ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কোটি লোকের কাজ ॥ এক শ’ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কর্মযজ্ঞ

প্রকাশিত: ১১:০৪, ১৫ অক্টোবর ২০১৯

কোটি লোকের কাজ ॥ এক শ’ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কর্মযজ্ঞ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ আজকের এক শ’ অর্থনৈতিক অঞ্চলই আগামী দিনের এক কোটি কর্মসংস্থানের আধার। রাজধানীর তীব্র যানজটের সমাধান। আর সে লক্ষ্যেই দ্রুত এগিয়ে চলছে বিদ্যমান একশ’ অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠার কাজ। এই এক শ’ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অন্যতম মোংলায় শিল্পায়নের জন্য প্রস্তুত পাওয়ারপ্যাক ইকোনমিক জোন। যেখানে ২৫ হাজার কর্মসংস্থান হবে। সোমবার এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৫ শিল্প প্রতিষ্ঠানের নামে জমি বরাদ্দ করা হয়েছে। এভাবেই অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে একের পর এক শুরু হচ্ছে শিল্পায়নের কাজ। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠার মহাযজ্ঞ শুরু হলে দেশের এক কোটি মানুষ নিয়োজিত হবে উৎপাদনমুখী কর্মে। এরই মধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে সরকার। দ্বিতীয় ধাপে আরও ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কথা ভাবছে সরকার। সোমবার একথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারী খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। পাওয়ারপ্যাক ইকোনমিক জোনে ৫ শিল্প প্রতিষ্ঠানের নামে জমি বরাদ্দ প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে উদ্যোক্তাদের ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা সম্ভব। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে আরও বলেন, প্রথম পর্বের কাজ শেষ হলে দ্বিতীয় ধাপে নতুন করে আরও ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার উদ্যোগ নেবে সরকার। তিনি মনে করেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণে দেশে ব্যাপক ভিত্তিতে শিল্পায়ন হওয়া প্রয়োজন। আর এ কারণে প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনায় দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক অঞ্চল করে দেয়া হচ্ছে। সোমবার দুপুরে প্যানপ্যাসিফিক সোনারগাঁ হোটেলের গ্র্যান্ড বলরুমে ‘পাওয়ারপ্যাক ইকোনমিক জোন প্রাইভেট লিমিটেডে’ বিনিয়োগের পাঁচটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের নামে জমি বরাদ্দ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। নির্মাণ শুরুর প্রায় সাড়ে তিন বছর পর কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে জমি বরাদ্দ দিয়েছে মোংলা ইকোনমিক জোন। ইতোমধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভূমি বরাদ্দ চুক্তি হয়েছে, যার চারটিই এনার্জিপ্যাকের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে রয়েছে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ইউনিলিভারের অন্যতম পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নাগা লিমিটেড। যৌথ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেশীয় প্রতিষ্ঠান শিকদার গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান পাওয়ারপ্যাক ইকোনমিক জোনকে নিয়োগ করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ বেজা। সোমবার প্রথম ধাপে পাঁচ কোম্পানির কাছে ভূমি বরাদ্দ উপলক্ষে বিনিয়োগ উন্নয়ন বা ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন শীর্ষক কর্মসূচী পালন করে বেজা ও পাওয়ারপ্যাক। এদিকে ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের সড়ক, সেতু, পানি সরবরাহ, বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্র, প্রশাসনিক ভবন ইত্যাদি নির্মিত হয়েছে। এখানে বিদ্যুত কেন্দ্র, আধুনিক সুবিধা সংবলিত অগ্নিনির্বাপণ কেন্দ্র ও বর্জ্য শোধনাগার, পার্শ্ববর্তী নদীতে ২টি জেটি, ট্যাঙ্ক টার্মিনাল, শিল্প স্থাপনের সব ধরনের ইউটিলিটি ও সুযোগ-সুবিধা থাকবে। তাছাড়া এখানে ২৫ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলেও জানানো হয়। বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক মোঃ আবুল কালাম আজাদ, বেজার নির্বাহী সদস্য মোঃ আইউব। পাওয়ারপ্যাকের পরিচালক মোঃ সালাউদ্দিন পাওয়ারপ্যাক ইকোনমিক মোংলার বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন পাওয়ারপ্যাক ইকোনমিক জোন প্রাইভেট লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রন হক শিকদার, প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ও পরিচালক সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহন এবং পরিচালক নাইমুজ্জামান মুক্তাসহ প্রতিষ্ঠানের উর্ধতন কর্মকর্তারা। এদিকে বেজা বলছে একশ’টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের পর শুধু এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানই সৃষ্টি হবে না, বছরে অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন ডলারের পণ্যও রফতানি হবে। যা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশকে উন্নত দেশ হতে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। এতে বর্তমান সরকারের ভিশন ২০২১ এবং উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন ২০৪১ এর বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। এদিকে পরিবেশ নিরাপত্তা বজায় রেখে মোংলা ইকোনমিক জোন গড়ে তোলা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তিনি বলেন, শিল্পায়নে বঙ্গবন্ধু বিসিক গড়ে তুলেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ২৮টির কাজ শেষ করে আনা হয়েছে। সালমান এফ রহমান আরও বলেন, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। মূলত বঙ্গবন্ধুর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কর্পোরেশন বা বিসিক থেকে বিশেষ শিল্পাঞ্চলের ধারণা নেন প্রধানমন্ত্রী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন ধারণা থাকলেও বাংলাদেশে এর বিশেষত্ব হলো এখানে দেশভিত্তিক অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। সুন্দরবনের কাছে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে বিভিন্ন মহলের উদ্বেগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু ও পরিবেশ নিয়ে অত্যন্ত সচেতন এবং সতর্ক। সুন্দরবনের পাশে পরিবেশের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে এ ধরনের প্রকল্প হাতে নেয়া হতো না। এখনও কোন পরিবেশগত ঝুঁকি আছে কিনা তা নিয়মিত খোঁজ রাখা হবে। সুন্দরবনের কাছে হওয়ার কারণে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে বেশি সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ। পবন চৌধুরী বলেন, ২০১৫ সালে জোরেশোরে যাত্রা শুরুর পর পদে পদে তাদের বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। শুরুতে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অনেকে বুঝে উঠতে পারেননি। এখন সারাদেশে অন্তত ২৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ চলমান আছে। মোংলা ও সিলেটের শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রসঙ্গ তুলে তিনি আরও বলেন, মোংলার জন্য দুইবার দরপত্র আহ্বান করেও বেজা ব্যর্থ হয়েছিল। শ্রীহট্টতেও খুব সামান্য টাকার বিনিময়ে জমি চাওয়া হয়েছিল শুরুতে। এখন সেই পরিস্থিতি একেবারেই কেটে গেছে। পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন হলে এই অঞ্চলে শিল্প স্থাপন হবে সবচেয়ে লাভজনক। অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রকল্প পরিচালক সালাউদ্দিন বলেন, মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল এখন সম্পূর্ণভাবে শিল্প স্থাপনের জন্য প্রস্তুত। অনুষ্ঠানে রন হক সিকদার বলেন, ইতোমধ্যে পাওয়ারপ্যাক ইকোনমিক জোন মোংলার ৪৪ শতাংশ প্লট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অবশিষ্ট প্লটগুলো আকর্ষণীয় সুবিধাসহ শিল্প স্থাপনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। অনুষ্ঠানে মোংলা ইকোনমিক জোনের বিস্তারিত নিয়ে একটি প্রসপেক্টাসের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এদিকে সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে গড়ে উঠছে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল। আর পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে দেশের অন্যতম উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান সিকদার গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান পাওয়ারপ্যাক ইকোনমিক জোন প্রাইভেট লিমিটেড। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে পিপিপিতে এটিই দেশে প্রথম উদ্যোগ। ইতোমধ্যে সড়ক, সেতু, পানি সরবরাহ বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্র, প্রশাসনিক ভবন প্রভৃতি নির্মিত হয়েছে। মোংলা ইকোনমিক জোনটি পুরোদমে চালু হলে অন্তত ২৫ হাজার লোকের নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলের সর্ব পশ্চিমে ১১ একর জমি বরাদ্দ পেয়েছে নাগা। এছাড়া শিকদার গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান পাওয়ারপ্যাক পেট্রোলিয়ামকে আট একর, এনার্জিপ্যাককে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য আট একর, শিকদার গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান পাওয়ারপ্যাক স্টিলকে ২২ একর এবং মোটরসাইকেল সংযোজনের জন্য একটি কোম্পানিকে ১৪ একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়। এছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংক ও শিকদার ইনস্যুরেন্সকে শাখা খোলার জন্য ছোট আকারের প্লট বরাদ্দ দেয়া হয় এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে।
×