ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী আমদানিকারকরা

প্রকাশিত: ১০:১২, ৬ অক্টোবর ২০১৯

পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী আমদানিকারকরা

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি পেঁয়াজের রফতানি মূল্য বাড়ায় ভারত। এরপর মাসের শেষদিকে এসে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয় প্রতিবেশী দেশটি। এ ঘটনার ব্যাপক প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের বাজারে। পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যায়। সেপ্টেম্বরের শুরুতে ব্যবসায়ীরা যে পেঁয়াজ ৪০-৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন, সেই পেঁয়াজই ২৯ সেপ্টেম্বরের পর ১১০-১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে হঠাৎ করেই পেঁয়াজের দাম বাড়ার বিষয়টি নিয়ে ভোক্তা ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের অভিযোগ কিছু সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটের কারণে পেঁয়াজের দাম এত বেড়েছে। তারা বলেছেন, দেশী ও বিদেশী পেঁয়াজের বড় মজুদ থাকার পরেও মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের মূল্য দ্বিগুণ হতে পারে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হঠাৎ করে পেঁয়াজের এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে প্রথম কারসাজি করেছেন একশ্রেণীর আমদানিকারকরা। ভারতে দাম বাড়ানোর হুজুগ তুলে বাড়তি দামের এলসি খোলার আগেই তারা আগে কেনা পেঁয়াজের দাম দফায় দফায় বাড়িয়েছে। এরপর ভারতে পেঁয়াজ রফতানি যে তারিখে (২৯ সেপ্টেম্বর) বন্ধ হয়, সেদিন প্রথমে কেজিতে তিন টাকা কমালেও দুই দফায় কেজিতে ২৮ টাকা দাম বাড়ানো হয়েছে। অথচ নতুন করে তখনও পেঁয়াজ আমদানি হয়নি। দ্বিতীয় ধাপে পেঁয়াজের পাইকারি বিক্রেতারা দাম বাড়ানোর পেছনে কারসাজি করেছেন। এদের কাছে এখনও দেশী ও বিদেশী পেঁয়াজের বড় মজুদ রয়েছে। ভারতে পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর অজুহাত তুলে তারা দেশী পেঁয়াজেরও দাম বাড়িয়েছে দফায় দফায়। ফলে আমদানি করা ও দেশী পেঁয়াজের দাম দুটোই বেড়েছে। পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর কারণে এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। তৃতীয় দফায় দাম বাড়িয়েছেন খুচরা বিক্রেতারা। এই স্তরের ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ গুদামজাত না করলেও দাম বাড়ার হাবভাব বুঝে এরা কিছু পেঁয়াজ মজুদ করেন। পরে ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে তা বিক্রি করেন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়া শুরু হয় গত কোরবানির ঈদের আগে থেকে। সুবিধাবাদী ব্যবসায়ীদের এই সিন্ডিকেটের কারণে কোরবানির ঈদের সময়েও কোন কারণ ছাড়াই পেঁয়াজের দাম বেড়েছিল। তখনও পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও ঈদে পেঁয়াজের চাহিদার সুযোগ নিয়ে দাম বাড়িয়ে দেন আড়তদাররা। ফলে সে সময় যে পেঁয়াজ ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হতো, তা কোথাও কোথাও ৬৫ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত ওঠে। তবে কোরবানির শেষে দাম কমে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় স্থির হয়। এরপরই ভারত এলসি করা পেঁয়াজের দাম বাড়ালে তার প্রভাব পড়ে স্থানীয় বাজারে। এর সুযোগ নেন আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। দেশী পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও পেঁয়াজের দাম ফের বাড়তে থাকে। নতুন করে এলসি করা পেঁয়াজ দেশে ঢোকার আগেই পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। এদিকে, দাম বাড়ার পেছনে ভারতীয় ব্যবসায়ীরাদেরও হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন হিলি বন্দরের আমদানিকারকরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হিলির কয়েকজন পেঁয়াজ ব্যবসায়ী বলেন, ‘দেশে পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরাই, আমরা শুধু কমিশনে ব্যবসা করি। তাদের কথা মতো আমরা শুধু এলসি করে দেই, বাকি পেঁয়াজ রফতানি থেকে শুরু করে কত দামে বিক্রি করতে হবে, কিংবা বিক্রি করা হবে কিনা, সেটিও তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন। যেমন ধরেন ২৯ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজের রফতানি বন্ধ করে দেয়ার আগেই হিলিতে ১৪টি ট্রাকে করে ২৬৮ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়। রফতানি বন্ধের খবরে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা ৮০ টাকার নিচে পেঁয়াজ বিক্রি করতে হিলির আমদানিকারকদের নিষেধ করে দেন। এ কারণে সেদিন বন্দরে মাত্র দুই ট্রাক পেঁয়াজ ৭৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। যদিও সেদিনের আগে এই পেঁয়াজই ৪৭ থেকে ৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল। পরের দিন এসব পেঁয়াজ ৮০ টাকা থেকে ৮৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। দেশের কোন বাজারে পেঁয়াজের চাহিদা কেমন, তার ওপর নির্ভর করে দাম নির্ধারণ করে দেন তারাই (ভারতীয় ব্যবসায়ী)। অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারত যখন পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখনই সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা কর্মচারীদের মাধ্যমে তা স্থানীয় আমদানিকারকরা জেনে যান। তখন তারা সঙ্গে সঙ্গে তাদের মজুদ পেঁয়াজের বিক্রি বন্ধ করে দেন। একইসঙ্গে আমদানিকারকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে বাংলাদেশে রফতানি করা পেঁয়াজ ছাড়ের ক্ষেত্রেও ঢিলেমির মাধ্যমে সরবরাহে এক ধরনের সঙ্কট তৈরি করা হয়। এই কৃত্রিম সঙ্কটের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমদানিকারক থেকে শুরু করে খুচরা পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। ব্যবসায়ীদের এই অশুভ সিন্ডিকেট ও অতি মুনাফার বিষয়টি উঠে আসে কাওরানবাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী আরমান হোসেনের কথায়। তিনি বলেন, ‘ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে, এমন সংবাদ বেনাপোল বন্দর থেকে এক ব্যবসায়ী টেলিফোনে জানান। একই সঙ্গে তিনি সামনে পেঁয়াজের সঙ্কটের বিষয়েও বলেন। ওই ব্যবসায়ী পরামর্শ দেন, কিছুদিনের জন্য যেন পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ রাখি বা দাম বাড়িয়ে বিক্রি করি। এতে আমরাই লাভবান হব বলেও জানান বেনাপোলের ওই ব্যক্তি। পরে এ সংবাদ এক কান থেকে হাজার কানে পৌঁছে যায়। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।’ বেনাপোলের ওই ব্যবসায়ীর পরিচয় সম্পর্কে আরমান জানান, তিনি একজন আমদানিকারক। ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানিসহ বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসা করেন তিনি। ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের আদেশ দেয় ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায়। এর ১৪ ঘণ্টা পর ৩০ সেপ্টেস্বর সকালে রাজধানীর ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের মুসলিমনগরের খুচরা দোকানে দেশী পেঁয়াজ ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়। এর কারণ জানতে চাইলে দোকানি বিপ্লব হোসেন বলেন, ‘কোন কারণ নাই। এক দাম পাঁচ কেজি ৫৫০ টাকা।’ এ সময় বাড়তি দামে না কিনেও বাড়তি দামে বিক্রি করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ব্যবসার ধরনই এমন। সুযোগ তো বারবার আসে না।’ বিপ্লব আরও জানান, টিভিতে শুনেছি, পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। কাজেই আমরা নিশ্চিত হয়েছি, যে অবশ্যই দাম বাড়বে। তাই বাড়িয়ে বিক্রি করছি। এর নামই ব্যবসা। তবে বাড়তি দামে পেঁয়াজ বিক্রি বা অতি মুনাফার সঙ্গে একটি সিন্ডিকেট জড়িত, সবাই এর জন্য দায়ী নয় বলে দাবি করেছেন রাজধানীর শ্যামবাজারের আমদানিকারক আলতাফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘একতরফা অভিযোগ সঠিক নয়। সব সময় বাজারে আমদানিকারকরা অস্থিরতা তৈরি করে না। কোন কোন সময় সুযোগসন্ধানী মধ্যস্বত্বভোগী একটি চক্র নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে যে কোন নিত্যপণ্যের বাজারকে অস্থির করে তোলে। তারাই বাজারে পণ্যের সরবরাহে সঙ্কট তৈরি করে। অহেতুক দাম বাড়ানোর গুজব ছড়ায়। আর সবকিছু মিলিয়ে এর খেসারত ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কেই দিতে হয় বাড়তি মূল্য।’ তবে বাণিজ্য সচিব ড. মোঃ জাফর উদ্দিন জানান, পেঁয়াজ নিয়ে ভারতের দুই দফা সিদ্ধান্তের পরেও দেশে তাৎক্ষণিক পেঁয়াজের সরবরাহে কোন বিঘ্ন ঘটেনি। চাহিদায়ও সঙ্কট তৈরি হয়নি। বাড়তি দামে আমদানি করা পেঁয়াজও আসেনি। তাই মূল্যবৃদ্ধির কোন কারণ দেখছেন না সরকারের নীতি নির্ধারণী কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘কারা পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছে, বাড়তি দামে না কিনেও কারা দাম বাড়িয়েছে, তা খুঁজে বের করা হবে। সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে কাজ করছে।’ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানান, পেঁয়াজের অতিরিক্ত দাম বাড়ার কোন কারণ নাই। কিছু সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ী এবারের এই সুযোগটি নিয়েছেন। তাদের শনাক্ত করার কাজ চলছে। একইসঙ্গে যারা এ সময়ে পেঁয়াজ বাজারে না ছেড়ে মজুদ করেছেন, তাদেরও খুঁজে বের করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে উৎপাদন হয়েছে ২৩ লাখ ৭৪ হাজার টন। উৎপাদিত পেঁয়াজের ৩০ শতাংশ পচে যায়। যার পরিমাণ সাড়ে সাত লাখ টন। চাহিদার বিপরীতে এটিই ছিল মূলত ঘাটতি। এই ঘাটতি মেটাতে প্রতিবছর ৮ থেকে ১০ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়।
×