ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ঘুুরে দাঁড়াতে পারছে না বিএনপি, চরম সঙ্কটে

প্রকাশিত: ১০:২৯, ৫ অক্টোবর ২০১৯

 ঘুুরে দাঁড়াতে পারছে না বিএনপি, চরম সঙ্কটে

শরীফুল ইসলাম ॥ কোন অবস্থাতেই রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না বিএনপি। দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় সাজা মাথায় নিয়ে কারাবন্দী হওয়ার পর থেকে সঠিক নেতৃত্বের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে দলটির সবকিছুতেই এখন অনিশ্চয়তা। না পারছে আন্দোলন করতে, না পারছে দল গুছিয়ে এগিয়ে যেতে। এ পরিস্থিতিতে দলটি এখন চরম সঙ্কটে। সূত্র মতে, খালেদা জিয়া কারাবন্দী থাকায় এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গ্রেফতারের ভয়ে লন্ডন থেকে দেশে না ফেরায় বিএনপিতে এখন চরম নেতৃত্ব সঙ্কট চলছে। কারাবন্দী হওয়ার পরও খালেদা জিয়া তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে যাওয়া দলীয় নেতা ও আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে দল পরিচালনার বিষয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা দিতেন। কিন্তু এখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেভাবে আর নির্দেশনা দিতে পারছেন না। আর বিদেশ থেকে দল পরিচালনা করতে গিয়ে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় বার বার হোঁচট খাচ্ছেন তারেক রহমান। এ ছাড়া দেশে অবস্থান করা দলের সিনিয়র নেতারাও পরস্পরের প্রতি আস্থা রেখে কাজ করতে পারছেন না। এ কারণে বর্তমানে দলটির সর্বস্তরে চলছে চরম বিশৃঙ্খলা। কারও ওপর কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই নেতাকর্মীরা লাগামহীনভাবে যখন যা খুশি তাই করছে। উল্লেখ্য, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার আগে দলের সকল কর্মকা- তার নির্দেশেই পরিচালিত হতো। তবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তিনি সিনিয়র নেতাদের মতামত নিতেন। গত বছর ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা মাথায় নিয়ে তিনি কারাবন্দী হন। তবে কারাবন্দী হওয়ার আগেই তিনি সিদ্ধান্ত দিয়ে যান তার অনুপস্থিতিতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা মিলে যে সিদ্ধান্ত নেবেন তারেক রহমানের মতামত নিয়ে সে সিদ্ধান্ত যেন বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর স্থায়ী কমিটির সদস্যরা কোন সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। তারেক রহমান লন্ডনে বসে যখন যে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছেন তাই দলে কার্যকর হয়েছে। এ নিয়ে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও দলের পদ হারানোর ভয়ে সরাসরি প্রতিবাদ করছেন না কেউ। আর সিনিয়র নেতারা কিছু না বলায় অন্যান্য স্তরের নেতারাও নীরবে সব সহ্য করে যাচ্ছেন। যে কারণে দলীয় কোন কর্মসূচীতে আগের মতো আর নেতাকর্মীদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। এদিকে ক্লিন ইমেজের অধিকারী বলে পরিচিত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও দলের অনেক সিনিয়র নেতা মানতে চান না। এ জন্য মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর যখন যা ভাল মনে করেন তাই করার চেষ্টা করেন। আবার কখনও কখনও খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের নির্দেশ পেয়ে কোন কোন সিদ্ধান্ত নেন। তবে মহাসচিবের সিদ্ধান্ত মানতে চান না দলের কিছু সিনিয়র নেতা। তাই মহাসচিবের সঙ্গে যোগাযোগ না করেই তারা একেক সময় একেক রকম কথা বলেন। এ ধরনের কথার কারণে দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বিব্রত হন। আবার তারেক রহমান নিজে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা নন তার ঘনিষ্ঠ এমন অনুসারীদের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা জানিয়ে দেন। এ বিষয়টিকেও দলের সিনিয়র নেতারা ভালভাবে নিতে পারেন না। যে কারণে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তারা আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করেন না। এ পরিস্থিতিতে চেন অব কমান্ডের অভাবে বিএনপির রাজনীতি চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। জানা যায়, মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির মুখপাত্র হওয়ার কথা। চেয়ারপার্সন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে দলীয় কোন বক্তব্য তুলে ধরার কথা মহাসচিবের কিংবা তিনি যাকে মনোনীত করবেন তার। কিন্তু বিএনপির ক্ষেত্রে তেমনটি দেখা যায় না অধিকাংশ সময়ই। দেখা যায়Ñ একই বিষয়ে সকালে সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এবং বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কখনও কখনও দেখা যায় একেক সংবাদ সম্মেলনে একেক নেতা একেক রকম কথা বলেন। এর ফলে মিডিয়া ও দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর কাছে ভুল বার্তা যায়। আবার দেখা যায় একেক অনুষ্ঠানে একেক নেতা একেক রকম কথা বলেন। কখনও কখনও এক নেতা অন্য নেতার সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন। এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটিয়ে দলটি কিভাবে এগিয়ে যাবে এ নিয়ে সর্বস্তরের নেতাকর্মীর মধ্যে অনিশ্চয়তার বিষয়টি সামনে চলে আসে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দলের নির্বাচিত এমপিরা সংসদে যাবে না এবং বর্তমান সরকারের অধীনে আর কোন নির্বাচনে যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। কিন্তু এক পর্যায়ে দলীয় হাইকমান্ডের ইচ্ছায় বিএনপির এমপিরা সংসদে যোগ দেয়। এর পর দলের হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে সকল নির্বাচনে দলের অংশগ্রহণের কথা জানিয়ে দেয়া হয়। সিনিয়র নেতাদের মতামত না নিয়ে লন্ডনে বসে তারেক রহমান এ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ায় বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতারা তার ওপর নাখোশ হয়। তবে দলে অবস্থান খর্ব হতে পারে ভেবে তারা এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নেননি। সর্বশেষ ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠন নিয়েও নানান সমস্যা সৃষ্টি করা হয় বিএনপির ভেতর থেকেই। কাউকে কিছু না বলে দলীয় হাইকমান্ড কাউন্সিলের আগেই হঠাৎ করে কমিটি ভেঙ্গে দেয়। এর পর কাউন্সিলের উদ্যোগ নিয়ে অছাত্রদের নতুন কমিটিতে রাখা হবে না বলে জানিয়ে দেয়া হয়। বিএনপি হাইকমান্ডের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছাত্রদলের অধিকাংশ নেতাকর্মী সহিংস আন্দোলন শুরু করার পাশাপাশি বিএনপি কার্যালয়ে ভাংচূর ও দলের সিনিয়র নেতাদের নাজেহাল করে। এ পরিস্থিতিতে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে ছাত্রদলের ১২ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু বহিষ্কৃত ছাত্রদল নেতারা তাদের অনুসারীদের নিয়ে লাগাতার আন্দোলন শুরু করে এবং বিএনপি কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির সিনিয়র নেতারাও বহিষ্কারের পক্ষে-বিপক্ষে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। অবস্থা বেগতিক দেখে তারেক রহমান বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে বয়সসীমা তুলে দিয়ে নতুন কমিটি করার নির্দেশ দেন। কিন্তু মির্জা আব্বাসের বাসায় আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে রাতের আঁধারে কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে ছাত্রদলের নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করে আবারও বিপাকে পড়ে বিএনপি। কারণ, এ কমিটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদালত। আদালতের এ নির্দেশের পর খোদ বিএনপি নেতাকর্মীরাই এখন বলাবলি করছে-কাউন্সিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও কার পরামর্শে বিএনপি হাইকমান্ড তড়িঘড়ি করে মির্জা আব্বাসের বাসায় ছাত্রদলের কাউন্সিলরদের জড়ো করে রাতেরবেলায় ভোট গ্রহণ ও নতুন নেতা নির্বাচন করা হলো। এদিকে দেশে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু রাজধানীতে বিএনপির কার্যক্রম নেই বললেই চলে। ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতৃত্বে থাকা অধিকাংশ নেতা দলীয় কর্মকান্ডের চেয়ে ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে। বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদেরও একই অবস্থা। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি না পারছে সরকার বিরোধী আন্দোলন করতে, না পারছে সর্বস্তরে দল গুছিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে। এ কারণে, দলটির সামনে এখন চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। এখানে নানা মত ও পথের মানুষের সমন্বয় ঘটেছে। এ ছাড়া বিএনপিকে এখন নানা প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে রাজনীতি করতে হচ্ছে। তাই পথ চলতে গিয়ে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এ ছাড়া দলের চেয়ারপার্সনের অনুপস্থিতিতে স্বাভাবিক কারণেই বিভিন্ন কার্যক্রমে কিছুটা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। তবে সঙ্কট কেটে গেলে সব সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে।
×