ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জুয়ায় টালমাটাল ক্রীড়াঙ্গন

প্রকাশিত: ১১:১৫, ১৩ অক্টোবর ২০১৯

জুয়ায় টালমাটাল ক্রীড়াঙ্গন

মজিবর রহমান ॥ খেলাধুলা মানুষকে বাঁচতে শেখায়। নৈতিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা করে যুব সমাজকে। জীবনের প্রতিকূল পরিবেশে অদম্য লডাইয়ের অনুপ্রেরণা জোগায় খেলাধুলা। সাধারণ মানুষের নির্মল আনন্দ উপভোগের সেরা মাধ্যম হচ্ছে ক্রীড়াঙ্গন। আর এই সুন্দর জগতটা যদি হয়ে ওঠে জুয়াড়ি, গু-া, মাস্তান ও খুনীদের আখড়া তাহলে জাতির ভবিষ্যত কি হতে পারে চিন্তা করলে যে কারও শিউরে ওঠার কথা। হ্যাঁ-বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে এখন এই চিত্রই দৃশ্যমান। বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য এটা বড় একটা ধাক্কা, হুমকি ও চ্যালেঞ্জ। এক কথায় কঠিন সময়ের মধ্যে পড়ে গেছে খেলাধুলার জগত। রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টার আলোকিত লাসভেগাস সিটিখ্যাত মতিঝিল ক্লাবপাড়ায় এখন শ্মশানের নীরবতা। ফুটবলারদের দলবদল চলছে। ঘর গোছানোর এই কার্যক্রমে নেই মোহামেডান, মুক্তিযোদ্ধা কেসি ও আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ। অন্যান্য ক্লাবেও পড়েছে এর প্রভাব। এই অবস্থা থেকে কবে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরবে ক্লাবপাড়া কেউ বলতে পারে না। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। এ নিয়ে ক্রীড়াপ্রেমীদের দ্বিমত থাকার কথা নয়। ফুটবলের বিশ্বকাপ সামনে এলে গোটা বাংলাদেশ যেন ব্রাজিল-আর্জেন্টিনায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। বাড়ি-ঘরের রং দেখলে মনে হয় দেশটাই যেন বিস্তীর্ণ আকাশি-হলুদের সাম্রাজ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত জার্মানরা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল এই ফুটবলের হাত ধরে। ১৯৫৪ বিশ্বকাপে হাঙ্গেরিকে হারানোর গল্প জার্মানিতে রূপকথারই শামিল। ক্রোয়েশিয়া আর লুকা মডরিচদের গল্পও রূপকথার থেকে কম নয়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত এই দেশটিকেও মানুষ চেনে ফুটবলের গৌরবময় সাফল্যে। যদিও বাংলাদেশের খেলাধুলার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশেষ করে ফুটবলে। বিশ্বের বড় বড় লীগের ক্লাবগুলো পরিচালিত হয় মোটা অঙ্কের স্পন্সরের অর্থে। ক্লাবগুলো কোটি কোটি ডলার খরচ করে দল গঠনের পরও আর্থিকভাবে লাভবান। হাউজি, তাস বা ক্যাসিনো জুয়ার ওপর মোটেও নির্ভরশীল নয় ম্যানচস্টোর সিটি, লিভারপুল, বার্সিলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাস, পিএসজি ও বেয়ার্ন মিউনিখের মতো আরও অনেক বিশ্বনন্দিত ইউরোপিয়ান ক্লাব। আর সেখানে এ ধরনের পরিবেশও নেই। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবল দলগুলোর সেরকম স্পন্সর নেই। এমন কি সরকারের পক্ষ থেকেও দল পরিচালনায় ক্লাবগুলোকে বাৎসরিক কোন অনুদান দেয়া হয় না। ফলে লাভ দূরের কথা। ফুটবলারদের দলবদল সামনে এলেই দল গঠনে টাকার জন্য মাথা খারাপ হয়ে যায় ক্লাব কর্মকর্তাদের। গলদঘর্ম হতে হয় অর্থ সংগ্রহে। এদেশে সংগঠক, পরিচালকদের দেয়া ডোনেশনে পরিচালিত হয় ঢাকার ছোট বড় সব ক্লাব। জৌলুস হারালেও কদর, পারিশ্রমিক মোটেও কমেনি ফুটবলারদের। বরং দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এক মৌসুমের জন্যই কোটি কোটি টাকা খরচ করে দল গঠন করে থাকে শিরোপা প্রত্যাশী ক্লাবগুলো। ব্যত্যয় ঘটছে না এবারও। পহেলা অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে নতুন মৌসুমের দলবদল। জার্সি বদলের কার্যক্রমে পছন্দের ফুটবলার দলে ভিড়াতে আটঘাঁট বেঁধেই মাঠে নেমে পড়েছে অনেক দল। রাষ্ট্রের যেমন বাজেট থাকে ঢাকার প্রায় প্রতিটি ক্লাবেরও একটা বাৎসরিক বাজেট করা হয়। এই বাজেটটা হয়ে থাকে ফুটবল সামনে রেখে। ফুটবল দল গঠনে কত টাকা খরচ হবে সেটাই বাজেটে প্রাধান্য পায় সবার আগে। তারপর ক্রিকেট ও হকি। উল্লেখ্য, ঢাকার ছোট বড় বেশিরভাগ ক্লাবই এই তিনটি খেলায় নিয়মিত অংশ নিয়ে থাকে। যদিও ঘরোয়া ফুটবলের সর্বোচ্চ আসর পেশাদার লীগের দলবদলে এখনও মাঠে নেই এক সময়কার ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবের সঙ্গে মাঝারি সারির মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেসি ও আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে (বিপিএল) বা পেশাদার লীগে খেলে এই তিন ক্লাব। এর মধ্যে নাম-ডাকে মোহামেডান অনেক এগিয়ে। কিন্তু দল হিসেবে বিগত প্রায় এক দশক ধরে ‘লেজেগোবরে’। শিরোপার ধারে কাছে যাওয়া দূরে। টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে দেখা যায় জনপ্রিয় দল মোহামেডানকে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে কোনক্রমে অবনমন (রেলিগেশন) ঠেকাতে পারলেই যেন খুশি ক্লাবের নীতিনির্ধারকরা। তবে ময়দানি লড়াইয়ে না পারলেও। একদিক দিয়ে এই দলটি চ্যাম্পিয়ন রেসে ছিল কিছুদিন আগেও। আর সেটা হচ্ছে জুয়া-ক্যাসিনো খেলায়। দলের ’ওয়ান ম্যান শো’ পরিচালক লোকমান হোসেন ভুইয়া ও তার দোসররা মোহামেডান ক্লাবকে খেলার মাঠ থেকে ক্যাসিনো শিরোপা দৌড়ে নিয়ে এসে এখন মাসুল দিচ্ছে শ্রীঘরকে ঠিকানা বানিয়ে। মোহামেডান তথা জাতীয় দলের সাবেক তারকা ফুটবলার গোলাম সরোয়ার টিপু সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বলছিলেন, আপনারা বারবার একটি শব্দ উচ্চারণ করছেন ’ঐতিহ্যবাহী’। আরে ভাই মোহামেডানের তো এখন ঐতিহ্যই নেই। আমি যখন এই ক্লাবের খেলোয়াড় ছিলাম তখন তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। শিরোপার জন্যই তখন মাঠে নামতো মোহামেডান। তখন এটা ছিল ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। এখন তো দেখছি মদখোর, জুয়াড়িদের দখলে চলে গেছে ক্লাব। খেলার পরিবর্তে দলটি কিছু লোকের পকেট ভারির কারখানা হয়ে গেছে। মিডিয়ায় যা দেখছি তাতে একজন ফুটবলার হিসেবে আমি কষ্ট পাচ্ছি মোহামেডান ক্লাবে ন্যক্কারজনক এই কর্মকা- দেখে। ক্যাসিনো চালিয়ে লোকমান কোটি কোটি টাকা আয় করেছে, যার বেশিরভাগ বিদেশে পাচার করে দিয়েছে যা এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। তার মতো আরও অনেক ’ক্যাসিনো রথিমহারথী’ মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় রয়েছে। তাদের অনেকে র‌্যাবের ঝটিকা অভিযানে ধরা পড়ে এখন মামলার কাঠগড়ায় রিমান্ডে রয়েছে। অনেকে পালিয়ে গেছে বিদেশে। এটা ফুটবলের ওপর প্রভাব ফেলবে কিনা জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ জনকণ্ঠকে জানান, এখনও যথেষ্ট সময় আছে। দলবদল কার্যক্রম ২০ নবেম্বর পর্যন্ত চলবে। এ সময়ের মধ্যে কেউ না কেউ হয়ত এই দলগুলোর হাল ধরবে। আশা করি বিপিএলের ১৩ দলের মধ্যে এই তিনটি ক্লাবও থাকবে। যদিও এ নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। কারণ বাকি প্রায় সব দলই প্রতিদিন কাউকে না কাউকে দলভুক্ত করছে, দলবদলে অংশ নিচ্ছে। শিরোপা প্রত্যাশী দলগুলোর মধ্যে ফুটবলার দলভুক্ত করার প্রতিযোগিতা বেশ ভালভাবেই চলছে। কাজেই বিপিএল আয়োজন নিয়ে মনে হয় না কোন ঝামেলা হবে। বিপিএল ম্যানেজমেন্ট কমিটিও ওই তিন ক্লাব নিয়ে কোন চিন্তা করছে না। সোহাগ আরও যোগ করেন, যে ক্লাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো চ্যাম্পিয়ন ফাইটের টিম নয়। এমনকি মোহামেডানও। কাজেই অবশিষ্ট দশটি ক্লাব তাদের পছন্দের খেলোয়াড় তাঁবুতে নেয়ার পর যারা বাকি থাকবে তাদের নিয়ে দল বানাতে পারে মোহামেডান, মুক্তিযোদ্ধা ও আরামবাগ। র‌্যাবের সিলগালা লাগানো ইয়ংমেন্স ফকিরেরপুল, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া, দিলকুশাসহ আরও যেসব ক্লাব আছে সেগুলে পেশাদার লীগের (বিপিএল) দল নয়। নিচের দিকের লীগের দল। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত নয় এমন ক্লাবগুলো দলবদলে ইতোমধ্যে মাঠে নেমে পড়েছে। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংস, রাপনার্সআপ ঢাকা আবাহনীর সঙ্গে শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র, শেখ জামাল ধানম-ি ক্লাব, চট্টগ্রাম আবাহনী ও সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবের মতো প্রতিষ্ঠিত দলগুলো বর্তমানে পরিণত দল গঠনে ব্যস্ত আসন্ন মৌসুমের জন্য। এসব ক্লাবের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত সমাজবিরোধী কোন কর্মকা-ের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। ভদ্রলোকের ক্লাব হিসেবেই অতীতের মতো এখনও সুপরিচিত। কাজেই বিপিএল ফুটবল নিয়ে শঙ্কার কোন কারণ দেখছেন না ফুটবল সংশ্লিষ্ট ক্রীড়া সংগঠকরা। এমনটি দেশের ফুটবলের ভাগ্য নিয়ন্তা বাফুফেও। ক্লাবপাড়ার অতীত-বর্তমান ॥ এক সময় হাউজি ও কার্ড রুম থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে অনেক ক্লাব খরচের একটা অংশ বহন করত। হাউজি এখনও অনেক ক্লাবে চলছে। এটাকে জুয়ার আওতায় দেখতে নারাজ অনেকে। নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক শীর্ষ ক্লাব কর্মকর্তা বললেন, হাউজি থেকে আসা অর্থে প্লেয়ারদের বড়জোর চা নাস্তার খরচ বহন করা যায়। মূলত ক্রীড়ামনা ডোনারদের দেয়া অর্থেই পরিচালিত হয় ক্লাব। সন্ধ্যার পর শুরু হওয়া হাউজিতে তো আমাদের ক্লাবের খেলোয়াড়রাও অংশ নিয়ে থাকে। এটা নিছক সময় কাটানো বিনোদনের পর্যায়ে পড়ে। আমি একে জুয়া হিসেবে মানতে রাজি নই। তবে এখন তো অনেক কিছুই দেখছি। থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ার পর জানতে পারলাম, অনেক ক্লাবই আমাদের চেয়ে অনেকগুণ সাবলম্বী। ক্যাসিনো চালিয়ে দিনে আয় করছে কোটি কোটি টাকা। এই ক্লাবগুলো ইচ্ছে করলে প্রতি বছর সেরা দল গঠন করতে পারত। ক্লাবের শোকেস ভরে ফেলতে পারত ট্রফি দিয়ে। কই সেটা তো দেখছি না। ময়দানি লড়াইয়ে তারা লবডঙ্কা। দল বানানোরই নাকি টাকা নেই। তাহলে ক্লাবের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে অর্জিত এই বিপুল পরিমাণ অর্থ যায় কোথায়? যদিও এটা এখন দিবালোকের মতো পরিষ্কার। ক্লাবের নাম, টেস্টে জায়গা দখল করে মাঠের খেলা নয়, ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল ছিল মূল লক্ষ্য। এরশাদ সরকারের শাসনামলে খেলার পরিবেশ ও অবকাঠমো নির্মাণের লক্ষ্যে পল্টন ময়দানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার ক্লাবগুলোকে জায়গা দেয়া হয় মতিঝিল সংলগ্ন ফকিরেরপুল ও আরামবাগের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া বিশাল খাল ভরাট করে। যা বর্তমানে কালভার্ট রোড হিসেবে চিহ্নিত। মোহামেডান, ওয়ারী, ভিক্টোরিয়া, আজাদ, ওয়ান্ডরার্স, দিলকুশাকে এখানে ক্লাব নির্মাণের জায়গা দেয়ার পর স্থানীয় ইয়ংমেন্স ফকিরেরপুল, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ ও মেরিনার ইয়ংসও যোগ হয় এই কাতারে। ঢাকা বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার কার্যালয় এই ক্লাবপাড়ায়। ফিফার অর্থে নির্মিত সু-সজ্জিত, অত্যাধুনিক বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ভবনও এই ক্লাবপাড়ায়। সাবেক ফুটবলারদের সোনালি অতীত ক্লাবের ঠিকানা এখানে। এরশাদ সরকারের পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় এলে ক্লাবপাড়া ধীরে ধীরে পরিণত হয় জুয়ার আখড়ায়। যা ফকিরেরপুল-আরামবাগ এলাকাবাসীর গলার ফাঁস হিসেবে পরিণত হয়। গু-া, মাস্তান, জুয়াড়ি, ছ্যাচড়া ছিনতাইকারীর অভয়ারণ্যে পরিণত হয় গোটা এলাকা। ফলে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে এই দুই এলাকার নিরীহ মানুষ। শুধু তাই নয়। গোটা মতিঝিলই চাঁদাবাজদের দখলে চলে যায়। দিনে-দুপুরে ছিনতাই ছিল এখানকার নিত্য ঘটনা। সাধারণ পথচারী থেকে অফিস ফেরত মানুষও রেহাই পেতেন না। নিারাপত্তার চরম অবনতি ঘটায় এক পর্যায়ে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামতে বাধ্য হন ক্লাবপাড়া সংলগ্ন দুই এলাকার হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও তরুণরা। মতিঝিল থেকে ক্লাবপাড়া সরানোর দাবিতে দিনের পর দিন সভা, মিছিল এমনকি মানববন্ধন করেও বিএনপি সরকারের মন গলাতে পারেননি স্থানীয় জনগণ। ফলে আবাসিক ও রাজধানীর ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকা থেকে উচ্ছেদ হয়নি ওই সময়কার ’কিলিং জোন’ খ্যাত এই ক্লাবপাড়া। সরকার পরিবর্তনের পাশাপাশি ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে ক্লাবের কর্তৃত্বের। এখানকার সবচেয়ে এলিট ক্লাব নিঃসন্দেহে মোহামেডান। বাকিগুলোর মধ্যে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ ছাড়া সবই ঘরোয়া ফুটবলের নিচু সারির দল। এরশাদের শাসনামল পর্যন্ত ঐতিহ্য ধরে রেখেছিল মোহামেডান। বেশ দাপটের সঙ্গে সমকক্ষ দলগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফুটবল, ক্রিকেট ও হকিতে মাঠে নামত শিরোপার জন্য। ওই সময় আর্থিক দিক দিয়ে সবচেয়ে মজবুত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল মোহামেডান। এক কথায় অর্থের কোন অভাব ছিল না। সেটা জুয়ার মাধ্যমে নয়। অনেকটা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায়। এরশাদের ধর্মমন্ত্রী প্রয়াত মওলানা মান্নান ছিলেন ক্লাবের গবর্নিংবডির চেয়ারম্যান। এরশাদের আরেক প্রভাবশালী মন্ত্রী শফিকুল গনি স্বপন ও তৎকালীন ঢাকার মেয়র কর্নেল মালেকও সম্পৃক্ত ছিলেন মোহামেডানের সঙ্গে। এরশাদ সরকারের পতনের পর বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত লোকজনের দখলে চলে যায় এক কালের সাড়া জাগানো, লাখ লাখ সমর্থকপুষ্ট মোহামেডান ক্লাব। এরপর থেকেই অবনতি শুরু। ধীরে ধীরে বর্তমানে খাদের কিনারায়। গত মৌসুমে কোনক্রমে রেলিগেশন ঠেকিয়ে বিপিএলে টিকে আছে ২১ বারের লীগ চ্যাম্পিয়নরা। পতনের প্রধান রূপকার ক্যাসিনো মালিকদের একজন লোকমান হোসেন ভুইয়া। তার গ্রেফতারের মধ্যে পরিষ্কার হয় কেন এই বেহাল অবস্থা মোহামেডানের। উল্লেখ্য, এরশাদের মন্ত্রীরা জড়িত থাকায় টেন্ট নির্মাণে ক্লাব পাড়ায় সবচেয়ে বেশি জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয় মোহামেডানকে। মোহামেডানের হাউজি-জুয়ার ঘরটার সমান জায়গা অনেক ক্লাবের নেই। সর্বশেষ বিএনপির শাসনামলে লোকমানগংরা দায়িত্ব নেয় মোহামেডানের। তারপর তাদের একের পর এক অপকর্ম দেখে মোহামেডান ক্লাব থেকে সরে দাঁড়ান অনেক সৎ, নিষ্ঠাবান যোগ্য সংগঠক। আবার অনেকে লোকমানদের রোষানালের শিকার হয়ে বাধ্য হন ক্লাব ছাড়তে। তারেক রহমানের আশীর্বাদ নিয়ে লোকমানরা একক রাজত্ব কায়েমের পরই জৌলুস হারাতে শুরু করে মোহামেডান। ময়দানের খেলায় মনোযোগ না দিয়ে তারা শুরু করে আখের গোছানোর জুয়া প্রতিযোগিতা। জুয়া নিয়ে খুনের ঘটনা ॥ বাংলাদেশে আধুনিক ক্যাসিনো জুয়া শুরুর আগে মোহামেডন ক্লাবেই সর্বপ্রথম শুরু হয় ’ওয়ান টেন’। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে প্রায় সব ক্লাবেই ’ওয়ান টেন’ চালু হয়। এই জুয়াবাণিজ্যও ক্যাসিনোর চেয়ে কম বড় নয়। ’ওয়ান টেন’ কি ধরনের জুয়া এটা কমবেশি সবারই জানা। এটা হচ্ছে চোখের সামনে নাম্বার উল্লেখ করা গোলাকৃতির বিশাল বোর্ড চরকার মতো ঘুরতে থাকে। আর নির্ধারিত সীমানা থেকে এই বোর্ডে ছোট তীর ছোড়া হয় হাত দিয়ে। এই তীর যে নাম্বারে গিয়ে বিঁধবে ভাগ্যবান সেই নাম্বারে টাকা দেবে জমাকারীরা। অন্য নাম্বারে যারা টাকা জমা দেয় তারা দুর্ভাগা। এই টাকা চলে যায় ’ওয়ান টেন’ মালিকের হাতে। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত কোটি কোটি টাকার ’ওয়ান টেন’ খেলা হতো ক্লাবপাড়ায়। এই ’ওয়ান টেন’ নিয়ন্ত্রণ করতো তারেক রহমানের ক্যাডাররা। এই জুয়ার টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে অনেক খুন-খারাবির ঘটনা ঘটে এখানে। আরামবাগ ক্লাবেই খুন হয় দু’জন। তারা হচ্ছে ক্লাবের তৎকালীন ফুটবল কমিটির সম্পাদক রাসেল আহমেদ খোকন ও জুয়াড়ি ভুলু। ক্লাবের ভেতরে খোকন ও ভুলু খুন হওয়ার সময় তাদের প্রতিপক্ষের এলোপাতাড়ি গুলিতে গুরুতর আহত হয় অনেকে। গুলির আঘাতে এক পা পঙ্গু অবস্থায় কয়েক বছর পর মারা যায় খোকনের বন্ধু দুলাল। মতিঝিল ক্লাবপাড়ার বাইরেও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে গোপীবাগের ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবে খুন হয় স্থানীয় বিএনপি নেতা আসলাম। সাবেক জাতীয় ফুটবলার খায়রুল আনোয়ার পেয়ারু খুন হয়েছিলেন ধানম-ি ক্লাবে। এই ক্লাবের সভাপতি ছিলেন তিনি। ভাল কাজ করতে গিয়ে পেয়ারু খুন হওয়ার ঘটনা অবশ্য মর্মান্তিক। তাকে হত্যা করা হয় ধানম-ি ক্লাব থেকে মাদক ব্যবসা ও জুয়া উচ্ছেদের উদ্যোগ নেয়ায়। ধানম-ি ক্লাবের সন্ত্রাসীরাই ভারাটে খুনী দিয়ে পেয়ারুকে হত্যা করে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। পেয়ারু জীবন দিয়ে না পারলেও পরবর্তীতে তার শুভাকাক্সক্ষীরা ঠিকই ধানম-ি ক্লাব থেকে সব ধরনের অসামাজিক কর্মকা- উচ্ছেদ করতে সক্ষম হয়েছেন। ক্রীড়া সংগঠক মনজুর কাদেরের হস্তক্ষেপে জুয়াড়ি, মাদক বিক্রেতা, নেশাখোররা ক্লাব ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ক্লাবের নামও পরিবর্তন করেন ঢাকা আবাহনীর সফল ফুটবল ম্যানেজার মনজুর কাদের। এটা এখন শেখ জামাল ধানম-ি ক্লাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ফুটবলে দেশে-বিদেশে একাধিক শিরোপা জেতা শেখ জামাল ধানম-ি এখন অনেক ক্লাবের ‘আইডল’। ক্লাবের বিশাল মাঠও ছিল বেদখল। সন্ধ্যা নামলেই এই মাঠ পরিণত হতো নেশাখোর ও ভাসমান পতিতাদের অভয়ারণ্যে। এসব অবর্জনাও দক্ষতার সঙ্গে উচ্ছেদ করে নির্মাণ করা হয় শেখ কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্স। এই ক্লাবের চার দেয়ালের মাঝে রয়েছে দেশের সবচেয়ে আধুনিক ফুটবল প্রাকটিস গ্রাউন্ড। ঢাকায় খেলতে আসা অনেক বিদেশী পুরুষ-মহিলা ফুটবল দল এই মাঠে অনুশীলন করে। এসব দলের কোচ, খেলোয়াড়রা ভূয়সী প্রশংসা করেন এই মাঠের। এখানে আরও আছে উন্নত জিমনেসিয়াম, ক্রিকেট প্রাকটিস বে’সহ সুইমিংপুল। অবৈধ জুয়া ছাড়াও চলছে ক্লাব ॥ শুধু শেখ জামাল নয়, এই ক্লাবের একটু দূরেই ঢাকা আবাহনী। শহীদ শেখ কামাল প্রতিষ্ঠিত এই ক্লাবে জন্মলগ্ন থেকেই মদ-জুয়ার বালাই নেই। দক্ষ সংগঠকদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকার ফুটবলে এখনও পর্যন্ত দাপটের সঙ্গে খেলে যাচ্ছে ’ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের’ প্রতীক আবাহনী। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংস, শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র, শেখ জামাল ধানম-ি ক্লাব, চট্টগ্রাম আবাহনী ও সাইফ স্পোর্টিং ক্লাব চলছে কোন অবৈধ জুয়া ছাড়াই। ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান ক্লাবের দুরবস্থা ॥ পরিবেশ আর টাউট-বাটপারদের খপ্পড়ে পড়ে মোহামেডান ক্লাবের কোটি সমর্থকের হৃদয় ভেঙ্গে ধ্বংস হয়ে গেছে। স্বাধীনতার আগে মোহমেডানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা গেছে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবকে। স্বাধীনতার পর দুর্বল নেতৃত্বে খ্যাতি হারাতে থাকে এই ক্লাবটি। পরবর্তীতে মাদক ব্যবসা ও জুয়াড়িদের দখলে চলে যাওয়ায় এখন আর ঢাকার প্রথম শ্রেণীর ফুটবলে নাম গন্ধ নেই ওয়ান্ডারার্সের। ক্যাসিনো জুয়াড়িরাই বর্তমানে এক কালের সাড়া জাগানো এই ক্লাবের সর্বেসর্বা। ওয়ান্ডরার্স কালের গর্বে হারিয়ে গেলেও স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘদিন ঐতিহ্য ধরে রাখে মোহামেডান। স্বাধীন দেশে মোহামেডানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে আবাহনীর। দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াই হিসেবে খ্যাতি পায় মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচ। সেটা এখন ইতিহাস। লোকমান গংরা দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত ধারে-ভারে কোন অংশে আবাহনীর চেয়ে কম ছিল না মোহামেডান। বর্তমানে মোহামেডান আর ওয়ান্ডারার্সের মধ্যে বর্তমানে কোন পার্থক্য নেই। তবে খেলাধুলার পরিবেশ নষ্ট করা ক্যাসিনো বাণিজ্যে এই দুই ক্লাব যেন পরম বন্ধু। শত বছরের ঐতিহ্যে লালিত মোহামেডান সর্বশেষ কবে লীগ শিরোপা জিতেছে তা হয়তো ভুলেই গেছেন ক্রীড়াপ্রেমীরা। অথচ শক্তিশালী দল গড়ার জন্য টাকার কোন কমতি ছিল না। এক ক্যাসিনো থেকে অর্জিত আয়ের চারভাগের এক ভাগ টাকা যথেষ্ট ছিল চ্যাম্পিয়ন ফাইটের দল গড়তে। লোকমানরা ক্যাসিনো থেকে প্রাপ্ত আয়ের প্রায় পুরো টাকাই মেরে দিত। ভাগ-বাটোরা করে নিত নিজেদের মধ্যে। মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্র ॥ একই অবস্থা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের। অথচ নব্বইর দশকে এই মুক্তিযোদ্ধা কেসি ’ড্রিম টিম’ হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিল মনজুর কাদের দায়িত্ব নেয়ার পর। তৎকালীন আবাহনী, মোহামেডান ও ব্রাদার্স ইউনিয়নের ঘড় ভেঙ্গে একঝাঁক তারকা ফুটবলার নিয়ে মনজুর কাদের সেরা দলের রূপ দিয়েছিলেন সাদামাটা মুক্তিযোদ্ধাকে। দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালক করেছেন কিংবদন্তী ফুটবলার, বাফুফের বর্তমান সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। ওই সময়েই কাদেরের হাত ধরে ঘরোয়া ফুটবলে প্রথম শিরোপার স্বাদ নেয় এই দলটি। মনজুর কাদের দায়িত্ব ছাড়ার পরও মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের কর্মকর্তা শাহ আলম চৌধুরী ও জাহাঙ্গীর আলমের চেষ্টায় বেশ কয়েক বছর দাপটের সঙ্গে খেলে মুক্তিযোদ্ধা। এই স্মৃতি কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। শত বছরের পুরনো ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের মতো সাড়া জাগানো মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের অবস্থাও এখন একই রকম। তবে ব্যতিক্রম বলতে মুক্তিযোদ্ধা টিকে আছে মর্যাদার পেশাদার লীগে। ভিক্টোরিয়া কোন লীগে খেলে অনেকেই জানেন না। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেসির এই বেহাল দশার সঙ্গে অদ্ভুত মিল রয়েছে মোহামেডানের। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল সূত্রে জানা গেছে, যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী স¤্রাট বেশ কয়েক বছর আগে দখল করে নেয় গুলিস্তান সংলগ্ন ওসমানী উদ্যানে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব ট্যান্ট। এখান থেকেই স¤্রাট মাসে আয় করত কোটি কোটি টাকা। কিন্তু ক্লাবের পেছনে ব্যয় করত না আয়ের সিকিভাগও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুক্তিযোদ্ধা কামান্ড কাউন্সিলের ওই কর্মকর্তা বললেন, স¤্রাটের দাপটে আমরা ছিলাম অসহায়। প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না। ক্যাসিনো, মদ, জুয়ার ব্যবসা করে স¤্রাট কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। অথচ ভালমানের একটা ফুটবল দল গড়ার জন্য বছরে এক কোটি টাকাও ক্লাবকে দেয়নি স¤্রাট। ফলে জোড়াতালির দল নিয়েই খেলতে হচ্ছে। তিনি ইঙ্গিত করেন ক্লাব পরিচালনায় কমান্ড কাউন্সিলের যারা জড়িত তাদের মধ্যে কেউ কেউ স¤্রাটের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফায়দা নিতেন। তারাও বেশ লাভবান ক্লাবের ইতিহাসে ’ক্যাসিনো’ কলঙ্কের বদনাম চাপিয়ে দিয়ে। ইয়ংমেন্স ফকিরেরপুল ॥ মতিঝিল ক্লাব পাড়ায় যে কয়টি ক্লাব রয়েছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন, সুন্দর পরিবেশ ছিল ইয়ংমেন্স ফকিরেরপুলে। ২০০৮ সালে কাজী সালাউদ্দিন এই ক্লাবের সভাপতির আসনে বসে তার নির্বাচন কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন। ইয়ংমেন্সের কাউন্সিলর হিসেবেই তিনি ওই বছর মেজর জেনারেল (অব) আমিন আহমেদ চৌধুরীকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বাফুফের সভাপতি নির্বাচিত হন। তখন ইয়ংমেন্সের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মঞ্জুর হোসেন মালু। তিনিও বাফুফের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন সালাউদ্দিনের ’সমমনা প্যানেল’ থেকে। উল্লেখ্য মনজুর হোসেন মালু খ্যাতিমান ফুটবলার ছিলেন। অধিনায়ন ছিলেন ইয়ংমেন্সের। কাজী সালাউদ্দিনও এক সময় উপদেষ্টা প্রশিক্ষক ছিলেন এই ক্লাবের। ’ওয়ান টেন’ জুয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ক্লাব পাড়ায় হত্যা, মারামারি যখন চরম পর্যায়ে দায়িত্ব নেয় ওয়ান ইলেভেন সরকার। দায়িত্ব নেয়ার মাস দুই পরেই সব ক্লাবে একযোগে ঝটিকা অভিযান চালায় র‌্যাব। মূলত ’ওয়ান টেন’ নির্মূল করাই ছিল এই অভিযানের মূল লক্ষ্য। র‌্যাবের অভিযানে মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, আরামবাগ কেএস, দিলকুশা ও ওয়ান্ডরার্সসহ এখানকার প্রায় সব ক্লাবেই ’ওয়ান টেন’সহ নানা ধরনের জুয়া ধরা পড়ে। ব্যতিক্রম ছিল কেবল ইয়ংমেন্স ক্লাব। অপারেশন চালালেও এই ক্লাবে পাওয়া যায়নি অবৈধ কিছু। ফকিরেরপুল এলাকার ক্রীড়ামনা ব্যবসায়ী, স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অর্থে পরিচালিত হতো এই ক্লাব। সবচেয়ে বড় ডোনার ছিলেন মনজুর হোসেন মালু নিজেই। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মালুর তত্ত্বাবধানে পরিচ্ছন্ন ক্লাবের তকমাটা বহাল থাকলেও বেশিদিন টিকতে পারেননি তিনি। ক্লাব পাড়ার চিহ্নিত গু-া-মাস্তানরা রাতারাতি দখল করে নেয় ইয়ংমেন্স ক্লাব। মূলত এরপরই ইয়ংমেন্স হয়ে ওঠে জুয়াড়িদের ক্লাব হিসেবে। ক্লাবপাড়ার সবচেয়ে বড় ক্যাসিনো আসরটা ঠাঁই পায় এই ইয়ংমেন্সে, যার মূল হোতা ছিলেন নব্য যুবলীগ নেতা খালেদ ও সাব্বি হোসেন। মোহামেডান-মুক্তিযোদ্ধার মতো ইয়ংমেন্স ক্লাবও বঞ্চিত হয় ক্যাসিনো জুয়া থেকে অর্জিত কোটি কোটি টাকার আয় থেকে। গত মৌসুমে প্রিমিয়ার লীগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলেও নাম প্রত্যাহার করে নেয় এই ক্লাব টাকার অভাবে দল গড়তে না পারায়। নব্বই দশক পর্যন্ত তৎকালীন প্রথম বিভাগ পরবর্তীতে প্রিমিয়ার লীগে মাঝারি সারির দল হিসেবে সুনামের সঙ্গে খেলা ইয়ংমেন্স ক্লাব অনেক বড় বড় তারকা ফুটবলারের জন্ম দিয়েছে। তাদের মধ্যে মিডফিল্ডার নুরুল হক মানিক ফুটবলের স্বর্ণালি সময়ে মোহামেডান ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেছেন। সাবেক জাতীয় ফুটবলার ইমতিয়াজ সুলতান জনি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ইয়ংমেন্সে খেলে। মনিরুল ইসলাম মনু (প্রয়াত), হাসান আল মামুন, আমিন রানা, মনোয়ার হোসেনসহ অনেকেই এই ক্লাবে খেলে তারকা খ্যাতি পেয়েছিলেন। ছিলেন জাতীয় দলের নিয়মিত খেলোয়াড়। প্রয়াত ক্রীড়া সাংবাদিক অজয় বড়ুয়া দীর্ঘদিন ইয়ংমেন্সে ফুটবল খেলে সুযোগ পেয়েছিলেন আবাহনীতে। প্রখ্যাত চিত্র নায়িকা অলিভিয়ার ছোট ভাই জর্জিও ইয়ংমেন্সে থেকে দেশসেরা ক্লাব আবাহনীতে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। জাতীয় দলের গোলরক্ষক দুলাল হোসেন ধনুও ইয়ংমেন্স থেকে আবাহনীতে যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সফল কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন ইয়ংমেন্স ক্লাবের সাবেক খেলোয়াড়। এই ক্লাব বর্তমানে জুয়াড়িদের দখলে। আর অতিতটা ইতিহাস। সমস্ত অর্জন-সুনাম শেষ হয়ে গেছে ক্যাসিনোর থাবায়। ক্লাব দখল প্রসঙ্গে মনজুর হোসেন মালু জনক-কে জানান, বছর চারেক আগে এলাকার নাসিরউদ্দিন পিন্টু ও সাব্বির হোসেনের নেতৃত্বে প্রায় শতাধিক বহিরাগত সন্ত্রাসী আতর্কিত হামলা চালায় ক্লাবে। এ সময় আমি ক্লাবেই ছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন সভাপতি সিরজুল হক ও কর্মকর্তা আব্দুস সাত্তার। উল্লেখিত দুই ব্যক্তি আমাদের ক্লাব থেকে বের হয়ে যেতে বললে, প্রাণভয়ে আমরা চলে যাই। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি ফুটবলের ॥ ইয়ংমেন্সসহ মাঝারি সারির ক্লাবগুলো ভবিষ্যতে আর আগামীর প্রজন্ম তৈরি করতে পারবে না আর। এটা কেবল ফুটবলের ক্ষেত্রেই নয়। প্রায় সব খেলার জন্য বড় ধরনের হুমকি। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ফুটবলের। কাজেই ক্যাসিনো জুয়া বাণিজ্যে ধংস হয়ে যাওয়া ক্লাবগুলো পুনরুজ্জীতি করতে না পারলে খেলোয়াড় তৈরির পাইপলাইন বন্ধা হয়ে যাবে। দেশে এখন অনেক বয়সভিত্তিক ফুটবল টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। চলছে ট্যালেন্টহান্ট কার্যক্রম। গত কয়েকদিক আগে শেষ হয়েছে অনুর্ধ-১৮ ফুটবল টুর্নামেন্ট। সাবেক তারকাদের সংগঠক সোনালি অতীত ক্লাব আয়োজন করছে আন্তবিশ্বদ্যিালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট। সাইফ পাওয়াকেটের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ জেলা ও বিভাগীয় ফুটবল এসোসিয়েশনের (বিডিডিএফএ) উদ্যোগে সারা দেশে চলছে ট্যালেন্টহান্ট কার্যক্রম। ইতোমধ্যে একাধিক প্রতিভাবান তরুণ ফুটবলারকে বাছাই করে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এই সংগঠক। বিভাগীয় পর্যায়ের একটি টুর্নামেন্টে খেলানো হবে এসব যুব ফুটবলারদের। কিন্তু এরপর? তারা যদি ঢাকার ক্লাবে খেলার সুযোগ না পায় তাহলে ক্যারিয়ার গড়তে ফুটবল খেলাকে বেছে নিতে পারবে না। ঝরে পড়বে অঙ্কুরেই। কেবল ক্লাবে খেলার সুযোগ পেলেই আগামীর প্রজন্ম হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে তারা। ঘরোয়া ফুটবলের সর্বোচ্চ আসর বিপিএলের দলগুলোর বাইরে পাইওনিয়ার থেকে শুরু করে তৃতীয়, দ্বিতীয়, প্রথম বিভাগে খেলা ক্লাবগুলো সচরাচর উঠতি তরুণ নিয়েই দল গড়ে থাকে। এসব লীগে খেলে তারা নিজের ভবিষ্যত গড়ার জন্য বড় ক্লাবে খেলার স্বপ্ন দেখে। আর বড় দলে খেলে তারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে জাতীয় দলে জায়গা করে নেয়ার। ফুটবলের সূতিকাগার হিসেবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ইয়াংমেন্স ক্লাব। তবে আলফাজ আহমেদ ফয়সাল আহমেদের মতো আরও অকে তারকার জন্ম দিয়েছে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘও। খেলধুলার মূলমন্ত্র যদি হয়ে থাকে সুস্থ শরীর, সুন্দর মন তাহলে সরকারের উচিত যে করেই হোক ক্লাব থেকে জুয়া নির্মূল করে খেলার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এটা কোন ব্যাপারই না। ক্যাসিনোর স¤্রাজ্যের প্রায় সব স¤্রাটরাই তো এখন খাঁচায় বন্দী। ওয়াকিবহাল মহলের মতে ক্রীড়াঙ্গনের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত এই জুয়াড়িদের এমন শাস্তি দেয়া হোক যাতে আগামীতে কেউ যেন শখের বসেও ক্লাবের টেবিলে জুয়া দূরের কথা তাস খেলার সাহস না পায়। কিন্তু পার পেয়ে গেলে হয়তো কিছুদিন ঘাপটি মেরে থাকবে অপরাধীরা। জেল থেকে ছাড়া পাওয়া চিহ্নিত সন্ত্রাসী-জুয়াড়িরাই স্থানীয রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আবার জুয়ার রাজত্ব কায়েম করে ক্লাবপাড়ায়। তারই ’ওয়ান টেন’-এর আধুনিক ভার্সন ক্যাসিনো জুয়ার হোতা। ক্রীড়াঙ্গনকে নাড়িয়ে দেয়া এই ঘটনা প্রথম সামনে আসে গত ১৮ সেপ্টেম্বর র‌্যাবের অভিযানে। ইয়ংমেন্স, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, অরামাবাগ ক্রীড়া সংঘ, দিলকুশা ও মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াচক্রে একযোগে র‌্যাবের অভিযানে। সব ক’টি ক্লাবেই মেলে ক্যাসিনো চালানোর প্রমাণ, উদ্ধার হয় ক্যাসিনোসহ জুয়ার নানা সরঞ্জাম, বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা ও মদ। পরবর্তীতে কলাবাগান ক্রীড়া চক্র ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে চালানো অভিযানেও একই চিত্রের দেখা মেলে। ক্লাবগুলো ঘিরে এই লজ্জাজনক ঘটনা। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য অশনি সঙ্কেত বলেই মনে করছেন খেলোয়াড় ও ক্রীড়াপ্রেমীরা। খেলাধুলা টিকিয়ে রাখার স্বর্থে এই অববস্থার পরিবর্তন, প্রতিকার প্রত্যাশা করছেন সবাই।
×