ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দলের অন্তর্কলহে সাংগঠনিক কর্মকান্ডে স্থবিরতা

সিলেট আওয়ামী লীগের ওপর হাইকমান্ড ক্ষুব্ধ

প্রকাশিত: ১০:২১, ৬ অক্টোবর ২০১৯

সিলেট আওয়ামী লীগের ওপর হাইকমান্ড ক্ষুব্ধ

সালাম মশরুর, সিলেট অফিস ॥ সিলেটে আওয়ামী লীগ তাদের দৈন্যদশা ঘোচাতে পারছে না। সরকারের এতো উন্নয়ন সত্ত্বেও সেই সুফল তারা কাজে লাগাতে পারছে না। নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে রাজনৈতিক মাঠে দলের অবস্থান হতাশাজনক। জাতীয় নেতৃবৃন্দের কাছেও বিষয়টি এখন খোলাসা হয়ে গেছে। গত বৃহস্পতিবার সিলেটে আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আনম শফিকুল হকের স্মরণ সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সিলেটে দলের আভ্যন্তরীণ অবস্থা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। গত বুধবার সিলেটে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় সিলেটে আওয়ামী লীগের কর্মকা- নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছেন সভায় যোগদানকারী আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য সাংসদ তোফায়েল আহমদ, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ। মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, ২০১৫ সালে সিলেটে এসে শুনে গিয়েছিলাম যে কয়টি কমিটি আছে ২০১৯ সালেও এসে শুনি এগুলোই আছে। নতুন করে কোন ইউনিটের কমিটি করা হয়নি। এটা অবশ্যই ব্যর্থতার পরিচয়। দায়িত্বশীলদের উচিত ছিল এই ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করা। হানিফ বলেন, সিলেটে যে কয়বার সভা করতে আসি, শুনি আপনারা ঐক্যবদ্ধ হবেন। কিন্তু আজও আপনারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেননি। শুক্রবার সিলেটে আওয়ামী লীগের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি নিয়েও কথা বলেন দলটির সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটি আগামী ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে গঠন করা হবে। সিলেট আওয়ামী লীগ নিয়ে তিনি বলেন, সিলেটের সবচেয়ে বড় সমস্যা সংগঠনে কলহ। এই কোন্দল মেটাতে না পারলে আমরা ফল কোনদিনও পাব না। নির্বাচনে আমরা হেরে যাই, কারণ আমরা নিজেরাই নিজেদের শত্রু। তিনি বলেন, আপন ঘরে যার শত্রু, তার শত্রুতা করার জন্য বাইরের শত্রু দরকার নেই। সিলেটের অবস্থাও তেমন। তাই বিভক্তি ঝেড়ে ফেলে ঘরের মধ্যে ঘর করা, পকেট কমিটি করা, এসব থেকে বিরত থেকে দুঃসময়ের কর্মীদের কোণঠাসা না করে তাদের দলের বিভিন্ন পদে স্থান দিন। ৯০-এর দশকে সিলেটে আওয়ামী লীগ যখন নিজেদের সংগঠিত করার কথা তখন রাজনৈতিক সম্প্রীতির সুর তোলে সকল দলের সঙ্গে মিলে মিশে সম্প্রীতির রাজনীতি নিয়ে তারা এগুতে থাকে। এতে লাভবান হয়েছে বিএনপি, জামায়াত। আওয়ামী লীগের কথিত সম্প্রীতির রাজনীতির সুবাদে তারা রাজনীতির মাঠে সংগঠিত হয়েছে। পিছিয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে দাপিয়ে বেড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু রাজনৈতিক সম্প্রীতির কারণে পরবর্তীতে সেই সুফল তারা ভোগ করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ নেতা বদর উদ্দিন কামরান সিটি মেয়র হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন দুই যুগ। দলের রাজনৈতিক তৎপরতায় তার উপস্থিতি ছিল নামমাত্র। তিনি আওয়ামী লীগের নেতা হলেও দলমত নির্বিশেষে সর্বদলীয় নেতা হওয়ার প্রচেষ্টা করতে গিয়ে নিজের অস্থিত্বকে সঙ্কটের মুখে ফেলেছেন। দলে বিভক্তি তৈরি হয়েছে। দলের জন্য যেমন উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারেননি, তেমনি সিটির উন্নয়নেও উল্লেখযোগ্য আবদান রাখতে পারেননি। এতে নির্বাচনকালীন সময়ে তার কাছে থাকা ভিন্ন দলের লোকেরা সরে গেছে সে সঙ্গে দলের লোকেরাও তেমন এগিয়ে আসেনি। নিজের ব্যর্থতার দায়ভার নিজেকেই নিতে হয়েছে। সরকারের এত উন্নয়ন, নিজের দীর্ঘ সময়ের ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও বদর উদ্দিন কামরান নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেননি। নানান দুর্নামের কারণে তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে যায়। দল ক্ষমতায় থাকার পরও দুই দফা সিটি মেয়র নির্বাচনে তাকে পরাজিত হতে হয়েছে। দলের অধিকাংশ নেতাই একলা চলনীতিতে সময় অতিবাহিত করার কারণে দলে ভা-ারে তেমন অর্জন নেই। দীর্ঘদিন যাবত জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগে খরা চলছে। দলের জৌলুশ হারিয়ে গেছে। গত ২০ বছর যাবত সিলেট আওয়ামী লীগ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পথ চলছে। বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী দায়িত্ব নেয়ার পর কিছুটা প্রাণের সঞ্চার হয়। কিন্তু সেটাও যেন এক সময় ঝিমিয়ে যায়। মহানগরের অবস্থা আরও নাজুক। ছাত্র নেতা থেকে যারা আওয়ামী লীগে এসেছেন তারাও নিরুত্তাপ। এর মধ্যে দু-একজন আছেন তাদের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটছে। মহানগরের অধিকাংশ ওয়ার্ডে দল চলছে এনালগ পদ্ধতিতে। মাসে ২ মাসেও একবার তাদের বৈঠক হয় কিনা সন্দেহ আছে। ৬নং ওয়ার্ড কমিটিতে যারা আছেন তারা অধিকাংশই পুঁথির মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বার্ষিকীসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দিনের বিষয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। কমিটি গঠনের পর বছরেও হয়তো একদিন সকল কর্মীকে নিয়ে বৈঠক হয়নি। বিগত নির্বাচনে এই ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা কাজ করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। ৬নং ওয়ার্ড থেকে গত ৩ বারের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ থেকে একজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পারেনি। অথচ এই ওয়ার্ডে বিএনপির দু’জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। যিনি জয়লাভ করেছেন তিনি বিএনপির, যিনি দ্বিতীয় হয়েছেন তিনিও বিএনপির। এখানে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের অবস্থা একই বৃত্তে আবদ্ধ। এই ওয়ার্ডে এখন নেতাকর্মী মিলে একটি বড় মিছিল দেয়ারও ক্ষমতা রাখেন না তারা। মহানগর আওয়ামী লীগের এমনি দন্যদশা যে বিগত সিটি নির্বাচনে অধিকাংশ ওয়ার্ড থেকেই তারা তাদের সমর্থিত প্রার্থী দিতে পারেনি। বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিএনপির একাধিক প্রার্থী ছিল। বর্তমানে সিটি কর্পোরেশনে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলরের সংখ্যা বেশি। বিগত সিটি নির্বাচনের পূর্বে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদরউদ্দিন আহমদ কামরান ও সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিনের মধ্যে প্রার্থী হওয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে আসে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মহানগরের কমিটিগুলোর ওপর নিজেরা আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালান। তাতেই ভাগাভাগি হয়ে যায় নেতা কর্মীরা। এক পর্যায়ে মেয়র পদে বদর উদ্দিন আহমদ কামরান কেন্দ্রের সমর্থন পেলেও দলের সকল নেতা কর্মীরা মনে প্রাণে এক হয়নি। ওয়ার্ড কমিটিগুলো নিস্ক্রিয় হয়ে গেলেও কর্মীরা অসন্তষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে দলের প্রধান নেতা হয়েও তাদের ওপর চাপ দিতে পারছেন না। ৫নং ওয়ার্ডের যুবলীগ নেতা রিমাদ আহমদ রুবেল ৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিএনপি নেতা ফরহাদ চৌধুরী শামীমকে নিয়ে গত কোরবানির ঈদে চৌকিদেখী বিমানবন্দর সড়কের ওপর এলাকাবাসীর আপত্তি সত্ত্বেও অবৈধভাবে গরুর হাট বসিয়ে ব্যবসা করে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করেছেন। ৫নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের অবস্থা ও মরা গাঙের মতো। মহানগর আওয়ামী লীগের এমন দৈন্যদশায় সাধারণ মানুষ হতাশ। বর্তমানে কেন্দ্র থেকে সম্মেলনের ব্যাপারে নির্দেশ পেয়ে নড়েচড়ে বসেছে সিলেট আওয়ামী লীগ। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় আগামী ৫ ডিসেম্বর সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এর আগে সিলেটের ৭টি উপজেলায় সম্মেলনের মাধ্যমে হবে কমিটি। বাকি ৬টি উপজেলায় থাকা আংশিক কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেয় হয়। জানা গেছে, সর্বশেষ ২০১১ সালের ২১ নবেম্বর সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগে চার সদস্যবিশিষ্ট কমিটি আসে। পরদিন উভয় শাখায় ৭১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। তিন বছর মেয়াদী এ কমিটি ২০১৪ সালের নবেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের কথা ছিল। কিন্তু এরপর আরও প্রায় পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিই চালিয়ে যাচ্ছে দায়িত্ব। এই অবস্থায় সাংগঠনিক কার্যক্রমে ধীরগতি চলে এসেছে বলে তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন আগামী ২০ ও ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে দেশের সকল ইউনিটে দলের সম্মেলন শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছেন সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এরই প্রেক্ষিতে গত ১৫ সেপ্টেম্বর দেশের সকল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীলদের কাছে চিঠি পাঠান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। জেলা ও মহানগর শাখার আওতাধীন প্রতিটি মেয়াদোত্তীর্ণ ইউনিটের সম্মেলন আগামী ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করতে চিঠিতে নির্দেশ দেয়া হয়। সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকগণও এই চিঠি পেয়েছেন।
×