ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘জাদুর প্রদীপ’ মাইমোড্রামা

প্রকাশিত: ১৩:২২, ১৭ অক্টোবর ২০১৯

‘জাদুর প্রদীপ’ মাইমোড্রামা

‘দুর্জনের হয় না ছলের অভাব’। তাই তো সে কখনও ধর্মের লেবাস পরে, কখনও বা অন্য ভাব ধরে। আর সাধারণের অসচেতনতার সুযোগে, ঝোপ বুঝে কোপ মারে। তারপর, এভাবেই ঘটে যেতে পারে পালাবদল ক্ষমতার! সত্যিই তো পূর্বসূরিদের কাছ থেকে উত্তরসূরি বা পরবর্তী প্রজন্ম ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি আর নিজস্বতার শক্তির কথা যদি সঠিকভাবে জানতেই না পারে, তাহলে সে শত্রু-মিত্র চিনবে কী করে. এমতাবস্থায় এমন বিপত্তিই ঠিক, ঘটাই স্বাভাবিকÑ তা সে রূপকথার আলাদিনের মুল্লুকের কথা বলেন, আর এ কালের কথাই বলেন!’ ‘আরব্য রজনী’-র অমর আখ্যান ‘আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ’-এ ক্ষমতালোভী জাদুকর যখন আলাদিনের অবর্তমানে এবং আলাদিনের স্ত্রীর অজ্ঞতার সুযোগে অসীম শক্তিধর দৈত্যের নিয়ন্ত্রণকারী পুরাতন প্রদীপটি অন্য একটি চকচকে নতুন প্রদীপের বিনিময়ে বদলে নেয়, তখন বিমূঢ় দর্শকের সামনে এ কথাগুলোই উচ্চারণ করে ওই কাহিনী অবলম্বনে স্বপ্নদলের মাইমোড্রামা ‘জাদুর প্রদীপ’-এর ‘গ্রন্থিক’! ও হ্যাঁ, ‘মাইমোড্রামা’ বা ‘মূকনাট্য’ বলা হয় মূকাভিনয় আঙ্গিকে নির্মিত একক-কাহিনীভিত্তিক পূর্ণাঙ্গদৈর্ঘ্যরে প্রযোজনাকে। তাহলে সে প্রযোজনায় সংলাপ বা কথা থাকে কীভাবে! এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করার পূর্বে স্বপ্নদলের ‘জাদুর প্রদীপ’-এর কাহিনীটি স্মরণ করা যাক। ক্ষমতালোভী জাদুকরের দূরবর্তী পাহাড়ের মধ্যে থাকা জাদুর প্রদীপ সম্পর্কে জানা, ছদ্মবেশে দুঃখিনী মায়ের ছেলে আলাদিনের মাধ্যমে প্রদীপ উদ্ধার, ঘটনাক্রমে আলদিনের হাতে প্রদীপ চলে যাওয়া, রাজউদ্যানে রাজকন্যার দর্শন ও প্রেমে পড়া, উজির-উজিরপুত্রের চক্রান্ত ব্যর্থ করে রাজকন্যার সঙ্গে আলাদিনের বিবাহ, জাদুকর কর্তৃক পুনরায় প্রদীপ দখল, অবশেষে উজির-ডাকাতদল-জাদুকর প্রভৃতি নানা বাধা অপসারণের মাধ্যমে আলাদিনের বিজয় অর্জনÑ সংক্ষেপে এ নাট্যের কাহিনী। আর শেষে দৈত্যকে মুক্তি দিয়ে অলৌকিকতা থেকে আলাদিন ফিরে আসে প্রাকৃত জীবনে। বর্ণিত গল্পের পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং না বলা নানা ঘটনার বিস্তারিত উপস্থিাপিত হয় মঞ্চে দেড় ঘণ্টা ব্যাপ্তির ‘জাদুর প্রদীপ’ প্রযোজনায় মূকাভিনয়-কৌশলে। থাকে তাৎক্ষণিক সৃষ্ট কিংবা ধারণকৃত প্রাচ্য-মধ্যপ্রাচ্য-প্রতিচ্য সঙ্গীতের আকর্ষণীয় একাঙ্গীকরণ। প্রকৃতপক্ষে, ‘জাদুর প্রদীপ’ রূপকথার মোড়কে মানবজাতির চিরায়ত ‘আর্কিওটাইপ’ বা প্রতœবৈশিষ্ট্যের ধারকরূপে ক্ষমতার মোহ, ছলনা, কুটিলতা, ষড়যন্ত্র, স্বার্থপরতা, প্রতিশোধস্পৃহা এবং এসবের সমান্তরালে ইতিবাচকতা, প্রেম, শুভচিন্তা আর অন্যায়ের পতন উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে যেন জীবন্ত আর দর্শকের নিবিড়-আপন হয়ে ওঠে! এ প্রেক্ষাপটে মূকাভিনয়ের প্রচলিত উপস্থাপনরীতি থেকে ভিন্নতর তত্ত্ব ও প্রয়োগরীতির ভাবনা নিয়ে ‘বাঙলা মূকাভিনয়রীতি’ সৃজনের উদ্দেশ্যে ‘ল্যাবরেটরি থিয়েটার’ বা ‘গবেষণাগার নাট্য’ পদ্ধতিতে স্বপ্নদলের ‘জাদুর প্রদীপ’ প্রযোজনাটি নির্মিত হয়। এক্ষেত্রে কাহিনী-পুনবিন্যাসকারী ও নির্দেশক হিসেবে আমার অভীপ্সা ছিল মূকাভিনয়ের শরীরে প্রাচ্য নাট্যশাস্ত্রসমূহে বর্ণিত আঙ্গিক অভিনয়ের মুদ্রা-চারী-দৃষ্টিভেদ-শিরভেদ-গ্রীবাভেদ প্রভৃতি অনুষঙ্গের সংযোগ এবং বিশ^মূকাভিনয়ধারার স্পষ্ট ব্যতিক্রম হিসেবে উপস্থাপনায় প্রাচ্যের ‘গ্রন্থিক’ ও ‘শৌভিক’ ধারার প্রয়োগ। প্রাচীন ভারতে রামায়ণ-মহাভারত প্রভৃতি মহাকাব্যের কাহিনী উপস্থাপনে উল্লিখিত দু’প্রকৃতির অভিনয়শিল্পী ব্যবহারের তথ্য পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে জন্মগ্রহণকারী শাস্ত্রকার পতঞ্জলি-র ‘মহাভাষ্য’ প্রভৃতি গ্রন্থে। এখানে ‘গ্রন্থিক’-রা কাহিনী আবৃতি এবং ‘শৌভিক’-রা এ আবৃতির সঙ্গে নিপুণ অঙ্গাভিনয় করত। ঐতিহ্যের সে ধারাবাহিকতায় স্বপ্নদলের মাইমোড্রামা ‘জাদুর প্রদীপ’-এ কাহিনীর গ্রন্থিমোচনে গ্রন্থিক কখনও কথা, কখনও সঙ্গীত-নৃত্যে বা নির্বাকতায় অঙ্গাভিনয়ের মাধ্যেেম কাহিনী বর্ণনা বা সূত্র ধরিয়ে দেয়। ঔপনিবেশিক অতীতের দায়মোচনে ঐতিহ্যের ধারায় বর্ণনাত্মক বাঙলা মূকাভিনয়রীতি বিনির্মাণের এ প্রয়াস ব্যাপক দর্শকনন্দিত হয়েছে। সর্বশেষ গত ৬ অক্টোবর ঢাকার শ্রী শ্রী বরদেশ^রী কালীমাতা মন্দির আয়োজিত ‘শারদীয় নাট্যোৎসব’-এ কয়েক হাজার দর্শকের সামনে ‘জাদুর প্রদীপ’-এর ৩৪তম মঞ্চায়ন এবং ৯ অক্টোবর এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটারে ৩৫তম সফল মঞ্চায়নের মাধ্যমে পুনরায় প্রযোজনাটির গ্রহণীয়তা প্রমাণিত হয়েছে। একইসঙ্গে এটি বাংলাদেশে সর্বাধিকবার মঞ্চায়িত মাইমোড্রামার স্বীকৃতিও পেয়েছে।
×