ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রতিবছর দুর্ঘটনায় নিহত ১০ হাজার, আহত ১৭ হাজার

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ১৭ অক্টোবর ২০১৯

প্রতিবছর দুর্ঘটনায় নিহত ১০ হাজার, আহত ১৭ হাজার

নিখিল মানখিন ॥ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত মানুষের সুচিকিৎসার পাশাপাশি সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রতিবছর ১৭ অক্টোবর পালন করা হয় ‘বিশ্ব ট্রমা দিবস’। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে সড়কসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রতিবছর ৮ থেকে ১০ হাজার জনের মৃত্যু ঘটে, আহতের সংখ্যা ১৫ থেকে ১৭ হাজার। দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সড়ক, নৌ ও রেলপথে এবং দুর্যোগ-দুর্বিপাক, অগ্নিকা-সহ নানা কারণে ট্রমার ঘটনা ঘটে। এ থেকে প্রাণহানিও দিন দিন বাড়ছে। তাৎক্ষণিক চিকিৎসা না পাওয়ায় অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করছে। সারাদেশে ট্রমা এবং ট্রমাজনিত কারণে প্রাণহানি প্রতিরোধে সরকারী-বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাগুলোর এগিয়ে এসে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া দরকার। পাশাপাশি ট্রমা রোগীদের যথাযথা চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। সড়কেই বেশি দুর্ঘটনার শিকার হয় মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদন বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর দেশে আর্থিক ক্ষতি বিশাল অঙ্কের। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশে ক্ষতি হয় মোট জিডিপির ১ দশমিক ৬ ভাগ। আর বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় ১২ হাজারের বেশি মানুষ। আহতের সংখ্যা চার/পাঁচ গুণ বেশি। তাদের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের ১৯২ দেশের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের অবস্থান ৯০তম। গণমাধ্যমকর্মীদের সংগঠন শিপিং এ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরামের (এসসিআরএফ) নিয়মিত মাসিক জরিপ ও পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছর জানুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে দুই হাজার ৮০৭ সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৮৪ নারী, ৪৭৮ শিশুসহ তিন হাজার ৭৫ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৬৯৭। দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে এসব দুর্ঘটনা ঘটে। দেশের ২২ জাতীয় দৈনিক, দশটি আঞ্চলিক সংবাদপত্র ও আটটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও সংবাদ সংস্থার তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, জানুয়ারিতে ৩৮৩ সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৩ নারী, ৭১ শিশুসহ নিহত ৪১১ ও আহত ৭২৫; ফেব্রুয়ারিতে ৪০১ দুর্ঘটনায় নিহত ৪১৫, আহত ৮৮৪; মার্চে ৩৮৪ দুর্ঘটনায় ৪৬ নারী, ৮২ শিশুসহ নিহত ৩৮৬, আহত ৮২০; এপ্রিলে ৩২৭ দুর্ঘটনায় নিহত ৩৪০ ও আহত ৬১০; মে মাসে ২৯৭ দুর্ঘটনায় ৪৭ নারী, ৪৪ শিশুসহ নিহত ৩৩৮, আহত ৫০৪, জুনে ৩৬৭ দুর্ঘটনায় ৪৯ নারী, ৬৯ শিশুসহ নিহত ৪৩৯, আহত ৮১৮; জুলাইয়ে ৩২৭ দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত যথাক্রমে ৩৪৮ ও ৫১৩, এর মধ্যে ৪৬ নারী ও ৪০ শিশু; আগস্টে ৩৩৭ দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে ৩৯৮ জনের, যার মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা যথাক্রমে ৪৭ ও ৫৭। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৮২৩। এসসিআরএফ সভাপতি আশীষ কুমার দে জানান, তাদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দশটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রবণতা, অদক্ষ চালকের কাছে দৈনিক চুক্তিভিত্তিক গাড়ি ভাড়া, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ,বিধি লঙ্ঘন করে ওভারলোডিং ও ওভারটেকিং, সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেলসহ তিন চাকার যানবাহন চলাচল বৃদ্ধি, ব্যস্ত সড়কে স্থানীয়ভাবে তৈরি ইঞ্জিনচালিত ক্ষুদ্রযানে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন, বিরতি ছাড়াই দীর্ঘসময় ধরে গাড়ি চালানো, পথচারীর মধ্যে সচেতনতার অভাব, জনবহুল এলাকাসহ দূরপাল্লার সড়কে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ এবং বিভিন্ন স্থানে সড়কের বেহাল দশা। তিনি বলেন, দুর্ঘটনা কমাতে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সড়কের ওপর অধিক নির্ভরশীলতা কমানো প্রয়োজন। এজন্য নৌ ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারিত ও আধুনিকায়ন করতে হবে। ’১৮ সালে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহত ৮ হাজার, আহত ১৬ হাজার ॥ বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সারাদেশে মোট ৫ হাজার ৫১৪ সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ মারা গেছেন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৫ হাজার ৪৬৬ জন। এছাড়া সড়ক, রেল, নৌ এবং আকাশ পথে মোট ৬ হাজার ৪৮ দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৭৯৬ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ১৫ হাজার ৯৮০। ’১৮ সালে রেলপথে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭০। এতে মারা গেছেন ৩৯৪, আহত ২৪৮। নৌপথে ১৫৯ দুর্ঘটনায় মারা যান ১২৬, আহত ২৩৪। এসব দুর্ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছেন ৩৮৭। ’১৮ সালে আকাশ পথে পাঁচটি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হন ৫৫ জন, আহত হন ৩২। ট্রমা সেন্টারগুলো পুরোদমে চালু হয়নি ॥ প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে ছোট-বড় আকারের সড়ক দুর্ঘটনা। ঘটণাস্থলেই প্রাণ হারাচ্ছে অনেক যাত্রী। কেউ বরণ করে নিচ্ছেন চিরস্থায়ী পঙ্গুত্ব। আর পরবর্তী চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতার জন্য আহতের অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছেন পরে। আহত যাত্রীদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সেবা প্রদান এবং দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি কমানোর লক্ষ্যে সারাদেশে মহাসড়কের পাশে নির্মাণ করা হয়েছে আটটি ট্রমা সেন্টার। কিন্তু কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেন্টারগুলো পঙ্গুদের চিকিৎসার পরিবর্তে বছরের পর বছর ধরে নিজেরাই পঙ্গু হয়ে পড়ে রয়েছে। চিকিৎসক, কর্মচারী, ওষুধ এবং যন্ত্রপাতি সব থাকার পরও সেন্টারগুলো পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি । বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, দুর্ঘটনায় যে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে সেটা আমাদের জাতীয় জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ। দুর্ঘটনায় কর্মজীবী লোকজন বেশি মারা যাচ্ছে। এটাও আমাদের অর্থনীতির জন্য একটা খারাপ দিক। এই অবস্থায় তিনি সারাদেশে স্থাপিত ট্রমা সেন্টার দ্রুত চালু করার পরামর্শ দেন। দগ্ধদের চিকিৎসার সুব্যবস্থা করেছে সরকার ॥ রাজধানীর চানখারপুলে স্থাপিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ‘শেখ হাসিনা ন্যাশনাল বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট’ এর সেবা কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে। রাজধানীর চানখারপুল এলাকায় ১৮ তলা বিশিষ্ট এই বিশেষায়িত ইনস্টিটিউটের সেবা কার্যক্রম চালু হওয়ার মাধ্যমে সারাদেশে দগ্ধজনিত ট্রমা রোগীর চিকিৎসাসেবার পরিধি অনেকগুণ বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল ইনস্টিটিউটটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং মূল ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল। ১৮ তলাবিশিষ্ট এ ইনস্টিটিউটের মাটির নিচে তিনতলা বেজমেন্ট। সেখানে গাড়ি পার্কিং ও রেডিওলজিসহ কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিভাগ রাখা হয়েছে। ইনস্টিটিউটটিতে ৫০০টি শয্যা, ৫০টি ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট, ১২টি অপারেশন থিয়েটার ও অত্যাধুনিক পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ড রয়েছে। এ ভবনটিকে তিনটি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। একদিকে বার্ন ইউনিট, অন্যদিকে প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট আর অন্য ব্লকটি একাডেমিক ভবন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জরুরী চিকিৎসার প্রয়োজনে রোগী নিয়ে আসার জন্য ভবনের ছাদে হেলিপ্যাড সুবিধা রাখা হয়েছে। হাসপাতালের পার্কিংয়ে একসঙ্গে ১৮০টি গাড়ি রাখার ব্যবস্থা থাকবে।
×