ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্বকাপ বাছাই ফুটবল, বাংলাদেশ ১-১ ভারত

গোল মিসের মহড়ায় দুর্ভাগ্যের ড্র বাংলাদেশের

প্রকাশিত: ১১:০৭, ১৬ অক্টোবর ২০১৯

গোল মিসের মহড়ায় দুর্ভাগ্যের ড্র বাংলাদেশের

জাহিদুল আলম জয় ॥ উত্তাল জনসমুদ্র জয় করার পথেই ছিল বাংলাদেশ। পুরো ম্যাচে অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন ফুটবলশৈলী উপহার দিয়েছে বাংলার টগবগে তরুণেরা। একতরফা প্রাধান্য বিস্তার করে খেলে হাফডজন সহজ গোলের সুযোগও সৃষ্টি করে। বেশিরভাগ সুযোগ মিস হলেও ফরোয়ার্ড সাদ উদ্দিনের প্রথমার্ধের গোলে জয়ের পথেই ছিল লাল-সবুজের দেশ। কিন্তু ম্যাচের শেষ মুহূর্তে এসে গোলটি পরিশোধ করে দেন ভারতীয় ডিফেন্ডার আদিল আহমেদ খান। এর ফলে মঙ্গলবার রাতে ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবল ও ২০২৩ সালের এশিয়ান কাপ ফুটবলের বাছাইয়ের দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে স্বাগতিক ভারতের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করেছে সফরকারী বাংলাদেশ। কলকাতার বিখ্যাত সল্ট লেক (বিবেকানন্দ যুব ভারতীয় ক্রীড়াঙ্গন) স্টেডিয়ামে ‘ই’ গ্রুপের হাইভোল্টেজ ম্যাচটিতে বাংলাদেশ জিততে না পারলেও ফুটবলবিশ্বের মন জয় করে নিয়েছে। অনেকটা দুর্ভাগ্যের কারণেই জেতা ম্যাচ ড্র করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। ম্যাচের রেফারিংও ছিল কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ। সিরিয়ার রেফারি মাসুদ তোফায়েল্লা বাংলাদেশকে অন্তত দু’টি পেনাল্টি থেকে বঞ্চিত করেছেন। তাছাড়া ফরোয়ার্ড নাবীব নেওয়াজ জীবনের একটি প্রচেষ্টা গোললাইন পেরিয়ে গেলেও গোল দেননি তিনি। আর আপসোসে পুড়তে হয় ইব্রাহিমের একটি শট বারপোস্টে লেগে ফিরে আসলে। পুরো ম্যাচে স্বাগতিক ভারতকে রীতিমতো নাচিয়ে ছাড়েন বাংলাদেশের টগবগের তরুণেরা। বিশেষ করে লেফট উইঙ্গার মোহাম্মদ ইব্রাহিম, অধিনায়ক জামাল ভুঁইয়া, গোলরক্ষক আশরাফুল ইসলাম রানা ও ফরোয়ার্ড সাদ উদ্দিন ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। এরা প্রত্যেকে দৃষ্টিনন্দন ফুটবলশৈলী উপহার দিয়ে মন জয় করে নিয়েছেন সল্ট লেকের হাজার হাজার দর্শকদের। দুর্দান্ত গতি দিয়ে ইব্রাহিম বারবার বাংলাদেশের আক্রমণ যেমন রচনা করেছেন তেমনি রক্ষণভাগেও ছিলেন দুর্ভেদ্য দেয়াল হিসেবে। ভারতের বেশ কয়েকটি ভাল আক্রমণ দক্ষতার সঙ্গে ফিরিয়ে দেন ইব্রাহিম। গোলরক্ষক রানাও স্বাগতিকদের কয়েকটি গোল হওয়ার মতো আক্রমণ নস্যাত করে দেন। আর ময়মনসিংহের সোনার ছেলে জামাল মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ করে ভারতকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দেন। এরপরও মূলত দুর্ভাগ্যের কারণে নিশ্চিত জয় হাতছাড়া করে ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছে জেমি ডে’র ছাত্রদের। ম্যাচটি নিয়ে দুই বাংলার সমর্থকদের মধ্যেই বিরাজ করছিল টানটান উত্তেজনা। টিকেটের জন্য রীতিমতো হাহাকার সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ নয় বছর পর ভারত জাতীয় দলের খেলা দেখতে মুখিয়ে ছিলেন কলকাতার সমর্থকরা। ম্যাচটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হওয়ায় আগ্রহের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। ম্যাচের প্রতিটি মুহূর্ত গ্যালারিতে উপস্থিত প্রায় ৭০ হাজার দর্শক মুখরিত করে রাখেন। দু’দলের আক্রমণকেই বাহবা দিয়েছেন তারা। আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণে মর্যাদার লড়াই শুরু থেকেই দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠে। ম্যাচের প্রথম মিনিটেই দারুণ আক্রমণ শাণায় বাংলাদেশ। কিক অফের পর বাম প্রান্ত দিয়ে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ভারতের ডি বক্সে ঢুকে পড়েন লেফট উইঙ্গার মোহাম্মদ ইব্রাহিম। কিন্তু তাকে ভারতীয় ডিফেন্ডার রাহুল ভেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেও বাঁশি বাজাননি সিরিয়ার রেফারি মাসুদ তোফায়েল্লা। চতুর্থ মিনিটে পাল্টা আক্রমণে আসা ভারতীয় অধিনায়ক সুনিল ছেত্রীর জোরালো শট দক্ষতার তালে তালুবন্দী করেন বাংলাদেশ গোলরক্ষক আশরাফুল ইসলাম রানা। ম্যাচের অস্টম মিনিটে আবারও বামপ্রান্ত দিয়ে দ্রুতগতিতে স্বাগতিকদের ডি বক্সে ঢুকে পড়েন সফরকারী দলের ইব্রাহিম। এবারও তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন ভারতীয় ডিফেন্ডার রাহুল। কিন্তু রেফারি আগেরবারের মতো এবারও ফাউল ধরেন নি। ফলে নিশ্চিত পেনাল্টি বঞ্চিত হয় বাংলাদেশ। ৩০ মিনিটে ডানপ্রান্ত দিয়ে ভারতের দু’জনকে কাটিয়ে দ্রুতগতিতে ডি বক্সে ঢুকে পড়েন বাংলাদেশের ফরোয়ার্ড বিপলু আহমেদ। এরপর তার নেয়া শটে পা ছোঁয়াতে ব্যর্থ হন আরেক ফরোয়ার্ড নাবীব নেওয়াজ জীবন। এই আক্রমণটি একজন ভারতীয় ডিফেন্ডার কর্নারের বিনিময়ে ব্যর্থ করে দেন। তিন মিনিট পর বাংলাদেশ দলকে রক্ষা করেন গোলরক্ষক রানা। ভারতের একটি সংঘবদ্ধ আক্রমণে বল গোলে প্রবেশের মুহূর্তে ফিরিয়ে দেন দীর্ঘকায় এই গোলরক্ষক। ৩৭ মিনিটে নিশ্চিত গোলবঞ্চিত হয় বাংলাদেশ। রায়হানের লম্বা থ্রো থেকে হেড বারপোস্ট ছুঁয়ে বাইরে চলে যায়। একের পর এক সুযোগ হারানো বাংলাদেশ অবশেষে ম্যাচের ৪২ মিনিটে কাক্সিক্ষত গোল আদায় করে নেয়। এ সময় বামপ্রান্তে ফ্রিকিক পায় বেঙ্গল টাইগার্সরা। অধিনায়ক জামাল ভুঁইয়ার মাপা শট গোলমুখে আসলে লাফিয়ে উঠে বলের নাগাল পাননি ভারতীয় গোলরক্ষক গুরপ্রীত সিং। বলের ফ্লাইট মিস করেন তিনি। এই সুযোগে দৃষ্টিনন্দন হেডে বল জালে জড়িয়ে দেন বাংলাদেশী ফরোয়ার্ড সাদ উদ্দিন (১-০)। গোল হজম করে সল্ট লেকের গ্যালারি রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে যায়। এই গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যান কোচ জেমি ডে’র ছাত্ররা। বিরতির পরও দারুণ আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে থাকে বাংলাদেশ। ৫১ মিনিটে আরেকটি গোল প্রায় পেয়েই গিয়েছিল বেঙ্গল টাইগার্সরা। সংঘবদ্ধ আক্রমণে অনেকটা ফাঁকায় বল পেলেও বাইরে মেরে সুযোগটি নষ্ট করেন জীবন। ৫৫ মিনিটে আরেকবার হতাশায় ডুবতে হয় বাংলাদেশকে। এবার দারুণ গতিতে এগিয়ে যাওয়া ইব্রাহিমের ডি বক্সের বাইরে থেকে নেয়া বা পায়ের শট ভারতের বারপোস্টে লেগে ফিরে আসে। ৭২ মিনিটে আবারও গোল পেতে পেতে পায়নি বাংলাদেশ। এবার পাল্টা আক্রমণে ভারতের দু’জন ডিফেন্ডারকে ডজ দিয়ে আগুয়ান ভারতীয় গোলরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে বল গোলমুখে ঠেলে দেন জীবন। তার শটে বল প্রায় জালে ঢুকেই গিয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভারতের ছয় নম্বর জার্সি পরিহিত খেলোয়াড় গোলমুখ থেকে বলটি ফিরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে গোলবঞ্চিত করেন। তবে টিভি রিপ্লেতে দেখা গেছে, বলটা গোললাইন পেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রেফারি গোল দেননি। উল্টো গোলের দাবি করায় জীবনকে হলুদ কার্ড দেখান রেফারি। এরপর আরও কয়েকটি সুযোগ হাতছাড়া হয় বাংলাদেশের। উল্টো ম্যাচ শেষের এক মিনিট আগে (৮৯ মিনিট) কর্নার কিক থেকে আসা বলে ডিফেন্ডার আদিল খান হেডে গোল করে ভারতকে সমতায় ফেরান (১-১)। এই মাঠে ৩৪ বছর পর মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ ও ভারত। এর আগে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে শেষবার ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ খেলেছিল ১৯৮৫ সালের ১২ এপ্রিল। সেটাও ছিল বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের ম্যাচ। ওই ম্যাচে ভারত জিতেছিল ২-১ গোলে। এই ম্যাচটির মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর দেখা হলো দুই দেশের জাতীয় ফুটবল দলের। এই ম্যাচের আগে বাংলাদেশ ও ভারত জাতীয় ফুটবল দলের শেষ দেখা হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ মার্চ। ভারতের গোয়ায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ওই প্রীতি ম্যাচে দুর্দান্ত খেলেছিল বাংলাদেশ। বিতর্কিত রেফারিং ম্যাচটি জিততে না দিলেও ড্র হয়েছিল ২-২ গোলে। এবারও অনেকটা একইভাবে ম্যাচটি ড্র হলো। এই ম্যাচের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে তিনটি করে খেলা শেষ করেছে। এতে দুই হার ও এক ড্রয়ে মাত্র ১ পয়েন্ট নিয়ে সবার নীচে অর্থাৎ পাঁচ নম্বরে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। আর দুই ড্র ও এক হারে ২ পয়েন্ট চার নম্বরে আছে ভারত। গত ১০ সেপ্টেম্বর তাজিকিস্তানের দুশানবেতে নিজেদের প্রথম ম্যাচে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আফগানিস্তানের কাছে ১-০ গোলে হারে বাংলাদেশ। এরপর ১০ অক্টোবর নিজেদের মাঠ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে গোল মিসের মহড়া করে পরবর্তী বিশ্বকাপের আয়োজক কাতারের কাছে হারতে হয় ২-০ গোলে। দু’টি ম্যাচেই বাংলাদেশ ভাল খেলেও সুযোগ মিসের খেসারত দিয়ে হেরেছে। এবার ভারতের বিরুদ্ধে জিততে জিততে ড্র করতে হলো লাল-সবুজের দেশকে।
×