ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গীবাদ দমনে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ এবং করণীয়

প্রকাশিত: ০৮:২৬, ৭ অক্টোবর ২০১৯

 জঙ্গীবাদ দমনে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ এবং করণীয়

(শেষাংশ) চারদলীয় ঐক্যজোট সরকারের সময়ে ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং জঙ্গীবাদের ভয়াবহতা দেশব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। বাংলা ভাই, আব্দুর রহমানসহ অন্যান্য শীর্ষ জঙ্গী নেতারা তাদের প্রশিক্ষিত সদস্যদের দ্বারা জেলায় জেলায় ঘোষণা দিয়ে বোমা হামলা করেছিল এবং ফলশ্রুতিতে হতাহত হয়েছিল সাধারণ জনগণ, আতঙ্কে ছিল সর্বস্তরের লোকজন। আদালত প্রাঙ্গণে, পাবলিক প্লেস এবং সিনেমা হলে বোমা চালিয়ে সমগ্র দেশে অরাজকতার রাজনীতির গোড়াপত্তন করেছিল জঙ্গীরা। যে কোন মূল্যে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার প্রয়াসে লিপ্ত হয়ে উঠেছিল চরমপন্থী এবং অন্ধকারে থাকা রাজনৈতিক উগ্রপন্থী দলগুলো। সে সময়কার কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জঙ্গীবাদের মদদ দিয়েছিল। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা তাঁদের মাঠের শক্তি হিসেবে সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করেছিল। মূলত অপরাজনীতি, বিরাজনীতিকরণ, রাজনৈতিক অপরাধ বৃদ্ধি, বিনা কারণে সাধারণ জনগণের ওপর মামলা হামলা, পুলিশের দুর্নীতি, রাজনীতিবিদদের কালো টাকার মালিক বনে যাওয়া, রাজনৈতিক ভাবে দেওলিয়াপনা ইত্যাদি ইস্যুগুলো সামনের কাতারে চলে এসেছিল। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, সরকার এবং প্রশাসন জঙ্গীবাদী কার্যক্রমকে মদদ দিয়ে এহেন গর্হিত কাজের উৎসাহ দিয়েছিল এবং তরুণ প্রজন্মকে ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে ন্যক্কারজনক কর্মকান্ড ঘটাত। একই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অস্থিমজ্জায় ধর্মের বিকৃতি ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে এবং আর্থিক প্ররোচনাসহ নানাবিধ সুযোগ-সুবিধার যোগসূত্রের প্রয়াসে মানবতাবিরোধী সহিংস কর্মকা-ে জড়াতে সক্ষম হয়েছিল কুচ-ীমহল তথা জঙ্গীবাদী গোষ্ঠীগুলো। ধর্মীয় জঙ্গীবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের মারাত্মক পরিণতি সাধারণ মানুষকে খুব বেশি হতাহত করে থাকে। ১৯৯৯ সালের বছরের শুরুতেই অসাম্প্রদায়িক কবি, তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবি শামসুর রাহমান নিজ বাড়িতে ধর্মীয় মৌলবাদীদের দ্বারা গুরুতর আহত হন। উদীচী আয়োজিত নববর্ষের অনুষ্ঠানে উগ্রবাদীদের বোমা হামলায় ১০ জন নিহত এবং ১০৬ জন আহত হয়। ঐ ঘটনার পর থেকেই বাংলাদেশে উগ্র জঙ্গীবাদীদের আক্রমণ এবং প্রভাব ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে। খুলনায় আহমাদিয়াদের মসজিদে বোমা হামলায় ৮ জন নিহত এবং ৪০ জন মারত্মকভাবে আহত হয়। এ ঘটনাগুলো সবকটাই ধর্মীয় উগ্রবাদীদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল অর্থাৎ ধর্মীয় জঙ্গীবাদে আদিষ্ট ঘটনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে সব থেকে ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসমাবেশে আহূত গ্রেনেড হামলাটি। এ ঘটনাটি বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছিল কিন্তু তৎকালীন সরকার বিষয়টিকে মামুলি বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিল। উক্ত গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন মানুষ মারা যায় এবং আহত হয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রায় ৫০০ জন, যাঁরা আজও সেই আঘাতের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন। সেই সময়ের রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা দলটি জজমিয়া নাটকের মাধ্যমে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। পাশাপাশি বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের রাজনীতি কায়েম করে চিরকালীন ক্ষমতায় থাকায় পরোক্ষ উদ্দেশ্য ছিল দেশবিরোধী চক্রের। কিন্তু সত্য কখনও চাপা থাকে না, এখন বিষয়টি খুবই স্পষ্ট, কাদের ইশারা ইঙ্গিতে হামলা ঘটিয়েছিল উগ্রবাদীরা, তা আজ জাতির নিকট খুবই পরিষ্কার। আর কেনইবা সে হামলাটি করানো হয়েছিল সেটি অনুধাবনের জন্য তত বেশি জ্ঞানতাপস না হলেও চলবে। গুলশানের হলি আর্টিজান হোটেল ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার ঈদগাহের মাঠে জঙ্গীদের অতর্কিত হামলা উগ্রবাদীদের উপস্থিতিকে জানান দেয়। কিন্তু সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কারণে এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে সচেষ্ট ভূমিকার কারণে হুমকি প্রায় নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো, নতুন প্রজন্মের মেধাবী ছেলেমেয়েদের বিপথগামীরা বিপথের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বর্তমানে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা জঙ্গীবাদী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে, পাশাপাশি নারীরা জঙ্গীদের সঙ্গে নিজেদের একীভূত করছেন সাম্প্রতিক সময়ে। যে বিষয়গুলো সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় অনুশাসনে ভাবনার উদ্রেক ঘটায়। কাজেই, বীজে ফল আসার পূর্বেই অঙ্কুরেই তা বিনষ্ট করতে হবে নচেৎ এসব গর্হিত কাজের জন্য দেশ ও জাতিকে চরম মূল্য দিতে হবে। জঙ্গীবাদের দোষে আদিষ্ট হওয়ার চক্রে বেশ কিছু পরিকল্পিত কারণ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে এবং ঐ বিষয়গুলো জঙ্গীবাদের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয় বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে। বেকারত্ব, কর্মসংস্থানের অভাব, দারিদ্র্যতা, প্রকৃত শিক্ষার অভাব, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা প্রদান, দেশী বিদেশী চক্রান্তের বিষবাষ্প, আর্থিক প্ররোচনা, পিয়ার গ্রুপের উদ্বুদ্ধকরণ ও ক্ষমতালিপ্সু মনোবৃত্তি জঙ্গীবাদের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে থাকে। সুশাসনের অভাব, সহিংস আচরণের দিকে রাজনীতিবিদদের প্ররোচনা, বিভিন্ন সেক্টর থেকে জঙ্গীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান ইত্যাদি কারণগুলোও জঙ্গীবাদের বিচরণক্ষেত্র হিসেবে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিও বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের গোড়াপত্তন ও বিস্তারের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। তাত্ত্বিক লিউয়েন দেখিয়েছেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বৃদ্ধি, সম্পদ এবং মুনাফার মধ্যে ঘাটতি, ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের বিস্তার, প্রযুক্তির উৎপত্তি এবং বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ জঙ্গীবাদের শিকার। পল উইলকিনসন দেখিয়েছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের নেতিবাচক ভূমিকা, জাতিগত দ্বন্দ্ব, ডান/বাম মতাদর্শে অন্ধত্ববাদ এবং ধর্মীয় উগ্রতা বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের উৎপত্তির জন্য দায়ী। এছাড়া উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ গ্রহণে ব্যর্থতা, সুশাসনের অভাব, সহিংস রাজনীতি এবং আঞ্চলিক উগ্র পরিস্থিতি ইত্যাদি কারণগুলো বাংলাদেশ জঙ্গীবাদের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। আলোচ্য বিষয়গুলোই বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ দমনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে থাকে। জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের রাজনৈতিক চক্রান্তকে ধূলিসাৎ করার জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তবে উদ্যোগ গ্রহণের প্রাথমিক শর্ত হতে হবে জনগণকে যে কোন মূল্যে উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মূলনীতিকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় উপয্ক্তু ও প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিনিধির মাধ্যমে পরিচালিত করতে হবে, যেখানে কমিউনিটির প্রত্যেকটি সদস্য পুলিশিং এর সাথে সম্পৃক্ত থাকবে। জঙ্গীবাদের অর্থায়ন বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগকে স্বউদ্যোগী হয়ে মানি লন্ডারিং, কালো টাকা বৈধকরণ ও পাচার বন্ধে আধুনিক ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জঙ্গীবাদের অর্থায়নে দেশীয় যে সব প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন সহায়তা করে থাকে তাদের তালিকা সবিস্তারে জনসন্মুখে প্রকাশ করা। যাতে করে সচেতন নাগরিকেরা এসব ঘৃণিত প্রতিষ্ঠানের সাথে কোনভাবেই সংযোগ না রাখে এবং ঐসব প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। পাশাপাশি জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষকদের কঠোর বিচারের সম্মুখীন করে উদাহরণ সৃষ্টি করা যাতে পরবর্তী সময়ে কোন দল বা গ্রুপ কিংবা ব্যক্তি পরোক্ষভাবে হলেও জঙ্গীবাদের কার্যক্রমে সম্পৃক্ত না হয়। তাছাড়া জঙ্গীদের অস্ত্রের যোগানদাতা বা অস্ত্রের উৎসমুখ বন্ধ করতে অস্ত্র উদ্ধারে র‌্যাব পুলিশ সমন্বয়ে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় লেবেল পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রমে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধকারী পাঠ্যক্রমের বিষয়ে ব্যাপক নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ, যে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে (বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে) জঙ্গী সহায়ক বই পুস্তক পাওয়া যায় সেদেশে স্কুল, কলেজের লাইব্রেরিতে অনুসন্ধান ও নজরদারি রাখতে হবে নিয়মিতভাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার জাতি গঠনের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। বাংলার চিরায়ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিকাশের লক্ষ্যে স্কুলভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। কারণ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রচার ও প্রসারের এবং অনুশীলনের মাধ্যমে সামাজিক অনাচার, বিশৃঙ্খলা ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে সহজেই একীভূত করা যাবে। কাজেই, সরকারসহ জনগণকে একই কাতারে এসে জঙ্গীবাদ নির্মূলের জন্য আধুনিক এবং কৌশলী ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ছেলেমেয়েদের স্কুলিং ও শিক্ষা পদ্ধতি সম্বন্ধে অভিভাবকদের নিয়মিত খোঁজ-খবর নিতে হবে। ছেলেমেয়েদের পিয়ার গ্রুপ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়েও অভিভাবকদের সম্পৃক্তায়ন জরুরী হয়ে পড়েছে। শেষত: কাঁটা দিয়ে কাঁটা উপড়ে ফেলার পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। যে সব জঙ্গী কারাগারে রয়েছে তাদেরকে দিয়ে অন্য জঙ্গী গ্রেফতার করা, তাদের সার্বিক কার্যক্রম সম্বন্ধে অবগত হওয়া, জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষকদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা, অস্ত্রের যোগানদাতা সম্বন্ধে জানা, প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত তথ্য উদ্ধার করে সেসবের মূলোৎপাটন করা যেতে পারে নিমিষেই। জঙ্গীদের আন্তর্জাতিক যোগসূত্র সম্বন্ধেও বিশেষ করে প্রশিক্ষণ, তথ্য সরবরাহ ও আর্থিক যোগানদাতা ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে জঙ্গীবাদের রদকরণ সম্ভব হবে বলে মনে করি। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীন দেশ কখনোই জঙ্গীবাদের আদর্শে পরিচালিত হতে পারে না। তাই; দলমত নির্বিশেষে সকলকে জঙ্গীবাদের রাজনৈতিকায়নের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত থাকার পাশাপাশি অন্যদেরকেও সুরক্ষা রাখার চেষ্টা ও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। লেখক : প্রভাষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×