ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আবু সুফিয়ান

অলিম্পিয়ার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

প্রকাশিত: ১২:৫৭, ১৮ অক্টোবর ২০১৯

অলিম্পিয়ার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

যৌন নির্যাতন বা বিশেষ মুহূর্তের গোপন ভিডিও যখন ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া হয় তখন একজন তরুণীর মনে কি ধরনের বেদনার সৃষ্টি করে তা সেই ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারেন না। আর এই ধরনের ভিডিও যখন শুধু নারীকেই উপস্থাপনা করা হয় এবং পুরুষটি বুদ্ধি খাটিয়ে থেকে যায় ক্যামেরার অন্তরালে তখন সেটা হয় পড়ে যৌন নির্যাতনের চূড়ান্ত আঘাত। আর যখন সেটা নিজের বয়ফ্রেন্ডের দ্বারা হয় থকে তখন সেটা হয়ে পড়ে তরুণীটির কাছে আত্মহত্যার মতো। এই ধরনের এক নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছিলেন মেক্সিকোর ১৮ বছরের অলিম্পিয়া নামের এক তরুণী। অলিম্পিয়া তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দু’জনের সম্মতিতে যৌন মিলনের ভিডিও তৈরি করে। পরে সেটা ইন্টারনেটে ছড়িযে পড়ে। সেই ভিডিওতে শুধু অলিম্পিয়াকে দেখা গেছে। কিন্তু সেই ভিডিওটি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছিল বুঝে উঠতে পারেনি অলিম্পিয়া। কেননা তার বয়ফ্রেন্ড এটা অস্বীকার করে। সে সেই ভিডিওটি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়নি। ওই ঘটনা তার জীবনকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়। এরপর অলিম্পিয়া কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বেশ কয়েক মাস সে নিজেকে গৃহবন্দী রাখে। তারপর এক সময় ঘর থেকে বেরিয়ে এসে এর প্রতিবাদ করেন। সংগঠিত করতে থাকেন ইন্টারনেটে যৌন নির্যাতনকারী মেয়েদের। অবশেষে তিনি সফল হয়েছেন। একদল নারী মিলে ‘ন্যাশনাল ফ্রন্ট ফর সরোরিটি’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য ছিল এই ধরনের সহিংসতা রোধ এবং এর প্রতিকার। বাস্তবায়িত হয় ইন্টারনেটে হয়রানির শাস্তির আইনের বিষয়টি। পরে ‘অলিম্পিয়া আইন’ তা বাস্তবায়ন হয়। ইন্টারনেটে বিশেষ মুহূর্তের ছবি প্রকাশের পর অলিম্পিয়া বলেন, ১৮ বছর বয়সে আমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে সেক্সটেপ তৈরি করি আমি। আমি জানি আমার নগ্ন ভিডিও- যেখানে আমার বয়ফ্রেন্ডকে চেনা যায় না। কীভাবে হোয়াটসএ্যাপে ছড়িয়ে পড়ল, আমার বয়ফ্রেন্ড সম্পূর্ণ বিষয়টি অস্বীকার করে। সে দাবি করে যে ওই ভিডিওটিতে সে ছিল না। স্থানীয় একটি পত্রিকা তাদের প্রথম পাতায় খবর ছাপায় যে আমি আগে সম্ভাবনাময় একটি মেয়ে ছিলাম কিন্তু এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার বদনাম হয়ে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমি প্রতিদিনই যৌন আবেদনে সাড়া দেয়ার অনুরোধ পেতে থাকি। আমি মেক্সিকোর যে অঞ্চল থেকে এসেছি তার সঙ্গে মিলিয়ে তারা আমাকে ‘হুয়াউচিনাঙ্গো’র মোটা আবেদনময়ী মেয়েটি’ বলে ডাকা শুরু করে। যখন কাহিনী আরও ছড়িয়ে পড়ে তখন রাজ্যের নামটাও বাদ যায় না। আমার নাম হয়ে যায় ‘পুয়েবলার আবেদনময়ী মোটা মেয়ে।’ আমার মা ইন্টারনেট ব্যবহার করত না, তাই তিনি পুরো ঘটনাটা জানতেন না। আমি ভেবেছিলাম তার জানতে অনেক সময় লাগবে। আমি বলেছিলাম একটি ভিডিও নিয়ে গুজব ছড়িয়েছে, কিন্তু জানায়নি যে সেটা আমার ভিডিও ছিল। হঠাৎ এক রবিবার আমার পুরো পরিবার যখন আমাদের বাড়িতে উপস্থিত ছিল, তখন আমার ১৪ বছর বয়সী ভাই ঘরে এসে সবার সামনে তার ফোন রেখে বলে, ‘আমার বোনের ভিডিও আসলে আছে।’ আমার মা কাঁদতে শুরু করেন। আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের দিন ছিল সেটি। আমি আমার মায়ের পায়ে আছড়ে পড়ি এবং তার কাছে ও আমার পুরো পরিবারের কাছে ক্ষমা চাই। আমি তাদের বলি যে আমি মরতে চাই। আমি তাদের বলি আমাকে যেন মরতে সাহায্য করে তারা। তখনই আমার মা-যিনি একটি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী থেকে এসেছেন, স্কুল শেষ করেননি এবং লিখতেও পারেন নাÑ আমাকে চমকে দেন। তিনি আমার মাথা তুলে ধরে বলেন, আমরা সবাই যৌন সম্পর্কে জড়াই। তোমার বোন, তোমার খালা, আমি-সবাই। পার্থক্যটা হলো তারা তোমাকে এটা করতে দেখে ফেলেছে। এর মানে এই নয় যে তুমি খারাপ মানুষ বা অপরাধী। আমি বিস্মিত হয়ে যাই। আমার মা বলতে থাকেন, তুমি অন্য যে কারও মতো তোমার যৌনতা উপভোগ করছিলে এবং সেটার প্রমাণ আছে। তুমি যদি কিছু চুরি করতে বা কাউকে খুন করতে বা এমনকি, একটি কুকুরকেও আঘাত দিতে, তাহলে সেটা খারাপ হতো। সে সময়ে প্রথমবার আমি নারীদের একাত্মতাবোধের বিষয়টি বুঝতে পারি। তখনই প্রথম বুঝতে পারি যে আমরা নারীরা এক সঙ্গে খুবই শক্তিশালী। এর পরে পাল্টে যায় অলিম্পিয়ার জীবন। মানুষের কোন ধারণাই নেই এ ধরনের ঘটনার কী প্রতিক্রিয়া ভুক্তভোগীর ওপর পড়তে পারে। এর ফলে তার সব ধরনের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হয়ে যায়। আপনার চলাফেরা, অন্তরঙ্গতার চেতনা, ব্যক্তি জীবন প্রতিটি ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে এ রকম একটি ঘটনা। কিন্তু তখন অলিম্পিয়ার বন্ধু বলে, ‘যেন তুমি বুঝতে পার যে তুমি একাই ভুক্তভোগী না। তারা শুধুমাত্র নিজেদের আনন্দের জন্য সবার সঙ্গেই এমন করে। তোমার বাগ্মিতা আছে এবং তুমি এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’ সেই সময়ের কিছু কথা বলেন অলিম্পিয়া নিজে, আমি সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ হই যখন দেখি ডাউন সিনড্রোমে ভুগতে থাকা এক মেয়ের ছবিতে একজন ব্যবহারকারী মন্তব্য করে যে, মেয়েটি দেখতে যেমনই হোক না কেন তার সঙ্গে যৌনতার সম্পর্ক স্থাপন করা যায়। তখন আমি সিদ্ধান্ত নেই যে ‘এ রকম হতে দেয়া যায় না।’ দ্বিতীয় যে ঘটনা আমার মন পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে সেটি হলো আমার ভিডিওর খবর ছাপা পত্রিকাটি যখন আরেক নারীর বিষয়ে খবর ছাপে যে তিনি ৪০ জোড়া জুতা চুরি করেছেন। ঘটনাক্রমে, একদিন আমি আসার ঘরের জানালা দিয়ে দেখি ওই মহিলা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। কিন্তু রাস্তায় সবাই তাকে বিদ্রƒপ করছিল। এমন কি ফুল বিক্রেতা তাকে দেখে ফুল লুকিয়ে ফেলে। ওই ঘটনা দেখে প্রথমে আমার মনে হয়েছিল, আমি বাইরে গেলে আমার সঙ্গেও সবাই ও রকম করবে। কিন্তু আমার মনে হয় ‘এই মহিলা যদি চুরি করেও রাস্তায় বের হতে পারেন, আমি কেন পারব না?’ সেদিনই আমি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে যাই। অলিম্পিয়া যখন জানতে পারেন আরও অনেক নারীই এমন অপরাধের শিকার, তখন তিনি পদক্ষেপ নেয়ার কথা চিন্তা করেন, দ্বিতীয়বারের মতো পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় অলিম্পিয়াকে। সে এটার প্রতিকারের যেখানে সহায়তায় পাওয়া যাবে সেই ধরনের অফিসে যায়। সেখানে দায়িত্বরত অফিসার শুরুতেই তার ভিডিওটি দেখতে চায়। ভিডিও দেখার পর সে হাসিতে ফেটে পড়ে। তার বক্তব্য ছিল ‘আপনি মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন না, মাদকের প্রভাবেও ছিলেন না, কেউ আপনাকে ধর্ষণও করেনি। ফৌজদারি আইন অনুযায়ী, এখানে কোন অপরাধই হয়নি। ‘আমি ক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে আসি। পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর অলিম্পিয়ার মাথায় আসে ‘কোন অপরাধ হয়নি বলে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন সেই অফিসার?।’ পরে অলিম্পিয়া ইন্টারনেটে যারা এ রকম হয়রানির শিকার হযয়েছেন, এমন নারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু করেন। তাদের তিনি বলেন, এই অপরাধ সম্পর্কে আমাদের ধারণা না থাকলেও এর বিষয়ে কিছু একটা করতেই হবে আমাদের। ধীরে ধীরে এ বিষয়ের ধারণা পরিষ্কার হতে শুরু করে আমাদের। পুয়েবলা রাজ্যের জন্য আইনের একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করি আমরা। অনেকেই আমাকে বোঝাতে চান যে আমার এই ঘটনা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। কিন্তু এর মানে হতো পরাজয় মেনে নেয়া। সবাই এরই মধ্যে জেনে গেছে যে আমি কে এবং আমার শরীর দেখতে কেমন। আমি যা করতে যাচ্ছি তা আমাকে বিচার পাইয়ে দেবে না, কারণ আমার সঙ্গে যা করা হয়েছে তা আর শোধরানোর উপায় নেই। কিন্তু আমি ওই সব মেয়ের কথা ভেবেছি যারা একই ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেÑ যেসব মেয়েরা আত্মহত্যার কথা ভাবছে, যেমন আমি ভেবেছিলাম। সাইবার যৌন সহিংসতা নিরসনের উদ্দেশ্যে তৈরি করা প্রস্তাবটি পুয়েবেলার মেয়েদের সামনে জনসম্মুখে উপস্থাপন করি আমি। আমি যখন মঞ্চে উঠি তখন সবাই কানাকানি করছিল। সময়টা ছিল ২০১৪-এর মার্চ, আমার বয়স তখন ১৯। আমি শুরুতে বলি আমি অলিম্পিয়া। ‘হুয়াউচিনাঙ্গোর মোটা আবেদনময়ী মেয়েটি।’ আমি তাদের আমার ভিডিওর কথা বলি। বলি যে আরও এমন অনেক মেয়ে আছে যারা এ ধরনের অপরাধের ভুক্তভোগী। তাদের আমি স্ক্রিনশট দেখাই যে ওই অনুষ্ঠানের বক্তাদের কয়েকজনও আমার ভিডিওতে ‘লাইক’ দিয়েছে এবং শেয়ারও করেছে। ‘আপনারা অপরাধী, আমি নই’, তাদের বলি আমি। যেই ফেসবুক পেজটি আমার ভিডিও শেয়ার করেছিল, সেটি পরে বন্ধ হয়ে যায়। তারা জানায় ‘এক উন্মাদ মহিলা’র জন্য তারা পেজ বন্ধ করে দিচ্ছে। কিন্তু তখনও বহুদূরের পথ বাকি ছিল। একজন সংসদ সদস্য তখন বলেছিলেন যে তিনি আমার প্রস্তাব সমর্থন করতে পারবেন না কারণ সেটি ‘বেহায়াপনা অনুমোদন’ করার শামিল হবে। প্রস্তাবটি আইনে রূপান্তরিত হয় ২০১৮তে। আইন অনুযায়ী, অনুমতি ছাড়া কারও ব্যক্তিগত কোন বিষয় ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া হলে সেটিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। ইন্টারনেটে সাইবার হয়রানি বা যৌন সহিংসতার বিষয়গুলোও সংজ্ঞায়িত করা হয় আইনে। এই ধরনের অপরাধ সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরির বিষয়গুলোও জায়গা পায়। কয়েক বছরের আলোচনার পর পুয়েবলা রাজ্যে আইনটি পাস হয়। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত মেক্সিকোর ১১টি রাজ্যে এই আইন বাস্তবায়ন করা হয়েছে। অবশেষে জয় হয় অলিম্পিয়ার। নানা ঘাত প্রতিঘাত উপেক্ষা করে, কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে, পরে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন সপাটে। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ইন্টারনেটে যারা যৌন নির্যাতনের সন্মুখীন হয়েছেন তাদের সংগঠিত করেরেছন এবং সৃষ্টি করেছেন এক নতুন ইতিহাস। যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে অলিম্পিয়া এক প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে ।
×