ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বস্তি থেকে ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার গবেষক

প্রকাশিত: ০৭:২২, ৮ অক্টোবর ২০১৯

  বস্তি থেকে ইউনিভার্সিটি  অব ভার্জিনিয়ার গবেষক

‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়’, প্রবাদটি যেন এই ছেলের জীবন সংগ্রামের সঙ্গে মিলে যায়। আমরা কত সহজেই না হাল ছেড়ে দেই, হতাশে ডুবে মরি। কিন্তু এই ছেলেটি যে আর সবার মতো নয়। হাল তো ছেড়ে দেয়ইনি, বরং জীবনের কঠিন সংগ্রামের মধ্যেও নিজেকে সে বিকশিত করেছে, প্রতিষ্ঠিত করেছে বিশ্বদরবারে। ভারতের মুম্বাইয়ের কুরলা বস্তিতে একটা ছোট ঘরে মায়ের সঙ্গে খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করা বছর চব্বিশের এই ছেলেটি আজ আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ার গবেষক। শুধু তাই-ই নয় ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে রোবটিকসের ওপর তার দু’টো গবেষণাপত্রও প্রকাশিত হয়েছে। যাকে নিয়ে আমাদের আজকের এই অবতারণা সেই জয়কুমার বৈদ্যের জীবনটা আসলেই কেমন ছিল একটু জেনে নিই পেছনের ইতিহাস থেকে। ভারতের মুম্বাইয়ের ঘিঞ্জি এক বস্তিতে ৮ বাই ১০ স্কয়ার ফুটের একটা ছোট ঘরে মা আর দাদির সঙ্গে থাকতেন জয়কুমার বৈদ্য। তার মা নলিনী দেবী শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে এখানেই উঠেন নিজের মায়ের সঙ্গে। বিপদ এখানেই থেমে থাকেনি। ২০০৩ সাল থেকে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। নলিনীর মা একটা চাকরি করতেন। মেয়েকে তিনি অর্থ সাহায্যও করতেন। কিন্তু ২০০৩ সালে অসুস্থতার জন্য তাকে চাকরি ছাড়তে হয়। এদিকে কোথাও চাকরি পাচ্ছিলেন না নলিনী। নলিনী দেবীর ভাষ্যমতে আত্মীয়-স্বজন কাউকেই পাশে পাননি বিপদে। মন্দির ট্রাস্ট থেকে পাওয়া সামান্য রেশন আর পুরনো কাপড়েই চলতে হয়েছে দীর্ঘদিন। তবে দরিদ্রতার প্রভাব যাতে ছেলের পড়াশোনার ওপরে না পড়ে তার জন্য মা নলিনী অনেক কিছু করেছেন। যখন যা কাজ পেয়েছেন তা করেছেন। কখনও সিঙ্গারা, পাউরুটি খেয়ে দিন কাটিয়েছেন। আর আজ সেই জয়কুমারই এখন আমেরিকায়। বস্তির বাসিন্দা থেকে রীতিমতো এখন আমেরিকার সুনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ গবেষক। এত কষ্ট হলেও হাল ছাড়েননি জয়কুমার। মন শক্ত করে রেখেছিলেন তার মা-ও। স্কুলে মাইনে দিতে না পারায় স্কুল কর্তৃপক্ষ একবার তাচ্ছিল্যের স্বরে নলিনীকে বলেছিলেন তার ছেলেকে গাড়ি চালানো শিখতে। টাকা না থাকলে পড়াশোনা হয় না। পরবর্তীতে প্রতিবেশীর সহায়তায় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘মেসকো’-এর সঙ্গে যোগাযোগ হয় নলিনীর। তারাই স্কুলে বাকি থাকা মাইনের অনেকটা পরিশোধ করে দেয়। কলেজে পড়ার সময় সুদ ছাড়া ঋণও দেয় জয়কুমারকে। কিন্তু কারও সাহায্যে নির্ভরশীল হয়ে থাকা পছন্দ ছিল না তার। স্থানীয় একটা টিভি মেরামতির দোকানে কাজ শুরু করেন। মাসে ৪ হাজার টাকা মাইনে পেতেন তিনি। পাশাপাশি স্থানীয় পড়ুয়াদের টিউশন দিতেও শুরু করেন। কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের জোরে কেজে সোমাইয়া কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে ইলেকট্রিক্যালে স্নাতক হন। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় রোবটিকসে তিনটা জাতীয় এবং চারটা রাজ্যস্তরের পুরস্কারও পান জয়কুমার। এটাই ছিল তার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। কলেজে পড়াকালীন প্রথম চাকরির প্রস্তাব আসে লার্সেন এ্যান্ড টুবরো থেকে। ২১ বছর বয়সে কলেজ পাস করেই তিনি টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর)-এ কাজ পান। মাইনে তখন ৩০ হাজার টাকা। ঘিঞ্জি বস্তি ছেড়ে উঠেন ভাড়া বাসায়। এমনকি দুই মাসের মাইনে জমিয়ে প্রথম নিজের বাড়ির জন্য একটা এসিও কেনেন জয়কুমার। জিআর ইআর টিওইএফএল পরীক্ষার জন্য ফর্মপূরণ করেন। আর তাতে অনেকটা টাকা খরচ হয়ে যায়। সেই ঘাটতি মেটাতে পাশাপাশি অনলাইন টিউশন শুরু করেন জয়কুমার। এদিকে তিন বছর টাটা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে কাজ করার পর জয়কুমার পিএইচডি শুরু করেন। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে তার দুটো গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। সেই গবেষণা ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ কাড়ে। তাদের কাছ থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে রিসার্চ এ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ায় যোগ দেন ২৪ বছরের জয়কুমার। এক সময়ে যাদের মাসের শেষে হাতে ১০ টাকা পড়ে থাকত, আজ তারই মাসিক স্টাইপেন্ড ২০০০ ডলার যা ভারতীয় মুদ্রায় ১ লাখ ৪৩ হাজার টাকার কিছু বেশি। জয়কুমার এর থেকে মাত্র ৫০০ ডলার জয়কুমার নিজের খরচের জন্য রেখে দেন। বাকিটা মাকে পাঠিয়ে দেন। আর খুব তাড়াতাড়ি মাকেও আমেরিকায় এনে নিজের কাছে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে তার।
×