ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাজী সেলিম

রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ এবং কিছু কূটনৈতিক উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৭:২৮, ৯ অক্টোবর ২০১৯

রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ এবং কিছু কূটনৈতিক উদ্যোগ

বর্তমানে ১২ লাখের বেশি আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশের জন্য এক মহাবিপর্যয়। ইতোমধ্যেই দেশের অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা, পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের ওপর হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেন এখন উৎসাহ, প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতার ভাটায় পড়ে আছে। বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে প্রত্যাবর্তনের বিষয়টিকে জরুরীভাবে সমাধানের লক্ষ্যে সরকারকে একটি জরুরী অত্যাবশ্যকীয় পররাষ্ট্রনীতির কূটকৌশলের চ্যালেঞ্জিং প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। যদিও এই জনগুরুত্ব বিষয়টিকে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করার সকল কূটনৈতিক পদক্ষেপ ও প্রচেষ্টা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার চালিয়েছে- যা এখনও অব্যাহত। তারপরও এই সুদূরপ্রসারী সমস্যার সমাধানকল্পে সরকারকে আরও কিছু বেগবান ও অতিরিক্ত প্রচেষ্টাকে যোগ করতে হবে। আমার ক্ষুদ্র চিন্তা-ভাবনা ও আন্তর্জাতিক সংস্থার চাকরির অভিজ্ঞতার আলোকে এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে বিশ্ব পরিমন্ডলের বর্তমান কূটনৈতিক কূটচাল হচ্ছে স্ব-স্ব স্বার্থ সংবলিত। প্রথমে বিভিন্ন দেশ প্রথমে বেশ সরব ও প্রতিবাদমুখী হয়েও এখন যেন সকলেই নিস্তেজ। স্ব-স্ব স্বার্থ ও অর্থ-বাণিজ্যের নিজ স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে কঠোর ও বাস্তবসম্মত কার্যকর কোন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গ্রহণে সকলে নমনীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। প্রায়শই বাংলাদেশ সফরে এসে আমাদের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাত শেষে এক ঝলক সাংবাদিক ক্যামেরার সামনে হাজির হয়ে শুধু বলে যায়, আমার সরকার বা আমরা, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকব ও সাহায্য করব। ঢাকার আকাশসীমা অতিক্রম করে দীর্ঘপথে যাত্রা শেষে যখন স্বদেশের বিমানবন্দরে অবতরণ করেন, তখন তারা যেন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের ঢাকায় প্রদত্ত আশা-আকাক্সক্ষা ও সমর্থনের বিষয়টিকে পূর্ণ উচ্চারিত করার সকল ভাষা ও বিবৃতির সারাংশকে মুহূর্তের মধ্যেই একটি অতীত বিষয় মনে করে। এক সময় রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রতিবাদকারী সচল মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের দ্বারা মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ও বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার নিত্যদিনের প্রতিশ্রুতি সংবলিত বিবৃতি, বক্তব্য এখন যেন স্তিমিত হয়ে গেছে। তারা যেন স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কোন এক স্বার্থ সংবলিত আশা-ভরসার চাওয়া-পাওয়ার হীন স্বার্থে জড়িত হয়ে পড়েছেন। আমি আশাবাদী ছিলাম হয়ত বা মার্কিন কংগ্রেসের বেশ কয়েক বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের চাপের মুখে মার্কিন বর্তমান প্রশাসন মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের পরিচালিত সরকারের ওপর ওবামা প্রশাসন কর্তৃক অপসারণকৃত অর্থনৈতিক অবরোধটি আবারও পুনরায় জারি করবে। কিন্তু আমার সেই ধারণাটি যেন দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশের সরকারপ্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর বাংলাদেশ আজ আপন মহিমা ও স্বপ্রচেষ্টায় উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে অবিরাম গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশ ও জাতির উন্নয়ন এবং অগ্রগতির এই মহাসোপনে দ্রুতগতির অগ্রযাত্রার প্রধান কান্ডারী জাতির পিতার গর্বিত কন্যা, দেশ ও জাতির নেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তার অক্লান্ত পরিশ্রম, সততা, নিষ্ঠা, রাজনৈতিক ও বিশ্ব কূটনৈতিক দূরদর্শিতা, লব্ধ শিক্ষা জ্ঞান ও গর্বিত পিতার উত্তরাধিকার হিসেবে প্রাপ্ত সৎসাহসিক বিচক্ষণতা, আপোসহীন এক মানবতার কান্ডারী হিসেবে বাংলাদেশের জনগণ ও স্বাধীন সার্র্বভৌম রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণ ও উন্নয়নের মহান দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। বাংলাদেশের জনগণ ও বিশ্ব মানবতাবাদী নেতৃবৃন্দ তথা মানুষের দৃঢ় ও অগাধ বিশ্বাস- বঙ্গবন্ধুর কন্যার প্রতি এই মর্মে যে, তিনি শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের মাটিতে তার সরকারের আশ্রিত ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী তাদের স্বজন্মভূমি মিয়ানমারে একদিন ফিরে যেতেই হবে। তবে, এই জটিল কূটনৈতিকভাবে সমাধান শীঘ্রই হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রধানগণ কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে বিভিন্ন সময়ে এই মন্তব্য করেছেন। এখনও তাদের কথায় একই সুর। আমরা সাহায্য সহযোগিতা করব তাদের খাদ্য, ওষুধ ও আশ্রয় স্থান নির্মাণে। এমনকি বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট এনেট ঢিফসন গত জানুয়ারি মাসে শিবির পরিদর্শন শেষে একই অভিমত ব্যক্ত করে গেছেন। কিন্তু কেউই শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক সমন্বিত প্রচেষ্টা বা কূটকৌশল কিভাবে তৈরি করে মিয়ানমারের শাসক জান্তার ওপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে তাদের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিতে এ বিষয়ে কোন স্পষ্ট ও সঠিক কর্মপন্থা বা পরিকল্পনার কথা উচ্চারিত হয়নি অদ্যাবধি। উপরন্তু, বাংলাদেশ সরকার ও নৌবাহিনীর পরিচালনায় নির্মিত দক্ষিণের ভাষানচরে শরণার্থী আশ্রয়স্থল স্থানান্তরিত করার পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক কোন কোন মহলের দ্বিমত পোষণ করার কারণে, শরণার্থীদের পুনর্বাসনের কাজ থেমে আছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার যদি এই আশ্রিত শরণার্থীদের জন্য কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত ঘেঁষে সকল সুযোগ-সুবিধা সংবলিত বিলাসবহুল স্থাপনা নির্মাণ করে দিত, তাহলে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান, আমলা-কর্মচারীরা খুশিতে গদ গদ হয়ে যেত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার সামর্থ্য অনুযায়ী এই বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয়, খাবার, ওষুধ-নিরাপত্তাসহ সকল সুবিধার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন মানবতার খাতিরে। কিন্তু তার মানবিকতার বিপরীতে শক্তিশালী কোন কূটনৈতিক প্রচেষ্টার বিন্দুুমাত্র স্বাক্ষর রাখেনি। রোহিঙ্গা শরাণার্থীদের স্বদেশভূমিতে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমারের শাসকদের ওপর কোন প্রকার চাপ সৃষ্টি করেনি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশসমূহ। তারা চাঁদা দেয়ার অংশটুকু জাতিসংঘের ফান্ডে জমা দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে। এ জটিল সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারকে দৃঢ়ভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কারণ, আমার বন্ধুর চেয়ে শত্রুও কম কম। বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রিত মিয়ানমারের ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর বিষয়টি গোটা বাংলাদেশের জন্য একটি জাতীয় অনিশ্চিত বিষফোঁড়ার মতো বিরাজমান। যদিও বাংলাদেশ সরকারের সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এই জটিল বিষয়টির আশু সমাধানে বর্তমান সরকারকে আরও বেশ কিছু কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেমন, বাংলাদেশের প্রাক্তন দক্ষ ও বর্তমান দায়িত্বরত কূটনীতিতে পারদর্শী ও বিচক্ষণদের সমন্বয়ে একটি বিশেষ টিম গঠন করে তাদের দূরদর্শীমূলক পরামর্শ মোতাবেক, কর্মপন্থা নির্ধারণ করে ১৯৭১ সালের মতো জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চলাতে হবে। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে রাজধানী ঢাকায় দায়িত্বরত ও বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সংক্রান্ত বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সহকারে অবহিত করে আলোচনা করে, এই বিষয়টির সুরাহা কিভাবে করা যায় তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়া। মিয়ানমার সরকারের কি কি প্রতিশ্রুতি রয়েছে এবং তাদের মতামত গ্রহণ ও সংরক্ষণ করা। তারপর এই টিমটির দায়িত্ব ও কাজ হওয়া উচিত প্রথমে আমাদের প্রতিবেশী সর্বপ্রথম ভারত, চীন, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে, এই তিন দেশের সরকারকে সর্বাত্মকভাবে বোঝাতে হবে বাংলাদেশের বর্তমান, ভবিষ্যত সম্ভাব্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশ সংক্রান্ত ক্ষতির সম্মুখীন এবং তার প্রভাব দক্ষিণ এশিয়া তথা গোটা বিশ্বে সম্ভাব্য কুপ্রভাবের বিভিন্ন দিক ও বিষয়গুলো। এ টিমের দায়িত্ব ও কার্যক্রমের ফলাফলের ভিত্তিতে প্রয়োজন হবে সরকারের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত-রাশিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ সফর করে তাদের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাত করে বাংলাদেশের সীমিত সামর্থ্য ও দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা মিয়ানমারের নাগরিকদের অবস্থান, বাংলাদেশসহ এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্ভবনা তুলে ধরা এবং তাদের দেশে প্রত্যাবাসন করা যায় কিনা সে বিষয়টি উত্থাপন করা। ॥ দুই ॥ বর্তমান সরকারের বিশাল অর্জনকে এবং বাংলাদেশের ধাবিত অগ্রযাত্রার কোন প্রচার বহির্বিশ্বের মিডিয়া প্রচার করে না। বরং রানা প্লাজার বিয়োগান্তক প্রাণহানির সেই সকল ভিডিও ক্লিপ ও সংবাদ প্রচার করে এখনও বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের অনগ্রসরতা ও নিরাপত্তাহীনতার কাহিনী ঢালাওভাবে অপপ্রচার করে যাচ্ছে। অথচ গার্মেন্টস শিল্প কারখানার কর্মনিরাপত্তাসহ সামগ্রিকভাবে সকল কিছুরই ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছে বর্তমান সরকার। তার কোন সফলতা বা অগ্রগতির ইতিবাচক সংবাদ প্রচার করা হয় না বিশ্ব মিডিয়ায়। আমি মনে করি, দেশ ও সরকারের কর্মকান্ড সাফল্যের অগ্রগতির সকল কিছুই বিশ্ব মিডিয়া ও সরকারগুলোকে যথাযথভাবে অবহিত করে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ বা প্রত্যুত্তর দেয়ার প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে- আমাদের বৈদেশিক মিশনসমূহের প্রেস বিভাগের। বর্তমান সরকার বিরোধী অপপ্রচার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিদেশের সংবাদমাধ্যম প্রচারণায় প্রধান শিরোনাম আকারে প্রতিনিয়তই প্রকাশিত হচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশের বর্তমান প্রজন্ম বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্বাধীনতার পটভূমি ও দেশ পরিচিতি, জাতির পিতার বিশাল অবদান, আত্মত্যাগের কাহিনী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের কোন সংবাদ সেভাবে জানে না। অথচ বৈদেশিক মিশনগুলো তাদের আয়কৃত অর্থ দ্বারা একটি অংশ, অনায়াসেই ব্যয় করে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবে পালন করতে পারে। নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশে একটি পূর্ণাঙ্গ হাইকমিশন স্থাপন করা উচিত। ১৯৯৮ সালে নিউজিল্যান্ডে একটি পূর্ণাঙ্গ হাইকমিশন স্থাপনের ব্যাপারে তার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার ওপর প্রতিবেদন লিখেছিলাম। তদান্তীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ সাহেবের কাছে আমার লিখিত বিশেষভাবে প্রবাসী নিউজিল্যান্ডবাসীর পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা হয়েছিল আবেদনপত্র। দক্ষিণ প্রশান্ত অঞ্চলে দেশগুলোর বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করা হয় অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরা থেকে অথচ নিউজিল্যান্ডের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দেখাশোনা, তদারকি ও সেখানে অবস্থানরত বসবাসকারী বাংলাদেশীদের স্বার্থ ও দেশের কূটনীতিকে সচল ও সার্থক করে তোলার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি পূর্ণাঙ্গ হাইকমিশন নেই। নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দক্ষিণ প্রশান্ত অঞ্চলের দুই দেশের রাজধানীতে রয়েছে ভারত-পাকিস্তানসহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশেরই পূর্ণাঙ্গ হাইকমিশন বা কার্যালয়। বাংলাদেশের স্বার্থে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে কিনা এবং ওই সকল দেশে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অস্ট্রেলিয়ায় একমাত্র হাইকমিশন কি দায়িত্ব পালন করছে, তা অদ্যাবধি বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। শুধু সরকারী মন্ত্রী, আমলা-কর্মচারীদের বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন ও তাদের সময় দিয়ে প্রটোকলের দায়িত্ব পালন করাতেই যেন সবাই সীমাবদ্ধ। গত ১৫ মার্চ, ২০১৯ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে সংঘটিত নামাজিদের ওপর সংঘটিত বর্বরোচিত আক্রমণ ও হত্যাকা-ের শিকার বাংলাদেশীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দেখাশোনা ও তদারকির কোন তাৎক্ষণিক বাংলাদেশী কূটনীতিবিদকে দেখা যায়নি। তবে অকল্যান্ড থেকে অনারারি কনসাল জেনারেল শফিকুর রহমান ভূইয়া পরদিন উপস্থিত হয়ে স্বজন হারানো বাংলাদেশী বসবাসকারীদের মনে কিছুটা হলেও সাহস যুগিয়েছেন। অথচ সেখানে যদি একটি পূর্ণাঙ্গ হাইকমিশনের দায়িত্বরত হাইকমিশনার থাকতেন এবং বাংলাদেশ সরকারকে পরিপূর্ণভাবে প্রতিনিধিত্ব করতেন, গোটা নিউজিল্যান্ডে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের মনে শক্তি-সাহস সঞ্চয় হতো। ত্বরান্বিত হতো নিহত ও আহত বাংলাদেশী ক্ষতিগ্রস্ত দেখভাল করার মহৎ কাজটি। যদিও নিউজিল্যান্ড সরকার অত্যন্ত ত্বরিত গতিতে যথাযোগ্য মর্যাদা ও গুরুত্বসহকারে সকল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। আমার মনে হয়, আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বৈদেশিক মিশনসমূহকে আরও কার্যকরী ও দায়িত্বশীল করার লক্ষ্যে কিছু বিপ্লবাত্মক সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। ॥ তিন ॥ ১৯৭১ সালে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী নৃশংসতম গণহত্যার বিচার বা তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়ে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মতো মানবতা ও মানবাধিকার সংরক্ষণের তথাকথিত দাবিদারগণ অদ্যাবধি নির্লিপ্ত, নিশ্চুপ। তারা ’৭১-এর ত্রিশ লাখ বাংলাদেশীকে নির্মম পাশবিক হত্যাকান্ডের ‘গণহত্যার’ বিষয়টিকে যেন পাশ কাটিয়ে চলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। বর্তমান সরকারের এই সময়েই এই জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির একটি চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশের মিশনের মাধ্যমে ওই সকল দেশের সরকারপ্রধান ও সংবাদমাধ্যম মানবাধিকার সংক্রান্ত সংস্থাসমূহ, রাজনৈতিক দলগুলোকে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি ও জাতিসংঘের দ্বারা স্বীকৃতি ও গণহত্যার বিচারের ওপর বিশ্বজনমত সৃষ্টি করার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এই দায়িত্ব বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৈনিক জনকণ্ঠে ২২/০৫/২০১৭ইং ও ডেইলি অবজারভারের ২৬/০৫/২০১৭ইং প্রকাশিত আমার লিখিত মতামত, অভিব্যক্তি উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয় কূটনৈতিক জোরদার পদক্ষেপ হওয়া উচিত যুক্তরাজ্য, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তার পরিবারসহ ১৫ আগস্টের গণহত্যার পলাতক খুনী-ঘাতকদের বাংলাদেশের মাটিতে ফিরিয়ে এনে আদালতের রায়কে বাস্তবায়ন করা। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির একটি আশু সমাধানের আরও জোরদার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে বাংলাদেশকে। বর্তমান সরকারের বিশেষ পদক্ষেপ ও উদগ্রীবের ফলস্বরূপ বাংলাদেশ-ভারত সরকার পর্যায়ে যদিও দীর্ঘদিনের এ অমীমাংসিত জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি মীমাংসিত হওয়ার পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। দু’দেশের বিদ্যমান বন্ধুত্বের বন্ধনে বিষয়টিকে গুরুত্ব প্রদান করে, বাংলাদেশের উত্তরের-তিস্তা নদীর খরা মৌসুমে আমাদের তথা বাংলাদেশের পানির ন্যায্য আদায় করে উত্তরবঙ্গের মানুষের বাঁচার, কৃষি ফসল আবাদী রক্ষাকরণে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে আরও জোরদার করতে হবে। ॥ চার ॥ বিদেশে মহিলাসহ মানব পাচারের বিরুদ্ধে কঠিন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ সংক্রান্ত মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে মহিলাসহ মানব পাচারকারী দালাল, টাউট, সরকারী-বেসরকারী এজেন্সির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক কঠোর অনমনীয় কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দেশের অভ্যন্তরে এ সংগঠিত মানবতাবিরোধী ঘাতকচক্র দেশের মধ্যবিত্ত, গরিব কর্মজীবী মহিলা নারীদের বিভিন্ন ভুয়া আশা-ভরসা প্রদান করে দেশের বাইরে পার করে নারীদের বিভিন্নভাবে এক বিপজ্জনক অনিশ্চিত অত্যাচার-নির্যাতনসহ অনৈতিক ব্যবসায় নিয়োগ করে। ওই সব নির্যাতিত মা-বোনকে প্রায়শই অত্যন্ত ভয়ানক করুণ অবস্থায়, মৃত্যুর দ্বার থেকে নিঃস্ব, শূন্য অবস্থায় ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। এর সঙ্গে জড়িত সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। পরিশেষে বলবো, এসব সমস্যা সমাধানে দক্ষ কূটনীতি তৎপরতাই উত্তমপন্থা। সরকারকে সেই চেষ্টাই চলাতে হবে। এই ক্ষেত্রে বিশ্ব মিডিয়ার জোরালো ভূমিকা রয়েছে। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী
×