ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গম্ভীরা- বরেন্দ্র্র্র অঞ্চলে লোকজ ধারার সমাজ সচেতন গীতি আলেখ্য

প্রকাশিত: ১০:১৫, ৭ অক্টোবর ২০১৯

গম্ভীরা- বরেন্দ্র্র্র অঞ্চলে লোকজ ধারার সমাজ সচেতন গীতি আলেখ্য

সমুদ্র হক ॥ ‘হাঁ-জি তোহ্মরা হামার নানাকে দ্যেখাছো...।’ লোকজন বলে দেখিনি। নাতি কপালে হাত দিয়ে ইতি-উতি তাকায়- নানাকে খুঁজতে থাকে। এর মধ্যেই মাথায় মাথাল আর লাঠি নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে আগমন ঘটে নানার। ক্ষুব্ধ নানা লাঠি উঁচিয়ে জমিতে পান্তা না নিয়ে যাওয়ার কৈফিয়ত চায় নাতির কাছে। নাতি বলে ‘নানা ক্ষেইপছ্য ক্যনে। দেহইছ্যো না বহ্ড় নানার অনুষ্ঠান চইল্যছে।’ নাতি অনুষ্ঠানের বিষয়ে নানাকে জানায়। নানা জেনে নাতিকে বলে ‘স্যে কথা আহ্গে বলবি তো।’ এরপর নানা-নাতির কথাবার্তা, সংলাপ, বাগবিতন্ডা। আট মাত্রার কাহরবা তালে আদি লোকজ টোকা মুদ্রা নাচে শুরু হয় বাংলার লোকজ ঐতিহ্যের লোকগানের গম্ভীরা। গম্ভীরার মূল গায়েন নানা-নাতি। গানের সুর ও কথার ধরন আলাদা। গবেষকদের মতে, বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী লোকগীতি গম্ভীরা। নানা-নাতি চরিত্রের গায়েনদ্বয় দেশ, কাল, পাত্র, সমাজ, মানবাধিকার, সুশাসন, রাজনীতি জনসচেতনতা; এমন কোন বিষয় নেই যেখানে ব্যঙ্গাত্মক প্রকাশ এবং সমাধানের পরামর্শ থাকে না। বিশেষ ধরনের সুর হৃদয়ের গভীরে ঢোকে-কখনও খোঁচা দেয়, কখনও ভাবাবেগে নিয়ে যায় সুন্দরের দিকে। নানা-নাতি কৌশলে আলাপনের মধ্য দিয়েই দেয় সন্ধান। কথা ও বার্তা মিলেমিশে হয়েছে কথাবার্তা। প্রাচীন ধর্মীয় অনুষঙ্গ হিসেবে জন্ম গম্ভীরার। পরে তা ধর্মীয় ভাবাপন্নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। কালের আবর্তে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া ঘটনার নিরিখে বিষয়বস্তু বদল ও পরিবর্ধিত ধারায় এগোতে থাকে। মূল থিম ঠিক রেখে ও ঐতিহ্য ধারণ করে নানা সময়ে সংস্কার এসেছে গম্ভীরায়। প্রয়াত বীরেন নাথ গম্ভীরায় দশ ধরনের সুর কম্পোজ করতেন। প্রতিটি সুর শ্রুতিমধুর। থিম ঠিক রেখে এগিয়ে এসেছেন শফিউর রহমান ‘সুফি মাস্টার’, মোহসীন আলী, সোলায়মান মোক্তার, ফজলুর রহমান, মোমিনুল মাস্টার, লুৎফুল হকসহ অনেকে। বেশি স্মরণযোগ্য ‘সুফি মাস্টার’। আঞ্চলিকতার গন্ডি পেরিয়ে গম্ভীরাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন উচ্চমার্গে। নানার ভূমিকায় কুতুবুল আলম ও নাতির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন রকিব উদ্দিন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই নানা- নাতি গম্ভীরাকে শিল্পের উচ্চাসনে নিয়ে গেছেন। তাদের পথ ধরেই এখন এগোচ্ছে বর্তমানের গম্ভীরা গায়েনরা। গম্ভীরার মুখ্য চরিত্র নানা-নাতি। পরিবেশন রীতিকে বলা হয় দ্বৈত (ডুয়েট)। চরিত্র দুটোয় কোন দ্বন্দ্ব নেই। তবে দু’জনের মধ্যে কে বেশি জ্ঞানী- এই নিয়ে মতপার্থক্য আগেও ছিল, এখনও আছে। কারও মতে নানা চরিত্র প্রবীণ। বাস্তব অভিজ্ঞতা বেশি। সুতরাং, বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেবেন নানা। অপর পক্ষের কথা: নানা শুধু ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি হাতড়ায়। আধুনিক জীবন সম্পর্কে নানার তেমন ধারণা নেই। অন্যদিকে শিক্ষায় যুক্ত নাতি অনেকটাই আধুনিক। তাই নাতির মুখেই বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর যুক্তিযুক্ত। বিতর্কের পর শেষ পর্যন্ত নানাকেই জ্ঞানী হিসেবে উপস্থাপনের পক্ষে মত বেশি আসে। যুক্তি দেখানো হয়: প্রবীণের অভিজ্ঞতার আলোকে নানা-নাতির কথার যুক্তি বেছে নিয়ে নতুন মাত্রা যোগ করে সমস্যার সমাধান দেয়ার চেষ্টা চালান গম্ভীরার দুই গায়েন। গম্ভীরায় নানা-নাতির একজনকে জনগণ অন্যজনকে কর্তৃপক্ষের ভূমিকা রাখতে হয়। গম্ভীরার অবিচ্ছেদ্য অংশ কৌতুক নানার চেয়ে নাতিকেই বেশি মানায়। গম্ভীরার উৎপত্তি অবিভক্ত ভারতের মালদহ জেলায়। পরে তা বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জে আসে। উৎপত্তিকাল সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া যায়নি। ভৌগোলিক দিক থেকে বরেন্দ্রভূমি চাঁপাইনবাবগঞ্জ। উত্তরে ভারতের প্রাচীনকালে আদিবাসী ‘কোচ’ জাতির বাস ছিল। তাদের মিল ছিল রাঢ় অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে। ইন্দোমঙ্গলীয় গোষ্ঠীভুক্ত কোচ জাতি প্রতিবছর একটি অনুুষ্ঠানে সারা বছরের বিবরণী ও পর্যালোচনা করত নৃত্য ও গানে। সমাজের নানা অসঙ্গতি ব্যঙ্গাত্মকভাবে তুলে ধরা হতো। এখান থেকেই উৎপত্তি গম্ভীরার। প্রাচীনকালের গম্ভীরা দুই ধরনের-শিবের গাজন (আদ্যের গম্ভীরা), আর পালা গম্ভীরা। পালা গম্ভীরাই আজকের গম্ভীরা। পালা গম্ভীরায় থাকত সারা বছরের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, সমস্যা ও তার সমাধান। সুখ-দুঃখের কথাগুলো কাউকে বলা হতো প্রতীকীরূপে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর মানুষ সচেতন হয়ে ওঠার বড় মাধ্যম পেয়ে যায় গম্ভীরায়। গায়েন দু’জন ব্রিটিশ সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতির কথা তুলে ধরতেন সুর ও নাচনের আলাপনে। প্রতিবাদের অন্যতম মাধ্যম হয়ে এগোয় গম্ভীরা। দেশ ভাগের পর গম্ভীরার গায়েনরা মালদহ থেকে চাঁপাইয়ে চলে আসে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ঘটতে থাকে গম্ভীরার বিস্তৃতি। এক পর্যায়ে ‘সুফি মাস্টার’ গম্ভীরার হাল ধরেন। স্বাধীনতাউত্তর ’৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তরা গণভবন সফরকালে তার সম্মানে গম্ভীরা পরিবেশন করেন কুতুবুল আলম ও রকিব উদ্দিন। সেদিনের গম্ভীরায় নানা-নাতির সংলাপে উঠে আসে: জাতির পিতা তার ছেলেদের সমান চোখে দেখছেন না। নাতি ঢাকায় দেখেছে বেতারের মধ্যে ছবি দেখা যায়। সেই ছবি কথা বলে, গান গায়। উত্তরা গণভবনও তো এক ছেলে। সেখানে বেতারে ছবি দেখা যায় না। গম্ভীরার এই আলাপনে বঙ্গবন্ধু মুগ্ধ হয়ে সেদিনই নাটোরে বিটিভি উপকেন্দ্রের ঘোষণা দেন এবং গম্ভীরাকে সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। গতি পায় ঐতিহ্যের লোকজ ধারা গম্ভীরা। পরে চাঁপাই ছাড়াও বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহী ও নাটোরে গম্ভীরার অনেক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। রাজশাহী সন্ধ্যা প্রদীপ সাংস্কৃতিক একাডেমির শিল্পীরা গম্ভীরাকে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছেন। সংগঠনের সভাপতি সেলিম জাহাঙ্গীর বললেন, অতীতে গম্ভীরায় নানা-নাতির চরিত্র ছিল না, তখন ছিল মামা-ভাগ্নের। বিষয়বস্তুর গভীরতায় দেখা যায় অনেক ব্যঙ্গ কথা মামা-ভাগ্নের মুখে থাকলে তা দর্শকপ্রিয়তা নাও পেতে পারে। সমাজ কাঠামোয় নানা-নাতির ভালবাসার অবস্থানটি এতই গভীর যে, যে কোন সংলাপ তাদের মুখে থাকলে দর্শক তা সাদরে গ্রহণ করবে-এই চিন্তা থেকে পরে গম্ভীরায় গায়েন চরিত্র বদলে যায় নানা-নাতিতে। সেই থেকে গম্ভীরায় নানা-নাতির অবস্থান পাকাপোক্ত। সেলিম জাহাঙ্গীর গম্ভীরায় নানার ভূমিকা ও মোকসেদ আলী নাতির ভূমিকায় এখন মঞ্চ কাঁপান। গম্ভীরায় সহযোগী হিসেবে থাকে ৬/৭ দোহারি। একজন থাকেন হারমোনিয়াম নিয়ে, একজন তবলা ও একজন জুড়ি বাদক। নানার পরনে থাকে লুঙ্গি, গেঞ্জি, কোমরে গামছা, মাথায় মাথাল, হাতে লাঠি। নাতির পরনে প্যান্ট, গামছায় থাকে কালাইয়ের রুটি। গম্ভীরার শুরু সাধারণত দর্শকের ভেতর থেকে বের হয়ে এসে নাতি নানাকে খুঁজতে থাকে। এই পর্যায়ে মঞ্চে নানা লাঠি নিয়ে তাড়া করে নাতিকে। শুরু হয় পালা। গম্ভীরার বড় বৈশিষ্ট্য হলো : ঘটনার প্রেক্ষিতে নানা-নাতির তাৎক্ষণিক উত্তর তৈরি। এ জন্য নানা-নাতির চরিত্রের শিল্পীকে উপস্থিত বুদ্ধির ও মেধাদীপ্ত হতে হয়। গম্ভীরার ভাষা একান্তই আঞ্চলিক। তবে অঞ্চলভেদে ভাষা বুঝতে অসুবিধা হওয়ায় পরিবর্তনও করতে হয়। সেলিম জাহাঙ্গীর জানান, তাদের একাডেমি দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে গম্ভীরা করেছে। পরিবেশনের সময় ভাষা বুঝতে না পারায় চট্টগ্রামে বিকল্প কথা পাঞ্চ করা হয়। গম্ভীরার অপর বৈশিষ্ট্য হলো- অনুষ্ঠানে যিনি প্রধান অতিথি থাকেন লিঙ্গভেদে তাকে বড় নানা বা বড় নানি সম্বোধন করা হয়। বিষয়বস্তুর অনেক কিছু বড় নানা বড় নানির উদ্দেশে ছুড়ে দেয়া। অনেক স্থানে এই সম্বোধনকে কেউ ‘স্যার’ বা ‘মাডাম’ বলেন। গম্ভীরার ভাবে তখন কিছুটা ব্যত্যয় ঘটে। ইদানীং প্রতিটি জেলায় গম্ভীরা চর্চা শুরু হয়েছে। তবে খুবই ধীরগতিতে। চাঁপাই ও রাজশাহীর সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোতে গম্ভীরা যুক্ত। গম্ভীরাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এগিয়ে নেয়ায় আজকাল ভাটা পড়েছে। কখনও গম্ভীরায় মূল থিম ভিন্নখাতে নেয়া হচ্ছে। নাটক, সিনেমায় গম্ভীরার উপস্থিতি কম। গম্ভীরার শিল্পীও তৈরি হচ্ছে না।
×