ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পরিধি বাড়ল মেট্রোরেলের ॥ কমলাপুর পর্যন্ত

প্রকাশিত: ১০:৪৩, ১২ অক্টোবর ২০১৯

 পরিধি বাড়ল মেট্রোরেলের ॥ কমলাপুর পর্যন্ত

রাজন ভট্টাচার্য ॥ যানজটে অতিষ্ঠ নগরবাসীর জন্য আরেকটি সুখবর। চলমান ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান আর বুয়েটে আবরার হত্যাকান্ডের মতো খারাপ খবরের মধ্যে এ খবরটি অনেকটাই স্বস্তি দেবে বলা যায়। তা হলো উত্তরা থেকে মতিঝিল নয়, কমলাপুর পর্যন্ত যাচ্ছে মেট্রোরেল। যানজট নিরসনে সবচেয়ে আশার প্রকল্প এটি। সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের বিবেচনায় তা এখন নগরজুড়ে দৃশ্যমান। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নগরবাসীর চলাচলে স্বস্তি নিশ্চিত করতে আরেকটি চমকপ্রদ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। সেটি হলো উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত পাতাল রেল নির্মাণ। যা যুক্ত হবে মেট্রোরেলের সঙ্গে। কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রায় ২১ কিলোমিটার দৈর্ঘের এ প্রকল্পের উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে ৪৬ শতাংশ। চলতি মাসেই শুরু হচ্ছে এর বৈদ্যুতিক কাজ, নবেম্বরে বসবে চীন থেকে আসা রেললাইন। ইতোমধ্যে উত্তরাসহ বিভিন্ন অংশে শুরু হয়েছে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ কাজ। দিয়াবাড়ি এলাকায় ডিপো ও ভূমি উন্নয়নের কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক তিন সাত কিলোমিটার ভায়াডাক্ট এ স্টেশন নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৫৫ শতাংশ। এতেই দৃশ্যমান হয়েছে স্বপ্নের এ প্রকল্প। ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল কাজ হয়েছে ১৬ দশমিক পাঁচ শূন্য শতাংশ। তবে রেললাইন, কোচ ও ডিপো ইকুইপমেন্ট সংগ্রহের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ১৫ দশমিক দশ ভাগ। এ বিষয়ে মেট্রোরেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক বলেন, আশা করি প্রকল্প মেয়াদের এক বছর ছয় মাস আগে আমরা কাজ শেষ করতে পারব। ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মেট্রোরেল প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে। মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ‘ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডে’র (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক বলেন, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের অগ্রগতি হয়েছে ৪৬ শতাংশ। এরই মধ্যে চীন থেকে রেললাইন এসে পৌঁছেছে। এসেছে লাইন বসানোর মেশিনও। নবেম্বর থেকে শুরু হবে রেললাইন বসানোর কাজ। তিনি বলেন, প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে এমআরটি নক্সাতে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। তা বাড়িয়ে কমলাপুর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাজেট না বাড়িয়ে প্রকল্পের পরিধি বাড়ানো এটাই প্রথম মনে হয়। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা মহানগরী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার যানজট নিরসন ও পরিবেশ উন্নয়নে বর্তমান সরকার ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে ৬টি মেট্রোরেল সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পর্যায়ক্রমে সকল প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হলে ঢাকার যানজট অনেকাংশে কমে আসবে। আমরা আশাকরি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে এসব প্রকল্প যতই ব্যয়বহুল হোক তা বাস্তবায়ন না করার বিকল্প নেই। আগামী বছর থেকে ট্রায়াল ॥ সব ঠিক থাকলে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে মেট্রোরেলের পূর্ণাঙ্গ সেট আসলেই শুরু হবে ট্রায়াল রান। তবে যাত্রী বহনে আরও কিছুটা সময় লাগতে পারে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আমাদের এখানে পৃথিবীর সর্বশেষ প্রযুক্তির কোচগুলো আনা হচ্ছে। যখন এগুলো চলতে শুরু করবে তখন তা অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি উন্নত ও আধুনিক হবে। আর দেশের প্রথম এই মেট্রোরেল হবে সম্পূর্ণ এলিভেটেড ও বিদ্যুতচালিত। মেট্রোরেলের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাজাহান বলেন, বাকি যে কাজ আছে সব একসঙ্গে শুরু হবে। পরিবর্তন এসেছে নক্সায়ও। আরও এক কিলোমিটার বাড়িয়ে মতিঝিলের অংশটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কমলাপুর পর্যন্ত। ১৬ থেকে বাড়িয়ে ১৭ স্টেশন হচ্ছে ॥ প্রকল্পের তথ্যানুযায়ী, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মোট ১৭টি স্টেশন থাকবে। উত্তরার দিয়াবাড়িতে হবে মেট্রোরেলের প্রথম স্টেশন। যার নাম হবে উত্তরা নর্থ। পর্যায়ক্রমে এর পরের স্টেশনগুলো হবে- উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কাওরান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয়, মতিঝিল ও কমলাপুর। প্রকল্পের শুরুতে ১৬টি স্টেশন নির্ধারণ করা হলেও পরিধি বাড়ায় একটি স্টেশন যুক্ত করা হয়েছে। দ্বিতীয় তলায় টিকেট-তৃতীয় তলায় হবে প্ল্যাট ফরম ॥ এদিকে আগামী বছরের জুনে মেট্রোরেলের প্রথম পরিপূর্ণ ট্রেন সেট দেশে আসবে বলে জানা গেছে। এভাবে ওই সময় থেকে পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে মোট ২৪টি ট্রেন সেট আসবে। একেকটি সেটে ৬টি করে কোচ থাকবে। ট্রেনগুলো উভয়দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী টানবে। এই মেট্রোরেলের প্রতিটি স্টেশন হবে তিনতলা। সিঁড়ি বেয়ে প্রথমে উঠতে হবে দ্বিতীয় তলায়। সেখানে টিকেট কাউন্টার ও অন্যান্য সুবিধাদি থাকবে। আর ট্রেনের প্ল্যাটফরম থাকবে তৃতীয় তলায়। এর একপাশে যাওয়ার যাত্রীদের জন্য প্ল্যাট ফরম, অপর পাশে থাকবে আসার যাত্রীদের জন্য প্ল্যাট ফরম। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রতিটি স্টেশনে ট্রেন থামবে। ছাড়ার আগে সাইরেন বেজে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। উত্তরা তৃতীয় ফেজ ডিপোর গেটের পাশে উপযুক্ত জায়গা নির্ধারণ করে, সেখানে মেট্রোরেল এক্সিবিশন এ্যান্ড ইনফরমেশন সেন্টার করা হবে। যেখানে মেট্রোরেলের নির্মাণশৈলীর ইতিহাস তুলে ধরা হবে। থাকবে চলন্ত সিঁড়ি ও লিফট ॥ ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রান্সপোর্ট এমআরটি লাইন সিক্সের আওতায় উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেলের ১৭টি স্টেশনেই থাকবে আধুনিক বিশে^র সর্বোচ্চ সব ধরনের ব্যবস্থা। গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে ৪০ মিনিটে। চলন্ত সিঁড়ির পাশাপাশি থাকবে লিফটের ব্যবস্থা। চলতি টিকেটের পাশাপাশি থাকবে সাপ্তাহিক ও মাসভিত্তিক কার্ড। প্রতিটি কামড়ায় সিনিয়র সিটিজেন, মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা আসনের ব্যবস্থা থাকবে। নারী যাত্রীদের জন্য পৃথক কামড়া রাখারও চিন্তা করা হচ্ছে। এছাড়া এমআরটি পুলিশ ফোর্স গঠনের প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান প্রকল্পটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক। তিনি বলেন, ২০১৮ সালের মধ্যে আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমআরটি পুলিশ ফোর্স গঠনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠিয়েছি। নিরাপত্তার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। গঠন করা হবে এমআরটি পুলিশ ফোর্স। তবে এখনও ভাড়ার বিষয়ে কোন সিদ্ধন্তে পৌঁছাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এ প্রসঙ্গে এম এ এন সিদ্দিক বলেন, এটা নিয়েও আলাপ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জনগণের সাধ্যের মধ্যে ভাড়া ঠিক করতে হবে। ঢাকার যানজট নিরসনে মেট্রোরেল প্রকল্প ২০১২ সালের ডিসেম্বরে একনেকে অনুমোদন হয়। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার সঙ্গে ঋণ চুক্তি হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত। তবে সরকার প্রথমে চলতি বছরের ডিসেম্বরে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশ চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এখন পুরোটা একসঙ্গেই ২০২১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা দেবে জাইকা। সম্প্রতি সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক অনুষ্ঠানে বলেন, ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হবে। সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশের প্রথম উড়াল স্বপ্নের মেট্রোরেলের উদ্বোধন করা হবে। মন্ত্রী জানান, ঢাকা মহানগরী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার যানজট নিরসন ও পরিবেশ উন্নয়নে বর্তমান সরকার ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে ৬টি মেট্রোরেল সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে উত্তরা ৩য় পর্ব হতে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ ১৭ স্টেশন বিশিষ্ট উভয়দিকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহনে সক্ষম আধুনিক, সময় সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও বিদ্যুতচালিত ম্যাস র‌্যাপিড ট্রান্সজিট (এমআরটি) নির্মাণের লক্ষ্যে ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-৬) নির্মাণ কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে।
×