ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দীপের কথা মনে নেই কারও

বুয়েটে নিভে যাওয়া আরেক প্রাণ আজ বিস্মৃতির অতল গহ্বরে

প্রকাশিত: ১১:২৮, ১৩ অক্টোবর ২০১৯

 বুয়েটে নিভে যাওয়া আরেক প্রাণ আজ বিস্মৃতির  অতল গহ্বরে

মোরসালিন মিজান ॥ আবরারের নির্মম মৃত্যু, বলার অপেক্ষা রাখে না, মানবিক মানুষের হৃদয়কে বিদীর্ণ করেছে। অভিযোগের আঙ্গুল যাদের দিকে তাদের প্রায় সকলেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ইতোমধ্যে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এর পরও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ উষ্ণ। মোটামুটি সব মত-পথের মানুষ এক প্ল্যাটফর্মে সমবেত হয়েছেন। প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছেন তারা। এই প্রতিবাদ এই শোক মনে করিয়ে দিচ্ছে আরও একটি মৃত্যুর কথা। বহুদিন ভুলে থাকা নামটি আরিফ রায়হান দীপ। বুয়েটের এই দ্বীপ শিখাটিও নিভে গেছে। অসময়ে নিভিয়ে দেয়া হয়েছিল। মৌলবাদী রাজনীতির বলি হয়েছিল তরুণ তাজা প্রাণ। এর পর বিস্মৃতির অতল গহ্বরে যেন হারিয়ে যায় নামটি। সেদিনের কথা আজ আর কারও মনে পড়ে না। ২০১৩ সালের ঘটনা। ২০১৯ -এ এসে জানা যাচ্ছে, কোন বিচার হয়নি! সন্তানহারা বাবা মা কোথায় আছেন, কেমন আছেন, বেঁচে আছেন কিনাÑ কেউ জানে না। জানার প্রয়োজনও হয় না। তবে কী ভুলে যাওয়াই নিয়ম? এভাবেই হারিয়ে যাবে দীপরা? নতুন করে সামনে এসেছে এসব প্রশ্ন। জানা যায়, গত ছয় বছরের মধ্যে নিহত দীপের বন্ধুরা লেখাপড়া শেষ করেছেন। প্রবেশ করেছেন কর্মজীবনে। কত দামী দামী চাকরি! বাবা মা স্ত্রী সন্তান নিয়ে অনেকেই বেশ ভাল আছেন। দীপ শুধু হারিয়ে গেছে! সকালে ঘুম থেকে ওঠে অফিসে যাওয়া তাড়া নেই। স্ত্রী সন্তান হয়নি। শুরুর আগেই সব শেষ হয়ে গেছে তার! অপরাধ? মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ। স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী গোষ্ঠীর অপতৎপরতার বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ ছিল যারপরনাই সোচ্চার। এ কারণেই আর বলতে দেয়া হয়নি তাকে। বুয়েটের হলে ঢুকে দীপকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে জঙ্গী রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী। দীর্ঘ তিন মাস কোমায় ছিলেন দীপ। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে স্বজনরা কেঁদেছেন। সহপাঠীরা অশ্রুসজল চোখে অপেক্ষা করেছেন। তবুও ফিরে আসতে পারেননি দীপ। অধরা স্বপ্ন নিয়ে যথেষ্ট নীরবে চিরবিদায় নেন তিনি। নিহত দীপের সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি ছিলেন বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। শুধু লেখাপড়া নয়, প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির চর্চা করতেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে অহর্নিশ লড়ে অভ্যস্থ ছিলেন। একাত্তরের ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যত কর্মসূচী, দীপকে সেখানে ঠিক দেখা গেছে। একই দাবিতে ২০১৩ সালে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। ইতিহাস সৃষ্টি করা আন্দোলনের একেবারে গোড়ার দিকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন দীপ। ওই বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি মিরপুরের কসাইখ্যাত কাদের মোল্লার মামলার রায় ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ভয়ঙ্কর অপরাধীকে দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদ-। এমন রায়ে কেউ ক্ষুব্ধ। কেউ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কিন্তু দীপ বড় প্রতিবাদের চিন্তা থেকে শাহবাগের দিকে ছুটে যান। সহযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রাথমিক প্রতিবাদে যোগ দেন তিনি। কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবিতে তখন মানববন্ধন চলছিল। অংশগ্রহণকারীর অনেকেই জানেন না, কার কী কাজ। দীপ তৎক্ষণাত নিজের করণীয় ঠিক করে ফেলেন। রঙিন কাগজ আর মোটাকালির কলম হাতে রাজপথে বসে পড়েন তিনি। একের পর এক প্রতিবাদী পোস্টার লিখে যান। সে সময়ের একটি ছবিতেও দৃশ্যটি ধরা পড়ে। তাতে দেখা যায়, গভীর মনোযোগ দিয়ে প্রতিবাদী স্লোগান লিখছেন দীপ। তার লেখা পোস্টার, প্ল্যাকার্ড হাতে অনেকেই সেদিন জাতীয় জাদুঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। দীপ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে দিনের পর দিন শাহবাগে মিছিল করেছেন। তার পর ফিরে গেছেন প্রিয় ক্যাম্পাসে। তার সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তখন বুয়েটে স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী আরও বেশি তৎপর ছিল। তবুও ভীত বা পিছপা হননি দীপ। বিশেষ করে নিজের ক্যাম্পাসে আক্রমণের শিকার হওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারেননি তিনি। অথচ নিজের হলের ভেতরে নির্মম নিষ্ঠুর আক্রমণের শিকার হন। বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী তন্ময় জামান জানান, কবি নজরুল ইসলাম হলের ২২৪নং কক্ষের আবাসিক ছাত্র ছিলেন দীপ। ৯ এপ্রিল সকাল সাড়ে এগারোটার দিকে তার সে কক্ষে চাপাতিসহ ঢুকে পড়ে খুনী। চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ফেলে রেখে যায় তাকে। সেদিন দীপের রক্তে হলের মেঝে ভেসে গিয়েছিল। মাথা থেঁতলে দেয়া হয়েছিল তার। চোখে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। দীপের পিঠে ছিল ৫০টির বেশি কোপের চিহ্ন। স্কয়ার হাসপাতালে তিন মাস অচেতন অবস্থায় পড়েছিলেন তিনি। কোমায় থাকা দীপের ধারে কাছেই ছিলেন প্রিয় বাবা-মা। বন্ধু। স্বজন। কারও দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেননি তিনি। কথা বলতে পারেনি। একটি পোস্টারে দীপ লিখেছিলেন: এই পথে জীবন দেব। জীবন তাকে দিতেই হয়েছিল শেষতক। স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী রাজনীতির বলি হতে হয়েছিল তাকে। পুলিশ সূত্র জানায়, আক্রমণের দিন ঘটনাস্থল থেকে একটি ব্যাগ উদ্ধার করেন তারা। ব্যাগের ভেতরে একটি চাপাতি ও পাঞ্জাবি, পায়জামা পাওয়া যায়। এ ঘটনায় জড়িত মেজবাহউদ্দীন নামে বুয়েটেরই আরেক ছাত্রকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। স্থাপত্য প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মৌলবাদী রাজনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে স্বীকার করেন। অথচ বিচার হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে খুনী জামিন নিয়ে দিব্যি আছেন। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় দীপের আরেক সহপাঠী বন্ধু তন্ময় আহমেদের সঙ্গে। একই আদর্শের হওয়ায় তিনিও পরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সে অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা জনকণ্ঠকে বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানে ঘাঁটি গেড়েছে স্বাধীনতা বিরোধী জামাত শিবির। গোপনে জঙ্গী তৎপরতাও চলে। আমাদের সময় এ তৎপরতা অনেক বেশি ছিল। জীবনের রিস্ক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে কাজ করতে হয়েছে। জঙ্গী তৎপরতায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা। এ কারণে প্রথমে দীপ আক্রান্ত হয়। পরে আমি নিজেও চাপাতির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছি। তন্ময় বলেন, কিছুদিন আগে বুয়েটে যে ঘটনা ঘটেছে তার প্রতিবাদ হচ্ছে। এখনও আমরা সম্মিলিত প্রতিবাদ দেখছি। এই প্রতিবাদের প্রয়োজন আছে। এমন মৃত্যু কারও কাম্য হতে পারে না। পরের কথাগুলো বলার সময় বেদনাহত মনে হয় তাকে। অনুযোগের সুরে তন্ময় বলেন, দীপকে কী যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল! কেউ সেদিন খোঁজ নেননি। বুয়েটের শিক্ষক সমিতি কিংবা এলামনাই এ্যাসোসিয়েশনও প্রতিবাদ জানায়নি ঘটনার। বুদ্ধিজীরা নীরব ছিলেন। এসব কারণে আজও দীপ হত্যার বিচার হয়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
×