটি শেখ হাসিনার সরকারের একটি সময়োচিত সিদ্ধান্ত। চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের মধ্য দিয়ে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারলে এই ঘটনা দেশের রাজনীতিতে স্বচ্ছতা আনয়নে ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে। প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই জানেন সামনের দিনগুলোতে সরকারের ইমেজ ও আওয়ামী লীগের ক্লিন ইমেজের সাংগঠনিক দক্ষতাই দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা আনয়ন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সরকারকে দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকারের প্রত্যেকটি বিভাগকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তথ্য কমিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এই তথ্য কমিশনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। সরকারের বিভিন্ন দফতর ও প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিষয়ে যেন সহজে বিভিন্ন ‘স্টেক হোল্ডার’ বা জনগণ তথ্য পেতে পারে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দুর্নীতি রোধে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আরও একটি প্রতিষ্ঠান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে তা হলোÑ ন্যায়পাল। পবিত্র ‘সংবিধানে ৭৭ অনুচ্ছেদে ন্যায়পাল সম্পর্কিত বিধান রয়েছে এবং বিশেষ করে মন্ত্রণালয়, সরকারী কর্মচারী ও সংবিধিবদ্ধ সরকারী কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি রোধে ন্যায়পাল বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। সংবিধানের ৭৭(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালের পদ-প্রতিষ্ঠার জন্য বিধান করিতে পারিবেন। ৭৭(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালকে কোন মন্ত্রণালয়, সরকারী কর্মচারী বা সংবিধিবদ্ধ সরকারী কর্তৃপক্ষের যে কোন কার্য সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতাসহ যেরূপ ক্ষমতা কিংবা যেরূপ দায়িত্ব প্রদান করিবেন, ন্যায়পাল সেইরূপ ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করিবেন। ৭৭(৩) অনুযায়ী ন্যায়পাল তাঁহার দায়িত্ব পালন সম্পর্কে বাৎসরিক রিপোর্ট প্রণয়ন করিবেন এবং অনুরূপ রিপোার্ট সংসদে উপস্থাপিত হইবে।’ বাংলাদেশে ১৯৮০ সালে একটি ন্যায়পাল আইন পাস করা হলেও সেই আইন এখনও কার্যকর হয়নি। বিশ্বের অনেক দেশেই ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠানটি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে ন্যায়পাল নিয়োগ করা হলে এ প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতি রোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারকে কার্যকর ভূমিকা পালনে সহায়তা করতে পারে। এর পাশাপাশি সরকারের কোন কোন দফতরে কি ধরনের দুর্নীতি সংঘটিত হচ্ছে, তা চিহ্নিত করতে হবে। শুধু তাই নয়, সুশাসনের চর্চা করতে হবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রীদের বুঝতে হবে তাঁরা কেবল জনগণের প্রতিনিধি। আরও একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, দুর্নীতি বন্ধ করতে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের জাতীয় সংসদকে সকল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা। বিগত এক দশক ধরে দেখা যাচ্ছে যে, সংসদ যেন নিষ্প্রাণ। বিশেষ করে বিরোধী দলের সাংসদদের অনুপস্থিতি পীড়াদায়ক। আমরা আশা করব, বর্তমান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি সরকারের মধ্যে থাকলেও তারা জাতীয় সংসদে উপস্থিত থেকে সরকারের বিভিন্ন কর্মকা-ের গঠনমূলক সমালোচনা করবে। একটি সংসদ অধিবেশনে জনগণের ঘামে ঝরা লাখ লাখ টাকা ব্যয় হয়। সেই অধিবেশন যেন জনগণের যথার্থ কল্যাণে আসে। সরকারে যারা আছেন, তাদেরও সংসদকে কার্যকর করতে এগিয়ে আসতে হবে ও সংসদের ভেতর গণতান্ত্রিক চর্চার অংশ হিসেবে বিভিন্ন বিতর্ককে উৎসাহিত করতে হবে। কোন আলোচনার মাধ্যমে ভুল ধরা পড়লে জাতির মঙ্গল, দেশের মঙ্গল ও সরকারের জন্যও মঙ্গল। প্রয়োজনবোধে সংসদকে আরও গতিশীল করতে সংসদে সাংসদদের উপস্থিতির বিষয়টি তদারকে দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। বর্তমান সরকার পুরোপুরি সফল হোক, এটি বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের কামনা। শুধু আওয়ামী লীগের কর্মী, সমর্থক ও শুভাকাক্সক্ষীই নয়, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী তারা সকলেই মনেপ্রাণে চায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছুক। আওয়ামী লীগ সরকারের সফলতা মানে বাংলাদেশের সফলতা, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রামে সফলতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখার সফলতা। এজন্য বর্তমানে রাজনৈতিক শুদ্ধি অভিযান হিসেবে বিবেচিত সরকারের চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে জনগণ প্রবল উৎসাহে সমর্থন করছে। এই শুদ্ধি অভিযানের মধ্যেই গত ৬ অক্টোবর গভীর রাতে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ ছাত্র লীগের নেতাকর্মীদের হাতে নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন। আবরার হত্যার পর সারাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা এবং ছাত্র লীগ থেকে বহিষ্কৃত করা হলেও ছাত্রলীগের শুদ্ধি অভিযানের বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে। সরকারের চলমান রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শুদ্ধি অভিযান বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ের গভীর আকাক্সক্ষার প্রতিফলন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের এই আকাক্সক্ষাকে দৃঢ়ভাবে অনুধাবন করেছেন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আগামী দিনে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে সরকার পরিচালনা করলে অতীতের ন্যায় আগামীতেও তিনি বাংলাদেশকে সঙ্কটের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞাই আজ তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বের প্রখ্যাত নারী শাসকদের মধ্যে দীর্ঘ শাসনকালের রেকর্ডটিতে। তিনি ইন্দিরা গান্ধী, মার্গারেট থ্যাচার, চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা ও এঞ্জেলা মার্কেলের মতো প্রসিদ্ধ নারী শাসকদের দীর্ঘমেয়াদী শাসনকালকে অতিক্রম করেছেন ইতোমধ্যে। তিনি আজ বিশ্বের অনেক রাজনীতিবিদের প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়েছেন। গত ৬ অক্টোবর ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াঙ্কা গান্ধী তাঁর টুইটার এ্যাকাউন্টে শেখ হাসিনার সঙ্গে একটি আলিঙ্গনরত ছবি প্রকাশ করে ইংরেজীতে একটি বার্তা টুইট করেন, যার বাংলা অনুবাদটি এ রকম-‘শেখ হাসিনা জি’র কাছ থেকে আমি একটি ‘বহু আগেই প্রাপ্য’ আলিঙ্গন পেলাম, যার জন্য আমি অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম। গভীর ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি এবং দুর্ভোগ পার হওয়া এবং তিনি যা বিশ্বাস করেন তা অর্জনের জন্য সাহস ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে লড়াইয়ে তার শক্তি আমার জন্য এক বিরাট অনুপ্রেরণা হয়ে আছে এবং থাকবে।’ এভাবেই আমাদের প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা আজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে আপন আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছেন। এ তো বাঙালী জাতির জন্য এক বিরাট পাওযা। রবীন্দ্রনাথের গানে বলতে হয়, তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে, সে আগুন ছড়িয়ে গেল, সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে, সবখানে, সবখানে। লেখক : প্রফেসর, আইন বিভাগ ও পরিচালক, শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
×