ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফকির লালন শাহর তিরোধান দিবসের অনুষ্ঠানমালা

ছেঁউড়িয়ায় ভাঙল মিলনমেলা

প্রকাশিত: ১২:৩২, ১৮ অক্টোবর ২০১৯

ছেঁউড়িয়ায় ভাঙল মিলনমেলা

এমএ রকিব, কুষ্টিয়া থেকে ॥ ‘অষ্টপ্রহরের সাধুসংঘ’র মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে ভেঙ্গে গেছে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের তিরোধান দিবসের সাধুর হাট। ফলে এদিন বিকেল থেকেই গুরু, শিষ্য, লালনভক্ত, সেবাদাসীদের সঙ্গে নিয়ে সাঁইজীর পুণ্যভূমি ছেঁউড়িয়ার বারামখানা ত্যাগ করতে শুরু করেন সাধুরা। তবে দূর-দূরান্ত থেকে আসা সাধুদের অনেকেই আজ শুক্রবার ভক্তদের সঙ্গে নিয়ে পোটলা-পুটলি গুটিয়ে আখড়াবাড়ি ছেড়ে যাবেন নিজ নিজ আশ্রমের দিকে। সাধুদের মতে, লালন ভক্তরা সাইজীর পুণ্যধামে ছুটে আসেন মনের টানে। আখড়াবাড়িতে উপস্থিত হয়ে তারা পালন করেন তাদের আচার অনুষ্ঠান। দু’দিনেই শেষ হয়ে যায় তাদের কর্মযজ্ঞ। কাজ শেষ হলেই তারা ফিরে যান নিজ নিজ আশ্রমের দিকে। লালন একাডেমির আয়োজনের সঙ্গে তাদের কোন যোগসূত্র নেই। একাডেমির অয়োজনে তারা শুধু ২৪ ঘণ্টায় চারটি সেবা গ্রহণ করেন। এগুলো হচ্ছে, ‘রাখাল সেবা’ (সন্ধ্যা লগ্নে শুকনা খাবার মুড়ি, চিড়া, খাগড়াই মিশিয়ে দেয়া খাবার)। ‘অধিবাসর সেবা’ (রাত ১২টার পর পদ্মপাতা অথবা কলাপাতায় দেয়া জুগল অন্ন অর্থাৎ ডালে-চালে খিচুড়ি)। ‘বাল্যসেবা’ (পরদিন ভোরে গোষ্ঠ গানের পর সকাল ৮টার মধ্যে নাস্তা হিসেবে দেয়া দই, চিড়া, মুড়ি, পায়েস আর পাঁচ রকমের ফল)। ‘পূর্ণসেবা’ (দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টার মধ্যে খেতে দেয়া মাছ, ভাত, সবজি বা ঘণ্ট, ডাল আর দই)। চুয়াডাঙ্গা থেকে এসেছেন বাউল করিম শাহ। তিনি বলেন, ‘আমরা সাঁইজীর ‘উফাত দিবস’ পালন করতে এখানে এসেছি। আমাদের অনুষ্ঠান দু’দিনেই শেষ হয়ে যায়। বাউল-সাধুরা লৌকিকতা পছন্দ করেন না। তারা সাঁইজীকে ভক্তি, শ্রদ্ধা জানাতে এবং নিজের মধ্যে ভাববিনিময় ও গুরুকে খুঁজতেই ব্যস্ত থাকেন। সাধুরা বিশ্বাস করেন আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়া সম্ভব। তারা এখানে আসেন সাঁইজীর সাক্ষাত পেতে। সেই সঙ্গে দেখা হয় তাঁর ‘পুণ্যভূমি’। ‘বাড়ির পাশে আরশিনগর, সেথা এক পড়শি বসত করে’ এই সেøাগান নিয়ে এবার বুধবার থেকে কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়ায় শুরু হয় মরমি সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের ১২৯তম তিরোধান দিবসের তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠান। বসে লালন মেলা। তিরোধান দিবসের এ আয়োজনকে ঘিরে লালন ভক্ত অনুসারী, দর্শক-শ্রোতা ও বাউল-বাউলানীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে লালনের চারণভূমি ও সাধন-ভজনের তীর্থ স্থান ‘ছেঁউড়িয়া’। আখড়াবাড়িতে বসে সাধুদের মিলনমেলা। অনুষ্ঠানের প্রথমদিন বুধবার সন্ধ্যালগ্নে ছোট ছোট কাপড়ের টুকরোর ওপরে, শীতল পাতার মাদুরে, এমনকি মাটিতে গামছা বিছিয়ে আসনে বসেন তারা। ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গান ধরেন লালন শিল্পী ও ভক্তরা। ‘মানুষ ভোজলে সোনার মানুষ হবি’, ‘কোথায় হে দয়াল কা-ারি, এসো হে ওপারের কা-ারি, রাখিলেন সাঁই কূপজল করে আন্ধেলা পুকুরে’, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি, কেমনে আসে-যায়।’ আসরে তাদের গানের সঙ্গে তাল দেন সাধারণ দর্শনার্থীরাও। প্রত্যেকটি গানের শেষে এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করছেন আসরের গুরুরা। মনোযোগ দিয়ে শুনেন শিষ্যরা। ফকির ঝণ্টু শাহ বলেন, ‘লালনের দর্শন ছাড়া শান্তি পাওয়া যাবে না। সাঁইজীর বাণীর মধ্যেই সকল সুখ-শান্তির সন্ধান রয়েছে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে তার দেখানো পথে চললে সুখ পাওয়া যাবে। তাই তো সাঁইজী তার গানের মধ্যে বলেছেন, ‘মানুষ ভোজলে সোনার মানুষ হবি।’ মানুষকে ভালবাসতে হবে। তাহলেই সবার মনে প্রাণে সুখ-শান্তি বিরাজ করবে’। বৃহস্পতিবার ছিল বাউলদের ‘অষ্টপ্রহরের সাধুসংঘ’ আচার অনুষ্ঠানের শেষদিন। এদিন ভোরে ‘গোষ্ঠ গানে’র মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাধুদের দ্বিতীয় দিনের আচার অনুষ্ঠান। লালন একাডেমি সূত্র জানায়, ভোরে গোষ্ঠ গানের মধ্য দিয়ে তিরোধান দিবস কিংবা স্মরণোৎসবের দ্বিতীয় দিন শুরু হয়। দিনটিকে স্বাগত জানানোই গোষ্ঠ গানের মূল উদ্দেশ্য। এরপর একে একে অনুষ্ঠিত হয় তাদের কার্যকরণ। গুরু-শিষ্যের ভাব আদান-প্রদান, লালন তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা, আর সেই সঙ্গে চলে নিজস্ব ঘরানায় বসে লালনের গান পরিবেশন। গোষ্ঠ গান, ‘লয়ে গো ধন গোষ্ঠের কানন চল গোকুল বিহারি, গোষ্ঠে চলো হরি মুরারি, ওরে ও ভাই কেলে শোনা চরণে নূপুর নেনা। মাথায় মোহন চোরা দেনা ধরা পড়ো বংশী ধারী। লয়ে গো ধন গোষ্ঠের কানন চল গোকুল বিহারি’। এই গান পরিবেশন করা হয়। এরপর শুরু হয় ‘বাল্যসেবা’ (সকালের নাস্তা)। সকাল ৮টার মধ্যে নাস্তা হিসেবে সাধুদের খেতে দেয়া হয় দই, চিড়া, মুড়ি, পায়েস আর পাঁচ রকমের ফল। বাল্যসেবা শেষ হলে শুরু হয় গান-বাজনা ও তত্ত্ব আলোচনা। বাউলরা বসেন আপন ঘরানায়। দল বেঁধে বসে বাউল-সাধকরা ব্যস্ত থাকেন তত্ত্ব আলোচনায়। সকাল ১০টা থেকে শুরু হয় লালন সাঁই ও অন্য সাধু-গুরুদের গানের বিশ্লেষণ পর্ব। গাওয়া হয় ‘কোথায় হে দয়াল কা-ারি, এসো হে ওপারের কা-ারি, রাখিলেন সাঁই কূপজল করে আন্ধেলা পুকুরে’। এরপর দুপুরে দেয়া হয় ‘পূর্ণসেবা’। দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টার মধ্যে সাধুদের দুপুরের খাবার হিসেবে খেতে দেয়া হয় মাছ, ভাত, সবজি বা ঘণ্ট, ডাল আর দই। এই আহারকেই বলে ‘পূর্ণসেবা’। আর পূর্ণসেবার এই লগ্নকে বলে ‘অষ্টপ্রহরের সাধুসঙ্গ’। আগেরদিন বুধবার সন্ধ্যায় ‘রাখাল সেবা’ থেকে শুরু করে পরদিন বৃহস্পতিবার দুপুরের ‘পূর্ণসেবা’ পর্যন্ত চারটি সেবায় আহারের ব্যবস্থা লালন একাডেমি কর্তৃপক্ষই করে থাকে। বাউলদের একটি সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার দুপুরে ‘পূর্ণসেবা’ গ্রহণের মধ্য দিয়েই শেষ হয় সাধু-গুরু, শিষ্যদের ‘অষ্টপ্রহরের সাধুসঙ্গ’ এবং লালন তিরোধান দিবসের সার্বিক আনুষ্ঠানিকতা। এর পরপরই সাধু-গুরু তাদের সেবাদাসী এবং ভক্ত ও অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে নিজ নিজ আশ্রমের দিকে ফিরে যেতে শুরু করেন। আবার অনেকে থেকে যাবেন আজ শুক্রবার অনুষ্ঠানের শেষদিন পর্যন্ত। লালন মাজারের খাদেম মহম্মদ আলী বলেন, ‘সত্য ও সুপথের সন্ধানে মানবতার দীক্ষা নিতে আত্মার টানে দেশ-বিদেশের সাধু-গুরু ও ভক্তরা দলে দলে এসে সাঁইজীর মাজারে আসন গাড়েন। তারা গেয়ে চলেন সাঁইজীর আধ্যাত্মিক মর্মবাণী ও দেহতত্ত্বের গান’।
×