ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘শিশু আইনের লক্ষ্য অর্জনে চাই পৃথক শিশু আদালত’

প্রকাশিত: ১০:৩০, ৫ অক্টোবর ২০১৯

 ‘শিশু আইনের লক্ষ্য অর্জনে চাই পৃথক শিশু আদালত’

বিকাশ দত্ত ॥ শিশু আইন সংশোধনের পরও বেশ কিছু বৈসাদৃশ্য এবং অস্পষ্টতা রয়েই গেছে। এখন পর্যন্ত গঠন করা হয়নি শিশুদের জন্য আলাদা আদালত। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারকরাই ভারপ্রাপ্ত বিচারক হিসেব শিশু আদালত পরিচালনা করেন। শিশু আইনের উদ্দেশ্য পূরণে অতিসত্ত্বর শিশুদের বিচারের জন্য আলাদা শিশু আদালত গঠন করার তাগিদ দিয়েছেন বিচারপতি, আইনজীবী ও ইউনিসেফ বাংলাদেশ শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞগণ। তারা বলছেন, আলাদা আদালত গঠনের পাশাপাশি পর্যাপ্ত সংখ্যক বিচারকও নিয়োগ দিতে হবে। শিশু আদালত গঠন হলে শিশু অপরাধীদের বিচারকাজ দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাবে। বর্তমানে সারাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এক লাখ ৭ হাজার ৯৯৪টি শিশু অপরাধের মামলা বিচারাধীন রয়েছে। হাইকোর্টের এক রায়ে বলা হয়েছে, শিশু আইনে বিদ্যমান অসঙ্গতি, অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি রয়েছে যা অবিলম্বে দূর করা প্রয়োজন। আদালত প্রত্যাশা করে সরকার স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। শিশু আইন ২০১৩ এর ধারা ১ (১৬ক), ১৫ক এবং ১৬ (৩) নানা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। ১৫ক এর বিধান বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ এর ধারা ২৭, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ২০০০ এর ধারা ২৭ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ধারা ৪৮ সহ বিভিন্ন বিশেষ আইনের সঙ্গে কেবল সাংঘর্ষিকই নয় অসাংবিধানিকও বটে। শিশু আইনের প্রধান্যতার কারণে যদি যুক্তি দেয়া হয় যে, থানায় দায়েরকৃত মামলা অর্থাৎ জিআর মামলার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধ আমলে গ্রহণ করবেন তা হলে সেটি হবে শিশু আইন প্রণয়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিপন্থী। শুধু তাই নয় একই আইনের অধীনে শিশুর বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে গ্রহণ করবেন ম্যাজিস্ট্রেট, আর প্রাপ্ত বয়স্কদের বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে গ্রহণ করবে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনাল বা ক্ষেত্র বিশেষে, আদালত যা বাস্তবতা বিবর্জিত ও অস্বাভাবিক। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নিজস্ব মামলার ভারে জর্জরিত। সেখানে শিশু অপরাধীদের বিচার করতে তাদের হিমশিম খেতে হয়। শিশু আদালতে যে পরিবেশ থাকার কথা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে সেই পরিবেশ নেই। আলাদাভাবে শিশু আদালত গঠন করা হলে শিশুদের বিচার সুষ্ঠু হবে। পাশাপাশি শিশুদের বয়স নির্ধারণও একটি বড় বিষয়। জন্মনিবন্ধন সনদ দেয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। অনেক শিশু অপরাধী হওয়ার পর সনদ নিয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে অনেক অপরাধী বেশি বয়সে শিশু হিসেবে সনদ নেয়। এই আইনের ৩০ ধারা অনুয়ায়ী কোন আদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে শিশু আদালত নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করবে। যার মধ্যে রয়েছে শিশুর বয়স ও লিঙ্গ, শিশুর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা, শিশুর শিক্ষাগত যোগ্যতা, শিশুর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক অবস্থা, শিশুর পরিবারের আর্থিক অবস্থা, শিশু ও তার পরিবারের জীবনযাপন পদ্ধতি, অপরাধ সংঘটনের কারণ, শিশুর অভিমত, সামাজিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন, শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য আনুষাঙ্গিক বিষয় বিবেচনা। সম্প্রতি আপীল বিভাগের বিচারপতি ইমান আলী এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, শিশু কিশোর অপরাধের বিচারের জন্য আলাদা শিশু আদালত হওয়া উচিত। যেখানে শুধুমাত্র শিশুদের অপরাধের বিচার কাজ চলবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এটি করা উচিত। ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ শাবনাজ জাহেরীন বলেন, শিশু আইনের ২০১৩ এর সাম্প্রতিক সংশোধনীর মাধ্যমে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতকে শিশু আদালত হিসেবে দায়িত্ব পালনের এখতিয়ার প্রদান করা হয়েছে। ফৌজদারী বিচার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ব্যস্ততম এই আদালত মামলার ভারে ভারাক্রান্ত। এই আদালত দ্বারা শিশু আইনে নির্দেশিত শিশুবান্ধব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুদের বিচার করে তাদের সমাজের মূল ¯্রােতে ফিরিয়ে আনা কতটুকু সম্ভব, তা পুনরায় বিবেচনার দাবি রাখে। আমরা বিশ্বাস করি, শিশু আইনের উদ্দেশ্য পূরণে পৃথক শিশু আদালত প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক বলেছেন, একজন শিশু কোন কারণে অপরাধ করলে অথবা মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে পড়লে শিশু আদালতের মাধ্যমে বিচার দ্রুতনিষ্পত্তি করা যায়। খালাস পেলে সে আবার পড়াশুনা করতে পারবে। সাজা হলেও দ্রুত সাজা ভোগ করে সংশোধন হয়ে আসতে পারবে। অন্যদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা হলে তা দ্রুত শেষ হয় না। ওখানে অনেক সময় দেখা যায় ১১(গ) ধারা অনুয়ায়ী স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মারামারি হয়েছে, তা ভাইবোন, শ্বশুর-শাশুড়ির নামেও মামলা দিয়ে দেয়া হয়। এ মামলাগুলো নিষ্পত্তি হতে দেরি হয়। কাজেই শিশুদের বিচারের জন্য পৃথক শিশু আদালত গঠন করা জরুরী। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল বলেছেন, শিশু আদালত কর্তৃক জামিনে মুক্তি প্রদান প্রসঙ্গে শিশু আইনের ২৯ ধারায় (৩) উপধারা সংযুক্ত করে বলা হয়, ‘(১) ও (২) উপধারার অধীন জামিন মঞ্জুর করা না হইলে শিশু আদালত উক্তরূপ নামঞ্জুরের কারণ লিপিবদ্ধ করিবে এবং সংশ্লিষ্ট শিশুকে কোন প্রত্যায়িত প্রতিষ্ঠানে প্রেরণের জন্য আদেশ প্রদান করিবে।’ এক্ষেত্রে উক্ত শিশুর জামিনে মুক্তি প্রদানের বিষয়টি এতটাই সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে যে, (১) ও (২) উপধারায় শিশুর জামিন সম্পর্কে বিস্তারিত বিধান থাকার পরও উপধারা (৩) সংযুক্ত করে জামিন নামঞ্জুরের ক্ষেত্রে এর কারণ লিপিবদ্ধ করার বিধান রাখা হয়েছে এবং এক্ষেত্রে উক্ত শিশুকে কোন প্রত্যায়িত প্রতিষ্ঠানে প্রেরণের জন্য আদেশ প্রদান করার কথাও বলা হয়েছে। এখন এটাই দেখার বিষয় যে, এই ভাল ভাল আইনগুলোর বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব হবে। কারণ বাংলাদেশে বেশ কিছু ভাল আইন থাকলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন বিভিন্ন কারণে থেমে রয়েছে। সুতরাং আমরা আশা করব যে শিশু আইন সম্পূর্ণ রূপে বাস্তবায়িত হবে। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমান এক রায়ে বলেছেন, শিশু আইনে সাংঘর্ষিক, বিদ্যমান অসঙ্গতি, অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি অবিলম্বে দূর করা প্রয়োজন। আদালত এটাও প্রত্যাশা করে সরকার এজন্য দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সরকার শিশু আইন সংশোধন অথবা শিশু আইন ২০১৩ এর ধারা ৯৭ বিধান মূলে গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা অস্পষ্টতা ও অসঙ্গতি দূর করতে পারে। চলতি বছরের পহেলা আগস্ট হাইকোর্ট রায় প্রদান করে। ২২ আগস্ট পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। শিশু আইন সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত সাত দফা নির্দেশনা অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে আরও বলা হয়, আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে ধারা ১৫ক-এর কারণে শিশু আদালতের বিজ্ঞ বিচারকের মধ্যে এক ধরনের সংশয় ও বিভ্রান্তি কাজ করছে। যেহেতু ধারা ১৫ক-অনুযায়ী শিশু আদালতের অপরাধ আমলে গ্রহণ করার এখতিয়ার নেই, সেহেতু বিচার শুরু হওয়ার পূর্বে শিশুর জামিন, বয়স কিংবা রিমান্ড বিষয়ে ‘শিশু আদালত’ হিসেবে আদেশ প্রদান যুক্তিসঙ্গত নয়। সে কারণে আমাদের কাছে আরও প্রতীয়মান হয়েছে যে, অপরাধ আমলে গ্রহণের আগে শিশু সংক্রান্ত বিষয়ে শিশু আদালতসমূহ বিভিন্ন ধরনের আদেশ প্রদান করলেও বিজ্ঞ বিচারকরা শিশু আদালত হিসেবে ক্ষমতা প্রয়োগে দ্বিধাগ্রস্ত। শিশু আইনের ধারা ২৯(১) ও ৫২(১) নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করলে সহজেই বুঝা যায় আইনের উপরোক্ত বিধান দু’টিকে ফৌজদারী কার্যবিধিসহ বা আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইন বা শিশু আইনের অন্য কোন বিধানে ভিন্নরূপ যা কিছুই থাকুক না কেন তা থেকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ধারা ১৫ক-এর বিধানে যাই থাকুক না কেন শিশু আইনের ধারা ২৯(১) ও ৫২(১) বিধানের প্রাধান্যতা অক্ষুণ্ণ থাকবে। এই প্রাধান্যতার কারণে অপরাধ আমলে গ্রহণের আগেই শিশুর জামিন, হেফাজত বা ধারা ২১ অনুসারে বয়স নির্ধারণে শিশু আদালতকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সুতরাং এ সংশয় বা বিভ্রান্তি থাকার কোন যুক্তি বা ভিত্তি নেই যে, ধারা ১৫ক অনুযায়ী অপরাধ আমলে গ্রহণ পূর্বক কাগজাদি শিশু আদালতে প্রেরণের পূর্বে শিশু আদালতের ক্ষমতা প্রয়োগের কোন এখতিয়ার নেই। আমাদের বিবেচনায় এ ক্ষেত্রে আইনের বিধান খুবই স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট। আপীল বিভাগের বিচারপতি ঈমান আলী বলেছেন, শিশু কিশোর অপরাধের বিচারের জন্য আলাদা শিশু আদালত হওয়া উচিত। যেখানে শুধুমাত্র শিশুদের অপরাধের বিচার কাজ চলবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এটি করা উচিত।
×