ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদপুরের ‘পাগলা মিজান’ শ্রীমঙ্গল থেকে গ্রেফতার

প্রকাশিত: ১০:৪৫, ১২ অক্টোবর ২০১৯

 মোহাম্মদপুরের ‘পাগলা মিজান’ শ্রীমঙ্গল  থেকে গ্রেফতার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সরকারের চলমান শুদ্ধি অভিযানে মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আলোচিত কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে ‘পাগলা মিজান’ র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তার বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুরের উর্দুভাষী অবাঙালীদের জেনেভা ক্যাম্পে মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া হত্যা, খুনসহ নানা ধরনের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। গ্রেফতারের পর মিজানকে নিয়ে তার বাসা ও অফিসে অভিযান চালানো হয়েছে। বাসা থেকে প্রায় সাত কোটি টাকার চেক ও এক কোটি টাকার এফডিআর উদ্ধার হলেও অফিসে তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি। গ্রেফতারের পর পরই মিজানের পরিবারের লোকজন অন্যত্র চলে গেছে। বৃহস্পতিবার রাতে শ্রীমঙ্গল থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। র‌্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক ও র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম হাবিবুর রহমান মিজান পাশের দেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তার বিরুদ্ধে হত্যা, মাদক ব্যবসা, জমিদখল, টেন্ডারবাজি, প্রভাব বিস্তারসহ বহু অভিযোগ রয়েছে পাগলা মিজান মোহাম্মদপুরের বাসিন্দাদের কাছে ত্রাস হিসেবে পরিচিত। তার ভয়ে সব সময় তটস্থ থাকতেন বাসিন্দারা। র‌্যাব সূত্র বলছে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের এই কাউন্সিলর সরকারের চলমান শুদ্ধি অভিযানের পর থেকেই ছিলেন লাপাত্তা। গত সোমবার রাতে মোহাম্মদপুরের আওরঙ্গজেব রোডে মিজানের ফ্ল্যাটে অভিযান চালালেও তাকে পাওয়া যায়নি। মিজান তার স্ত্রী, ছেলে ও ছেলের বউকে নিয়ে বাড়িতে থাকতেন। শুক্রবার মিজানের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক ও এক কোটি টাকার এফডিআর পাওয়া যায়। তাকে নিয়ে লালমাটিয়ার কার্যালয়ে অভিযান চালানো হলেও তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি। র‌্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ সারোয়ার আলম এমন তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। স্থানীয়দের দেয়া তথ্য ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মিজান ’৭৪ সালে ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় এসে প্রথমে মিরপুরে টোকাই ছিলেন। সেখান থেকে হোটেল বয়ের কাজ শুরু করেন। পরে মোহাম্মদপুরে ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি শুরু করেন। সিটি কর্পোরেশনের চুরি করা ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে সিটি কর্পোরেশনের কাছেই আবার বিক্রি করতেন। ’৭৫ সালের মাঝামাঝি খামারবাড়ি খেজুরবাগানে ছিনতাই পুলিশের ধাওয়া খেয়ে লালমাটিয়ায় মসজিদের পাশে পুকুরে নেমে পড়েন। পুলিশের বার বার নির্দেশ উপেক্ষ করে তিনি পুকুর থেকে ওঠেননি। কয়েক ঘণ্টা পর কাপড় ছাড়াই উঠে এসে এমন কান্ডজ্ঞানহীন কাজের জন্য পুলিশ তাকে ‘পাগলা’ আখ্যা দিয়ে ছেড়ে দেয়। এরপর থেকেই তার নাম ছড়িয়ে পড়ে পাগলা মিজান হিসেবে। ’৯১ সালে তিনি নতুন করে নাম রেজিস্ট্রেশন করে নিজের নাম রাখেন হাবিবুর রহমান মিজান। ১৯৭৬ সালে ফ্রিডম পার্টির পক্ষ থেকে পাগলা মিজান, শামীম জালালী ওরফে দারোগার ছেলে শামীম, বাবুল ওরফে পিচ্চি বাবুলসহ কয়েকজন লিবিয়ায় গিয়ে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন। শেখ হাসিনার ওপর হামলার সময় মিজান ছিলেন ফ্রিডম পার্টির ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুর জোনের কো অর্ডিনেটর। ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকীতে আওয়ামী লীগ নেত্রী রেজিয়া বেগমের খাবার লাথি দিয়ে ফেলে দিয়ে প্রথমবার আলোচনায় আসেন। ’৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্যরাতে ফ্রিডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলা চালায় ১০/১২ জনের একটি দল। হামলাকারীরা গুলি চালায় ও বোমা হামলা করে। এ সময় শেখ হাসিনা বাড়ির ভেতরে অবস্থান করছিলেন। নিরাপত্তাকর্মীরা পাল্টা গুলি চালালে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা হয়। ’৯৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মামলার অভিযোগপত্র দেয়। এতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) সৈয়দ ফারুক রেহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুর রশীদ মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) বজলুল হুদা ও নাজমুল মাকসুদ মুরাদসহ ১৬ জনকে আসামি করা হয়। অভিযোগপত্রে পাগলা মিজানকে হামলার চক্রান্তকারীদের একজন হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মিজানের ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফাও ছিলেন হামলাকারী দলের সদস্য। মোস্তফা ’৯৫ সালে সন্ত্রাসীদের গুলিতে মারা যান। এ বছরের গত ২৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে তুরাগ নদের পাশে সিলিকন রিয়েল এস্টেটের জমি দখল কেন্দ্র করে মোহাম্মদপুরের যুবলীগ নেতা আরিফুল ইসলাম তুহিন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর পাগলা মিজান, আদাবরের ছাত্রলীগ নেতা রিয়াজ আহম্মেদ ও সাইফুল তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে হামলা চালায়। এ সময় সন্ত্রাসীরা সিলিকন রিয়েল এস্টেটের ৬ কর্মীকে গুলি ও আরও ১৪ জনকে কুপিয়ে জখম করে। এ সময় সন্ত্রাসীরা জুয়েল নামের এক কর্মীকে গুলি করে আহত করার পর ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে দিয়ে তার লাশ তুরাগে ফেলে দেয়। আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের ডুবুরিরা দু’দিন তল্লাশি চালিয়ে ৩১ অক্টোবর সকালে জুয়েলের লাশ উদ্ধার করে। মিজানের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় ’৯৬ সালে ইউনুস হত্যা ও ’১৬ সালে সাভার থানায় জোড়া হত্যা মামলা রয়েছে। সর্বশেষ গত ৫ অক্টোবর সরকারের পাওনা ৩১ কোটি টাকা বকেয়া বিদ্যুত বিল পরিশোধ না করে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাবিতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভকালে পুলিশের সঙ্গে মোহাম্মদপুরের উর্দুভাষী অবাঙালীদের ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। বিক্ষোভকারীরা পুলিশের একটি গাড়ি ভাংচুরের পর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সংঘর্ষে পুলিশ, পথচারী, বিক্ষোভকারীসহ অন্তত অর্ধশত আহত হয়। বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় টায়ার, ফোম, কাঠসহ বিভিন্ন দোকানের আসবাবপত্রে আগুন দিয়ে বিক্ষোভ করে। সংঘর্ষে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, মার্কেট ক্যাম্প ছাড়াও হুমায়ুন রোড, তাজমহল রোড, শেরশাহ শুরী রোড, মাদ্রাসা রোড, শাহজাহান রোডসহ আশপাশের এলাকা রীতিমত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টাধাওয়া ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে লাঠিচার্জ, রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে হয়। দুপুর বারোটা থেকে বিকেল পাঁচটা নাগাদ পুরো এলাকাজুড়ে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার নেপথ্যেও ছিল মিজানের বিদ্যুত বাণিজ্য। জেনেভা ক্যাম্প থেকে বিদ্যুত লাইন নিয়ে ক্যাম্পলাগোয়া দু’টি বাজারের অন্তত তিনশ’ দোকানে দেয় মিজান। প্রতিমাসে এসব দোকান থেকে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন মিজান। সম্প্রতি দুদকের সহযোগিতায় ওসব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নের ঘটনা ঘটে। এরপর মিজান আবার ক্যাম্প থেকে বিদ্যুত সংযোগ দিতে চাপ দিচ্ছিল। এতে রাজি না হওয়ার সূত্রধরেই সংঘর্ষের ওই ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার নেপথ্য কারিগর হিসেবে নাম আসে কমিশনার মিজান ও এসপিজিআরসির কতিপয় নেতার।
×