ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাঁইজির টানে ছেঁউড়িয়া আখড়াবাড়িতে ছুটছে ভক্তকুল

প্রকাশিত: ১১:২২, ১৬ অক্টোবর ২০১৯

সাঁইজির টানে ছেঁউড়িয়া আখড়াবাড়িতে ছুটছে ভক্তকুল

এম এ রকিব ॥ সাঁইজির টানে ছুটছে মানুষ। কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ বা অটোরিক্সায়। আবার কেউ বাস কিংবা অন্যান্য যানবাহনে চেপে। সবারই গন্তব্য লালনধাম, কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া আখড়াবাড়ি। যেখানে মিলন ঘটতে যাচ্ছে, নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষের। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সাঁইজির অমর বাণী-মরমী সঙ্গীত, ‘বাড়ির পাশে আরশী নগর সেথা একঘর পড়শী বসত করে, আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে/সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে, লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এ নজরে/পার কর হে দয়াল চাঁদ আমারে’। কিংবা ধ্বনিত হচ্ছে, ‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি/মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ আধ্যাত্মিক সব গান। কুষ্টিয়া শহর থেকে মাত্র ১০-১৫ মিনিটের পথ এখন যেতে সময় লাগছে এক ঘণ্টার ওপর। সাঁইজির টানে লালনের আখড়াবাড়িতে বাউল ছাড়াও সাধারণ দর্শনার্থীর ভিড় লেগেছে। মরমী সাধক ও বাউল শিরোমণি ফকির লালন শাহের ১২৯তম তিরোধান বা মৃত্যু দিবস ১ কার্তিক আজ। দিনটি উপলক্ষে লালনের চারণভূমি ও সাধন-ভজনের তীর্থস্থান লালনের আঁখড়াবাড়িতে বসছে সাধুর হাট। শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপী উৎসব। তবে লালন একাডেমি ও জেলা প্রশাসন দিনটিকে লালনের তিরোধান দিবস বা প্রয়াণ দিবস হিসেবে পালন করলেও লালন ভক্ত, সাধু-গুরু-গোসাইরা দিনটিকে ‘উফাত দিবস’ হিসেবে পালন করেন। লালন একাডেমির আয়োজনে এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ১৬ অক্টোবর সন্ধ্যা থেকে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী এ উৎসবে থাকছে লালন মেলা, লালনের জীবনাদর্শন ও স্মৃতিচারণ করে আলোচনা সভা ও লালন সঙ্গীতানুষ্ঠান। প্রথমদিন বুধবার লালন একাডেমির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোঃ আসলাম হোসেনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এমপি’র এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। এছাড়া কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী রবিউল ইসলাম, পুলিশ সুপার তানভীর আরাফাত প্রমুখ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। লালনের এই তিরোধান দিবস ও দোলপূর্ণিমা উৎসবে যোগ দিতে কারও কোন দাওয়াত লাগে না, পত্র লাগে না, তবুও মানুষ উদাসী এক টানে এখানে ছুটে আসেন। আসেন দলে-দলে হাজারে হাজারে। এখানে মিলন ঘটে নানা ধর্ম, নানা বর্ণের মানুষের। কেউ আসেন ধব ধবে সাদা পোশাকে। কেউ আবার আসেন গেরুয়া বসনে। সাঁইজির টানে এ ধামে বাউল ছাড়াও অসংখ্য সাধারণ দর্শনার্থীর ভিড় জমে। তারা লালন সঙ্গীতের সুরের মূর্ছনায় মাতিয়ে তোলেন বাউলধাম। লালন মাজারের আশপাশে ও মরা কালী নদীর তীর ধরে বাউলেরা ছোট ছোট আস্তানা গেড়ে সাঁইজিকে স্মরণ করেন গানে গানে। একতারা-দোতারা, ঢোল-খোল, বাঁশি, প্রেমজুড়ি, চাকতি, খমক হাতে ক্ষণে ক্ষণেই খ- খ- মজমা থেকে নৃত্যসঙ্গীতের তালে তালে ছলকে উঠে ভাববাদী ঢেউ। আখড়ার একটি দল থামে, তো অন্যটি জমিয়ে রাখে চারপাশ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রথমদিন বুধবার বিকেলের মধ্যেই সাধু-গুরু (খেলাফতধারী) তাদের সেবাদাসী এবং লালন ভক্ত অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে সাঁইজির পূণ্যভূমি ছেঁউড়িয়ার আঁখড়াবাড়িতে নিজ নিজ পাটে (আসনে) বসবেন। পাটে বা আসনে বসা সাধু-গুরুদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ভক্তি-শ্রদ্ধার বিষয়। যার যেমন সামর্থ্য অনুযায়ী কেউ সাদা বা রঙিন কাপড়ের টুকরোর ওপর, কিংবা শীতল পাতার মাদুর, এমনকি গামছা বিছিয়েও আসনে বসতে পারেন। সাধুসঙ্গের নিয়ম অনুযায়ী পাটে বসে সন্ধ্যা লগ্নে ‘রাখাল সেবা’ গ্রহণের পর থেকে ২৪ ঘণ্টার অষ্টপ্রহর সাধুসঙ্গের আগ পর্যন্ত সাধু-গুরু তাদের ভক্ত-শিষ্যদের নিয়ে ধ্যানে বসে তপজপ করেন। তবে লালন একাডেমি তিনদিন অনুষ্ঠান পালন করলেও সাধুদের মূল অনুষ্ঠান দেড়দিনেই শেষ হয়ে যায়। তখন সাঁইজির পূণ্যভূমি ছেড়ে নিজ নিজ আশ্রমের দিকে চলে যেতে শুরু করেন সাধুরা। এদিকে লালনের ১২৯তম মৃত্যুবার্ষিকীকে ঘিরে ছেঁউড়িয়া এখন উৎসবমুখর। সাধু-গুরু, বাউল-বাউলানী, ভক্ত-অনুসারী ও দর্শক-শ্রোতার পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠছে লালনের আঁখড়াবাড়ি। বাউল ফকির বলাই শাহ বলেন, সাধু-গুরুদের নিয়ম অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টায় সেবা ৪টি। এগুলো হচ্ছে : রাখাল সেবা, অধিবাসর সেবা, বাল্যসেবা, এবং পূণ্যসেবা। সাধুসঙ্গের লগ্ন আসে সন্ধ্যায় পর। পাটে বসে সন্ধ্যা লগ্নে রাখাল সেবা গ্রহণের পর থেকে ২৪ ঘণ্টার অষ্টপ্রহর সাধুসঙ্গের আগ পর্যন্ত সাধু-গুরু তাদের ভক্ত-শিষ্যদের নিয়ে ধ্যানে বসে তপজপ করেন। রাতদিন ২৪ ঘটনায় ৮ প্রহর। এই ৮ প্রহরে তারা একইস্থানে বসে উপাসনা, সাধনা-আরাধনা করেন। যার গুরুর উপসনা সে করেন। যার যার গুরু তাদের ভক্ত-শিষ্যকে যে যে উপাসনা দিয়েছেন, ধ্যানে রেখে সেই তপজপই তারা করেন। শিল্পীরা গান গাইছেন, সাধুরা বসে ধ্যান-তপজপ করছেন, পান খাচ্ছেন, আরাম করছেন, এরই মধ্য দিয়ে তাদের ধর্মী আচার চলতে থাকে। সন্ধ্যা লগ্নে মুড়ি, চিড়া, খাগড়াই (শুকনা খাবার) এক সঙ্গে মিশিয়ে যে খাবার দেয়া হয় তাকে বলে ‘রাখাল সেবা’। এটা দেয়া হয় প্রত্যেক সাধুর গামছায় গামছায়। এই অন্ন গ্রহণ সাধুদের কাছে অত্যন্ত পূণ্যের কাজ। কোন কারণে কেউ যদি এই অন্ন গ্রহণ থেকে বাদ পড়েন, তবে সে নিজেকে দুর্ভাগা মনে করেন। রাখাল সেবার পর সাধুদের আবার খেতে দেয়া হয় রাত ১২টা থেকে ১টার মধ্যে। রাত ১২টার পর পদ্ম পাতা অথবা কলার পাতায় সাধুদের যে জুগল অন্ন অর্থাৎ ডালে-চালে খিঁচুড়ি খেতে দেয়া হয় এটাকে বলে ‘অধিবাসর সেবা’। অধিবাসর সেবার মধ্য দিয়ে শেষ হয় সাধুদের প্রথম দিনের আচার অনুষ্ঠান। দ্বিতীয়দিন ২ কার্তিক বৃহস্পতিবার শুরু হয় বাউলদের অষ্টপ্রহরের সাধুসংঘ। এদিন ভোরে ‘গোষ্ঠী গানে’র মধ্যদিয়ে বাউলদের দ্বিতীয় দিনের আচার অনুষ্ঠান শুরু হয়। লালন একাডেমি সূত্র জানায়, ভোরে গোষ্ঠী গানের মধ্যদিয়ে তিরোধান দিবস কিংবা স্মরণোৎসবের দ্বিতীয় দিন শুরু হয়। দিনটিকে স্বাগত জানানোই গোষ্ঠী গানের মূল উদ্দেশ্য। এরপর একে একে অনুষ্ঠিত হয় তাদের কার্যকরণ। গুরু-শিষ্যের ভাব আদান-প্রদান, লালন তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা, আর সেই সঙ্গে চলে নিজস্ব ঘরনায় বসে লালনের গান পরিবেশন। গোষ্ঠী গান, ‘লয়ে গো ধন গোষ্ঠের কানন চল গোকুল বিহারী, গোষ্ঠে চলো হরি মুরারি, ওরে ও ভাই কেলে শোনা চরণে নুপুর নেনা। মাথায় মোহন চোরা দেনা ধরা পড়ো বংশী ধারী। লয়ে গো ধন গোষ্ঠের কানন চল গোকুল বিহারী’। এ গান পরিবেশন করা হয়। এরপর সকালে শুরু হয় ‘বাল্যসেবা’। সকাল ৮টার মধ্যে এ সেবায় সাধুদের খেতে দেয়া হয় দই, চিড়া, মুড়ি, পায়েস আর পাঁচ রকমের ফল। এতে অনেকেই অংশ গ্রহণ করেন। বাল্যসেবা শেষে শুরু হয় গান-বাজনা ও তত্ত্ব আলোচনা। বাউলরা বসেন আপন ঘরানায়। দল বেঁধে বসে বাউল-সাধকরা ব্যস্ত থাকেন তত্ত্ব আলোচনায়। সকাল ১০টা থেকে শুরু হয় লালন সাঁই ও অন্য সাধু-গুরুদের গানের বিশ্লেষণ পর্ব। গাওয়া হয় ‘কোথায় হে দয়াল কান্ডারি, এসো হে ওপারের কান্ডারি, রাখিলেন সাঁই কুপজল করে আন্ধেলা পুকুরে’ পূণ্যসেবা : দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টার মধ্যে সাধুদের খেতে দেয়া হয় মাছ, ভাত, সবজি বা ঘন্ট, ডাল আর দই। এই আহারকে বলে ‘পূণ্যসেবা’। পূণ্যসেবার এই লগ্নকে বলে অষ্টপ্রহরের ‘সাধুসঙ্গ’। লালন একাডেমি সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার দুপুরে পূণ্যসেবার মধ্য দিয়েই শেষ হবে সাধু-গুরু, শিষ্যদের অষ্টপ্রহরের ‘সাধুসঙ্গ’ এবং লালন উৎসবের সার্বিক আনুষ্ঠানিকতা। এর পরপরই সাধু-গুরু তাদের সেবাদাসী এবং ভক্ত ও অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে নিজ নিজ আশ্রমের দিকে চলে যেতে শুরু করবেন। অনেকে আবার থেকে যাবেন শেষদিন পর্যন্ত। এ সময় গভীররাত অবধি চলে খ্যাতনামা শিল্পীদের পরিবেশনায় লালন সঙ্গীতানুষ্ঠান। বাংলা ১২৯৭ সালের ১ কার্তিক লালন শাহ ১১৬ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। লালন আজ নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তার অমর সৃষ্টি। যার মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে আছেন এবং বেঁচে থাকবেন বাঙালীর মানসপটে।
×