ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী রূপে পূজিত হলো শিশু প্রশংসা প্রিয়তা

প্রকাশিত: ১০:১২, ৭ অক্টোবর ২০১৯

 রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী রূপে পূজিত হলো শিশু প্রশংসা প্রিয়তা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ লাল বেনারসি, কপালে রক্ত ও শ্বেত চন্দনের টিপ, পায়ে আলতা, মাথায় মুকুট, গলায় স্বর্ণ আর ফুলের মালা, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, চোখে কাজল আর ডান হাতে পদ্মফুল দিয়ে সাজিয়ে দুর্গাষ্টমীতে কুমারী দেবীকে পূজা করলেন ভক্তরা। সকাল থেকেই কুমারীপূজা উপলক্ষে রাজধানীর রামকৃষ্ণ মিশনে ঢল নামে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের। মহাঅষ্টমীতে দেবী দুর্গা বন্দনার পাশাপাশি আয়োজন করা হয় কুমারী মায়ের পূজা। দেশের সব রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে মহাসমারোহে কুমারী পূজা হয়েছে। ভক্তরা বলছেন, শারদীয় দুর্গোৎসবের অষ্টমীর অন্যতম আকর্ষণ হলো ‘মা’ কুমারী। পাশাপাশি দুর্গাদেবীর কল্পারম্ভ, বিহিত পূজা, সন্ধিপূজার মধ্যদিয়ে মহাঅষ্টমী শেষ হয়েছে। আজ সোমবার হবে মহানবমী। শাস্ত্রমতে, কুমারী পূজার উদ্ভব হয় কোলাসুরকে বধ করার মধ্য দিয়ে। গল্পে বর্ণিত রয়েছে, কোলাসুর এক সময় স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করায় বাকি বিপন্ন দেবতারা মহাকালীর শরণাপন্ন হন। তিনি সব দেবতার আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবী পুনর্জন্মে কুমারীরূপে কোলাসুরকে বধ করেন। এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু। কুমারীদের মধ্যে দেবীভাব প্রবল তা বিশ^াস করতেন শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব। তার বিশ্বাস থেকেই স্বামী বিবেকানন্দ কুমারী পূজার প্রচলন করেন। কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব হলো নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। এই বিশ^াসে কুমারীকে দেবীরূপে সাধনা করা হয়। জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় বীজ অপার নিহিত কুমারীতে। তাই তাকে দেবীরূপে সাধনায় মিলিত হন ভক্তরা। বিশদভাবে বললে, বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের যে ত্রিশক্তি বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়। এই সাধনপদ্ধতিতে সাধকের কাছে বিশ্বজননী কুমারী নারীমূর্তির রূপ ধারণ করে। তাই তার কাছে নারী ভোগ্যা নয়, পূজ্য। পৌরাণিক কল্পকাহিনীতে বর্ণিত আছে: এ ভাবনায় ভাবিত হওয়ার মাধ্যমে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজের স্ত্রীকে ষোড়শীজ্ঞানে পূজা করেছিলেন। অসাম্প্রদায়িকতার বার্তা ॥ রামকৃষ্ণ মিশনে যে কন্যা শিশুটি কুমারী মাতারূপে পূজিত হয়েছে ’১৫ সালের পহেলা বৈশাখের দিন পৃথিবী আলো করে প্রশংসা প্রিয়তা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভক্তদের প্রতি আশীর্বাদ হিসেবে তার কণ্ঠে ভেসে আসে অসাম্প্রদায়িকতার সুর। বললেন, সব ধর্মের মানুষের রক্ত একই। ঢাক ঢোল, বাদ্য আর ভক্তদের উলুধ্বনির মধ্য দিয়ে পূজিত হয় পাঁচ বছরের প্রশংসা প্রিয়তা। শাস্ত্র মতে, এ সময় তার নামকরণ করা হয় ‘সুভগা’। বাবার কোলে চড়ে লাল টুকটুকে বেনারসি পরে আরকে মিশনে আসা প্রিয়তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, মৃন্ময়ীরূপে মা দুর্গা তার মধ্যে জাগ্রত। মায়াবী মুখে কিছুটা ভয়, দুষ্টুমিভরা দৃষ্টি আর আনন্দের ঝিলিক ছিল ছোট্ট প্রিয়তার অভিব্যক্তিতে। ভক্তদের কাছ থেকে পুষ্পাঞ্জলি গ্রহণ করে প্রিয়তা বলেন, ‘হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান- সবার একই রক্ত, একই প্রাণ। আস, আমরা সবাই মিলেমিশে থাকি। তোমাদের জন্য এই আমার আশীর্বাদ’। এবারের কুমারী মা প্রশংসা প্রিয়তা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা প্রিয়শংকর বন্দ্যোপাধ্যায় কে এল জুবলী স্কুল এ্যান্ড কলেজের ইংরেজী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। মা গায়ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায় ফজলুল হক মহিলা কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। চাইল্ড হেভেন আইডিয়াল হাইস্কুলের প্লে গ্রুপে পড়াশোনা করছে প্রিয়তা। লক্ষ্মীবাজারে তাদের বাসা। পূজা শেষে ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের ধর্মে সর্বোচ্চ আসন দেয়া হয় নারীকে। নারীরূপে মাকে। দুর্গা পূজার মাধ্যমে আমরা জগতের মাকে পূজা করি। জগৎজননী দুর্গার মানবিক প্রতীক এবং প্রতিমা কুমারীর মধ্যে তার সর্বাধিক প্রকাশ বলে দুর্গা পূজার সময় ‘কুমারী পূজা’ করি। তিনি বলেন, কুমারীকে পূজা করার জন্য কোন জাতি ধর্ম-বর্ণ বিচারের দরকার নেই। সব জাতির সব বর্ণের কুমারীকে পূজা করার বিধান আছে। তবে আমাদের শাস্ত্র অনুসারে ব্রাহ্মণ কন্যাকেই পূজা করা হয়ে থাকে। এক থেকে ষোলো বছর পর্যন্ত ব্রাহ্মণ বালিকাদের কুমারী পূজার জন্য নির্বাচিত করা হয়ে থাকে। তবে শাস্ত্র অনুসারে ১ থেকে ৫ বছরের কন্যাকেই উপযুক্ত মনে করা হয়। প্রশংসা প্রিয়তার বাবা প্রিয়শংকর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, আমার মেয়েকে কুমারী পূজার জন্য বাছাই করা হয়েছে। এ জন্য আমার খুবই ভাল লাগছে। তিনি বলেন, আমার দুই মেয়ে। দুজনই কুমারী পূজার আসনে বসেছে। বড় মেয়ে প্রণিতা উষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় ’১৫ সালে। আর এবার ছোট মেয়ে প্রশংসা কুমারী পূজায় বসার সুযোগ পেয়েছে। প্রিয় শংকর বলেন, সবাই আশীর্বাদ করবেন। আমার মেয়ে বড় হয়ে যেন শক্তিরূপে সমাজ থেকে অসুরশক্তি দূর করতে পারে। আর মাতৃরূপে আর্তমানবতার সেবা করতে পারে। কুমারী পূজা উপলক্ষে রামকৃষ্ণ মিশনে এসেছিলেন ভারতসহ বিভিন্ন দেশের ধর্মাবলম্বীরা। তারাও ভক্তিসহকারে পূজায় অংশ নেন। ভক্তরা বলেন, নারীকে দেবীরূপে পূজা করা হচ্ছে। আমরা মনে করি নারী তার কর্ম, মেধা ও যোগ্যতা বলে সমাজে সবার সম্মানের জায়গায় থাকবেন। নারীদের কেউ আর অবহেলা করবে না। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের স্বামী ধ্রুবেশানন্দ বলেন, সকাল ৬৭টা ৩০মিনিটে অষ্টমীপূজা আরম্ভ হয়। পুষ্পাঞ্জলি শুরু হয় দুপুর বারোটায়। তিনি বলেন, পূজার উদ্দেশ্য সব মানুষের কল্যাণ কামনা। সব ধর্মের, সব জাতির, সব বর্ণের মানুষের সুখ-শান্তি কামনা। নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, পুলিশ র‌্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর নিরাপত্তাকর্মীরা সর্বক্ষণিক পূজামন্ডপগুলোতে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। আশা করছি, সবার সহযোগিতায় সব অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে শেষ করতে পারব। মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্যামল রায় বলেন, শারদীয় দুর্গোৎসবের মধ্য দিয়ে মানবজাতির এই শাশ্বত সংগ্রামের বার্তাই ঘোষিত হয়। দেবী দুর্গা মাতৃস্বরূপা, শক্তিরূপিনী। অসুর বধ করে তিনি শুভবুদ্ধির পথ দেখান। পুরোহিতরা বলছেন, অষ্টমী আর মহানবমীর মিলনক্ষণে বধ হয়েছিলেন মহিষাসুর। তাই অষ্টমী ও নবমীর মধ্যবর্তী সময়ে সন্ধিপূজা করা হয়েছে। মহাঅষ্টমীর সকাল থেকে রাজধানীর পূজা ম-পগুলো ঢাকের বাদ্য শঙ্খ ও উলুধ্বনিতে মুখরিত হয়। অঞ্জলি দিতে ঢল নামে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের। চলে প্রসাদ বিতরণ। বিকেল থেকে শুরু হয় প্রতিমা দর্শনের পালা। দলে দলে মানুষ আসতে থাকে বিভিন্ন পূজা মন্ডপে। পূজা উপলক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বর্ণিল আলোকসজ্জা ছিল চোখে পড়ার মতো। বনানী মাঠের আশপাশের রাস্তায় আলোকসজ্জা দেখলেই বোঝা যায় এ উৎসব সার্বজনীন। সবাই যে যার মতো করে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন। সন্ধ্যার ভোগ আরতির পর থেকে বিভিন্ন মন্দিরে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর্ব। নাচে-গানে মতোয়ারা থাকে ভক্তরা, নানা আয়োজন চলে মধ্যরাত পর্যন্ত।
×