ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বুয়েটে নিষিদ্ধ রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৮:২৫, ১৪ অক্টোবর ২০১৯

বুয়েটে নিষিদ্ধ রাজনীতি

মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডে প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ভাইস চ্যান্সেলর। আপাতত ১০ দফা দাবি মেনে নিয়েছেন তিনি, যার মধ্যে অন্যতম বুয়েটে ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। আপাতদৃষ্টিতে এতে দোষের কিছু নেই। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, বুয়েট কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারে। তবে সার্বিকভাবে এবং দেশের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষপাতী তিনি নন। ক্যাম্পাস কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ও শিক্ষকদের রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না সেটি নিয়ে বিতর্ক ছিল আগেও। এখন সেই বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বুয়েট ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতেই পারে। সেই স্বাধীনতা ও ক্ষমতা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, ঐতিহাসিক ও মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সর্বোপরি ১৯৭১-এ বাংলাদেশের সুমহান মুক্তিযুদ্ধ ও সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে প্রকৃতপক্ষে ছাত্ররাই অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল ও অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ইতিহাসে তাদের সেই স্থান চির অম্লান ও অবিস্মরণীয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানে যে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করছে সেটি কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতারই অবদান। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করলেই যে সেখানে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে সেই নিশ্চয়তা বা গ্যারান্টি দেবে কে? এ প্রসঙ্গে মর্মান্তিক আবরার হত্যাকা- সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, বুয়েট কর্তৃপক্ষ একটু সচেতন ও সতর্ক হলেই এড়ানো যেত এহেন অনাকাক্সিক্ষত হত্যা। মনে রাখতে হবে যে, বুয়েটের প্রায় প্রতিটি হলেই ছিল এক বা একাধিক টর্চার সেল। সেখানে র‌্যাগিংয়ের নামে বিভিন্ন সময় ‘বড় ভাইদের’ ডাকে সাড়া দিয়ে নির্যাতনের শিকার হতে হতো ‘ছোট ভাইদের’। ভিসিসহ প্রভোস্ট, ছাত্র কল্যাণের দায়িত্বে যিনি নিয়োজিত, সর্বোপরি শিক্ষক সমিতি অবশ্যই তা জানত। তাহলে এতদিন তারা এসব বন্ধে আদৌ কোন পদক্ষেপ কেন গ্রহণ করেননি? আরও রয়েছে ঢাবি, চবি, জাবি, রাবিসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমনকি চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি। প্রসঙ্গত মনে পড়তে পারে বুয়েটের মেধাবী ছাত্রী সনির কথাও, যিনি ছাত্রদলের দু’পক্ষের গোলাগুলিতে নিহত হয়েছিলেন। হায়, সনি হত্যাকা-ের বিচার অদ্যাবধি সম্পন্ন হয়নি। আরও যা দুঃখজনক তা হলো, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও বিভিন্ন সময় সংঘটিত হত্যাকা-ের প্রায় কোনটিরই বিচার হয়নি। আজ এর জন্য ছাত্র রাজনীতিকে দোষ দেয়া যাবে না কোন অবস্থাতেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি কঠোর ও নিরপেক্ষ হয় যাবতীয় অনিয়ম-দুর্নীতি-অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং নিয়মিত পরীক্ষা গ্রহণসহ পাঠদানে হয় মনোযোগী ও একনিষ্ঠ, তাহলে সেখানে ইতিবাচক মন-মানসিকতাসহ সুস্থ ও সুষ্ঠু রাজনীতির বিকাশ ঘটতে বাধ্য। মনে রাখতে হবে যে, ছাত্ররাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যত। একদিন তারাই হাল ধরবে দেশ ও দশের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি নিজে তৈরি হয়ে এসেছেন ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে। বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেনন সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছেন এই বলে যে, ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে সেখানে মৌলবাদী রাজনীতির বিকাশ ঘটতে পারে। এই আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়। মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলা যেমন যুক্তিসঙ্গত ও সমর্থনযোগ্য নয়, তেমনি বাস্তবতা প্রযোজ্য ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রেও। আবরার হত্যাকারীদের মধ্যে চিহ্নিত ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে ইতোমধ্যেই। রিমান্ডে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদও চলছে। বুয়েট থেকে তাদের সাময়িক বহিষ্কারও করা হয়েছে। এজাহার দেয়া সাপেক্ষে করা হবে স্থায়ী বহিষ্কার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে দোষী ও দায়ীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে দলমতের উর্ধে থেকে। ১৪ দলের পক্ষ থেকে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারের দাবি উঠেছে। সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা না করাই ভাল। সবশেষে প্রশ্ন, বুয়েটের শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেয়ার পরও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কেন? প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
×