ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে কর্মশালা উদ্বোধন

কৃষিকে লাভজনক ও বহুমুখীকরণ করতে হবে ॥ কৃষিমন্ত্রী

প্রকাশিত: ১১:২৯, ১৩ অক্টোবর ২০১৯

কৃষিকে লাভজনক ও বহুমুখীকরণ করতে হবে ॥ কৃষিমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, শুধু ধানের ওপর আমাদের নির্ভরশীল হলে চলবে না। কৃষিকে লাভজনক ও এর বহুমুখীকরণ করতে হবে। পুষ্টিজাতীয় নিরাপদ খাদ্যে আমাদের এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। শনিবার বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাজী বদরুদ্দোজা মিলনায়তনে ‘কেন্দ্রীয় গবেষণা পর্যালোচনা ও কর্মসূচী প্রণয়ন কর্মশালা-২০১৯’র উদ্বোধনকালে তিনি বলেন, আমাদের এখন অন্যান্য ফসল, ফলমূল, সবজি- এগুলো উৎপাদন করতে হবে। আমরা দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। এখন আমাদের পুষ্টিজাতীয় নিরাপদ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। এই বিবেচনায় আমরা শাক-সবজির উৎপাদন বৃদ্ধি করেছি। ধান বা বিভিন্ন ফসল শুধু বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করলে হবে না। এটাকে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করতে হবে। ফলমূল, শাক-সবজির মতো উচ্চমূল্যের ফসল আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানির অনেক সুযোগ রয়েছে। সম্প্রতি বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যা প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, এটা একটি মর্মান্তিক ঘটনা। ব্যক্তিগতভাবে আমার রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা এই ধরনের ঘটনা ঘটাবে এটা কাম্য নয়। সারা জাতি এটা নিন্দা করেছে। প্রধানমন্ত্রী কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন যারাই এই ধরনের ঘটনা ঘটাবে সেই দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য। তিনি বলেন, কথা বলার স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার। তাই আইন করে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা উচিত হবে না। ছাত্রদের মূল্যবোধের যেন অবক্ষয় না হয় সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে। কর্মশালা উদ্বোধনকালে কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. আব্দুর রাজ্জাক বারির মৃত্তিকা বিজ্ঞান, কীটতত্ত্ব, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব ল্যাব পরিদর্শন করেন এবং ইনস্টিটিউটের সেমিনার কক্ষের পাশে স্থাপিত বিভিন্ন বিভাগের স্টল ঘুরে দেখেন। গত অর্থবছর যে সব গবেষণা কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়েছিল সেগুলোর মূল্যায়ন এবং এসব অভিজ্ঞতার আলোকে আগামী বছরের গবেষণা কর্মসূচী প্রণয়নের উদ্দেশে এ কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। কর্মশালার কারিগরি অধিবেশন ১৩-১৮ অক্টোবর দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হবে। এই গবেষণা পর্যালোচনা তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়ে থাকে। আঞ্চলিক গবেষণা পর্যালোচনা, অভ্যন্তরীণ গবেষণা পর্যালোচনা ও কেন্দ্রীয় গবেষণা পর্যালোচনা। প্রথমে আঞ্চলিক পরে অভ্যন্তরীণ ও সবশেষে কেন্দ্রীয় গবেষণা পর্যালোচনা ও কর্মসূচী প্রণয়ন কর্মশালার মাধ্যমে গত বছরের গবেষণা কার্যাবলীর বিশ্লেষণের মাধ্যমে পরবর্তী বছরের গবেষণা কর্মসূচী প্রণয়ন করা হয়ে থাকে যে কারণে এই কর্মশালার গুরুত্ব অপরিসীম। বিভিন্ন পর্যায়ের এই কর্মশালায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, কৃষক প্রতিনিধি, সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্থানীয় ও আঞ্চলিক কৃষির সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং সেই আলোকে গবেষণা কার্যক্রম প্রণীত হয়। আঞ্চলিক গবেষণা পর্যালোচনা অঞ্চলভিত্তিক হয়। অভ্যন্তরীণ ও কেন্দ্রীয় গবেষণা পর্যালোচনা হয় বারি সদর দফতরে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত ২১২ ফসলের ৫৫৮ উচ্চ ফলনশীল (হাইব্রিড)সহ, রোগ প্রতিরোধক্ষম ও বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশ প্রতিরোধী জাত এবং ৫২৪ অন্যান্য প্রযুক্তিসহ (২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত) মোট ১,০৮২ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে এবং বর্তমানে ২০৭ ফসলের ওপর গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ২০০৯ থেকে ’১৯ পর্যন্ত ২৪৪ উচ্চ ফলনশীল উন্নত জাত ও হাইব্রিড এবং ২৫০টি উন্নত ফসল ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এ সকল প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে দেশে তেলবীজ, ডালশস্য, আলু, গম, সবজি, মসলা এবং ফল ফসলের উৎপাদন ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব প্রযুক্তির উপযোগিতা যাচাই-বাছাই ও দেশের বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কর্মসূচী গ্রহণ করাই এ কর্মশালার প্রধান উদ্দেশ্য। এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী বলেন, কৃষিবিজ্ঞানীদের নব নব এই আবিষ্কারের ফলেই আজ কৃষির সাফল্য বিশ্ব স্বীকৃত। তারা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কৃষিকে সমৃদ্ধ করেছেন। সেই সঙ্গে দেশে খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা মেটাতে অনন্য ভূমিকা রাখছে। কৃষিতে ভাল ফলের কারণেই দেশরতœ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘সেরেস’ পদক পেয়েছেন। কৃষিমন্ত্রী বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আমরা জাতির কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম বাংলাদেশকে আমরা অন্তত দানা জাতীয় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করব, দারিদ্র্য কমিয়ে নিয়ে আসব। ’১৫ সালের মধ্যেই আমরা দানা জাতীয় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। আপনারা জানেন এই বছর আমাদের ধান উদ্বৃত্ত। কৃষকরা তাদের ধান বিক্রি করতে পারছে না। ধানের দাম অস্বাভাবিক কম এবং আমরা অনেক চেষ্টা করেও ধানের দাম বাড়াতে পারছি না। এটা আজ সবাই চাচ্ছে কৃষিকে লাভজনক করতে হবে। কৃষি যদি লাভজনক না হয় চাষীরা চাষ করবে কেন? এই ধান বিক্রি করে তাদের ছেলেমেয়ের লেখাপড়াসহ সংসারের অন্যান্য খরচ চালাতে হয়। কাজেই কৃষিকে আমাদের বহুমুখীকরণ করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের শুধু ধানের ওপর নির্ভরশীল হলে হবে না। অন্যান্য ফসল, ফলমূল, সবজিÑ এগুলো আমাদের করতে হবে। আমরা দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। এখন আমাদের পুষ্টিজাতীয় নিরাপদ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। এই বিবেচনায় আমরা শাক-সবজির উৎপাদন বৃদ্ধি করেছি। ধান বা বিভিন্ন ফসল শুধু বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করলে হবে না। এটাকে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করতে হবে। ফলমূল, শাক-সবজির মতো উচ্চমূল্যের ফসল আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানির অনেক সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এটাকে রফতানি করতে পারে না। কারণ আমাদের এক্রিডেটেড ল্যাব নেই। তাই তারা মনে করে এগুলো নিরাপদ না। বিভিন্ন দেশকে বোঝাতে হবে আমাদের এখান থেকে যেসব পণ্য রফতানি হবে সেগুলো নিরাপদ। তাই বারিতে আমরা আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব করার চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট গ্রীষ্মকালীন টমেটোর জাত উদ্ভাবন করেছে। এটা চাষ করে একজন চাষী এক বিঘা জমিতে মাত্র ১৮ দিনে ১ লাখ টাকা লাভ করেছে। তাই আমি বলব যারা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক পাচার করে, ক্যাসিনো ব্যবসা করে এসব ছেড়ে যদি তারা এই টমেটো চাষ করে বিদেশে রফতানি করে তাহলে ক্যাসিনোর চেয়ে বেশি টাকা আয় করতে পারবে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. আবুল কালাম আযাদের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন এমপি ও কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য কৃষিবিদ আব্দুল মান্নান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ নাসিরুজ্জামান। অনুষ্ঠানে সম্মানিত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএআরআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক (অব) ও ইমেরিটাস সায়েন্টিস্ট, এনএআরএস, ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা কার্যক্রম, সাফল্য ও ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনার ওপর সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা করেন বারির পরিচালক (গবেষণা) ড. আব্দুল ওহাব ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন পরিচালক (সেবা ও সরবরাহ) ড. বাবুলাল নাগ। কর্মশালার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বারির অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালকবৃন্দ, পরিচালকবৃন্দ, মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাবৃন্দ, বারির স্টেকহোল্ডার তথা পলিসিমেকার, জনপ্রতিনিধি, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, নার্সভুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিএডিসি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সরকারী প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও কৃষিসংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এবং বারির বিভিন্ন বিভাগের বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।
×