ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুটি গল্প ॥ পোকার সঙ্গে বসবাস

প্রকাশিত: ১৩:০৪, ১৮ অক্টোবর ২০১৯

দুটি গল্প ॥ পোকার সঙ্গে বসবাস

বিশাল একটি কমলালেবু। তার মধ্যেই সামান্য একটু ‘ব’ আকৃতির জায়গা। অতীতে এই জায়গায় অনেক দূর-দূরান্তের জীবজন্তুর বসবাস ছিল। ওরাই জায়গাটুকুর দেখাশোনা করত। ওদের অত্যাচারে জায়গাটি সারাক্ষণ ছিল অশান্ত! কিন্তু বর্তমানে ওরা নেই। তবুও এই ছোট ‘ব’ আকৃতির জায়গাটিতে তেমন শান্তিময় পরিস্থিতি আর দেখা যায় না। স্থানীয় কিছু পোকা-মাকড়ের জন্যই এই অবস্থা। ঠিক এই ‘ব’ আকৃতির জায়গাটিতেই তপন বাস করে। সর্বক্ষণ অশান্তিতে কাটাতে হয় তপনকে। ব্যাঙের ঘ্যাঁ ঘোঁ শব্দ, সাপের হিংস্র নিশ্বাস, টিকটিকির টুকটুক শব্দ, কোকিলের কুহু কুহু বিরক্তিকর সুর, সব সময় তপনকে অত্যাচার করে থাকে। এসব পোকা-মাকড়ের সঙ্গেই তপন বাস করে। ব্যাঙের সর্দারের চেহারা তপনের কাছে আজগুবি মনে হয়! বৃহৎ এক আজগুবি চেহারা ব্যাঙটির। দেখলেই গা, পা সব শিউরে ওঠে। প্রায় সময় বড় ব্যাঙটি আরও অনেক ছোট ছোট ব্যাঙ সঙ্গে নিয়ে ঘ্যাঁ ঘোঁ শুরু করে দেয়। মনে হয় কোন এক দাবি পূরণের জন্য ব্যাঙগুলো একত্রিত হয়ে ঘ্যাঁ ঘোঁ শুরু করেছে। ব্যাঙগুলো অনেক সময় অনেক কিছুই করতে চায়, কিন্তু পারে না। ওই যে, সাপ আছে না! ওর ভয়ে। সাপটি কখন কি করে বসে বলা মুশকিল। একাই রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে সাপটি। ইচ্ছে করলেই ছোটখাটো দু-চারটি ব্যাঙ খেয়ে ফেলতে পারে হরহামেশায়! ব্যাঙগুলো নিরুপায়। কিন্তু না, শুধু সাপই যে ‘ব’ আকৃতির জায়গাটুকুর রাজত্ব করে যাচ্ছে তা নয়। এক সময় মোটা বড় ব্যাঙটিও ‘ব’ আকৃতির জায়গাটুকুর রাজত্ব করেছিল। তখন হয় তো সাপটি ছোট ছিল। অথবা সাপটির শক্তি সামর্থ্য বর্তমানের মতো ছিল না। তখন হয় তো ব্যাঙটিও ইচ্ছে করলেই ছোট-মোট দু-একটি সাপও খেয়ে ফেলত। এসব যে ঘটত না তাও তো বলা মুশকিল। কারণ যে সাপ এখন রাজত্ব করছে, সেও হয় তো অত্যাচারিত হয়েছিল ব্যাঙদের কর্তৃক। তার ফলস্বরূপ এখন প্রতিশোধ নেবার পালা। তাই হয় তো সাপটি হিং¯্র রূপ ধারণ করে আধিপত্য বিস্তার করছে। ব্যাঙদের দাবিমূলক ঘ্যাঁ ঘোঁ শব্দ সাপটির কাছে অনেক বিরক্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। আর তপনের কাছে? এ কোন নতুন ব্যাপার নয়। ওই যে টিকটিকিটি, সর্বক্ষণ ডানে-বামে শুধু টুকটুক করে! ওর যে কিসের দাবি, তাও বলা মুশকিল। ও ছোট পোকা, আধিপত্য বিস্তার করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই হয় তো টুকটুক করে বোঝাতে চায়, ‘আমরা সবাই পোকা-মাকড়, আমাদের মধ্যে বৈষম্য থাকা উচিত নয়।’ হয় তো ওর দাবিতে শান্তি সম্ভব, কিন্তু তা একান্তই ওর মতামত। তবে ও যে একেবারেই ভাল পোকা তা কিন্তু বলা যায় না। কেননা এ পর্যন্ত যে কত সাধারণ পোকার মৃত্যু ঘটিয়েছে ও, তার তো হিসেব নেই। ওর যতটুকু ক্ষমতা, ও তাই প্রয়োগ করে ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাহীনদের প্রতি। কোন কোন সময় তো অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য লাফালাফিও করে। কিন্তু পেরে ওঠে না। ওই যে হিং¯্র সাপ, ব্যাঙ আছে না, ওদের সামনে কি এতটুকু টিকটিকির হিসাব থাকে! শুধু কি তাই! যে কোকিল, সর্বক্ষণ সুরেলা কণ্ঠে গান করে, তার কাছেও টিকটিকিটি প্রিয় নয়। তপন সব চেয়ে বিরক্ত বোধ করে কোকিলটির বিরক্তিৎকর কুহু কুহু ডাক শুনে। মাঝেমধ্যে যে একটু-আধটু ভাল লাগে না, তা নয়। মন ভরে যায় কোকিলের গান শুনে। কিন্তু যখনই কোকিলের অতীত পরিচয় মনে হয়, ঠিক তখনই বিরক্তি যেন তপনকে কেন্দ্র করে বাসা বাধে। একবার তপনের এক বৃদ্ধ স্বজন তপনকে কোকিলের অতীতের পরিচয় সম্পর্কে কিছু তথ্য উপস্থাপন করে জানিয়েছিলো নিজের অভিমত। স্বজনের মতে, কোকিল অতীতে ছিল কাকের মতো ঘৃণ্য, নিকৃষ্ট চরিত্রের প্রাণী। তাই তপনের কাছে কোকিলের চাটুকারি মনোমুগ্ধকর সুর মোটেই ভাল লাগে না। কোকিলকে দেখলেই কেন জানি তপনের বুক ফেটে কান্না আসে। নাহ্্! তপন আর থাকবে না এখানে। দরকার নেই তার এই ‘ব’ আকৃতির জায়গার। অন্য কোথাও যাবে সে। যেখানে নেই সাপের হিং¯্র নিশ্বাস, নেই ব্যাঙের হিংস্র ভরা কণ্ঠে ঘ্যাঁ ঘোঁ শব্দ, নেই টিকটিকির টুকটুক শব্দ, নেই বিরক্তিকর কোকিলের চাটুকারি গান, নেই অন্যান্য পোকাদের ক্ষমতার জাল। তপন চলছে ধীরগতিতে। বার বার পিছু ফিরে তাকায় ‘ব’ আকৃতির জায়গাটুকুর দিকে। কি জানি, যদি সবগুলো পোকা একত্রিত হয়ে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য শপথ গ্রহণ করে আর তপনকে বলে, তুমি যেও না, থেকে যাও আমাদের সঙ্গে।
×