ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বুড়িগঙ্গার শাখা নদীর ৩৫০ একর জমি বেদখল

প্রকাশিত: ১০:১৫, ৫ অক্টোবর ২০১৯

 বুড়িগঙ্গার শাখা নদীর ৩৫০ একর জমি বেদখল

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ রাজধানী ঢাকার কণ্ঠহার বুড়িগঙ্গা দক্ষিণ-পশ্চিমে শাখা-প্রশাখার দুই তীর আবার দখলে মেতে উঠেছে চিহ্নিত ভূমিদস্যুরা। পুরান ঢাকার লালবাগ, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের কোলঘেঁষা বুড়িগঙ্গার এই শাখা নদী দখলদারদের অত্যাচারে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। এক সময়ের খর স্রোতা বুড়িগঙ্গার শব্দ দুই থেকে তিন মাইল দূর থেকে শোনা যেত। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী ও উচ্চ আদালতের বারবার কঠোর নির্দেশের পরও বুড়িগঙ্গার এই আদি চ্যানেলটি প্রতিনিয়তই দখল হচ্ছে। জলাধার সংরক্ষণ আইনের বিধি উপেক্ষা করে প্রায় তিন যুগ ধরে চলা দখলযজ্ঞে ইতোমধ্যেই এ আদি চ্যানেলের শাখা নদীর প্রায় ৩৫০ একর জায়গা বেদখল হয়ে গেছে। এ দখল প্রক্রিয়ার কৌশল হিসেবে সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য, বালু ফেলে ভরাট করে নদীর বুক সংকুচিত করা হয়। পরে এসব জায়গায় গড়ে তোলা হয়, শিল্পকারখানা, আবাসন প্রকল্প ও রিক্সা-ট্রাকস্ট্যান্ড। বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা তৈরি করে সাপ্তাহিক/মাসিক হারে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করে সংঘবদ্ধ চক্র। মাঝেমধ্যে ডিসির উদ্যোগে সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সরকারী সংস্থা বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল রক্ষায় নদীর দুই তীর দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযান চালায়। অভিযানে স্থায়ী ব্যবস্থা না নেয়ায় আবার ভূমিদস্যুদের রাহুগ্রাসে চলে যায় বুড়িগঙ্গা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিনের পর দিন এভাবে দখল-দূষণ চলতে থাকলে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই পুরান ঢাকায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতে পারে। তারা জানান, নদী দখলদারদের রোধ করতে হলে তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালিয়ে জেল জরিমানা আদায় করলে নদী দখলমুক্ত করা সম্ভব। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ভূমি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে নদী, খাল, দখলমুক্ত করা সম্ভব। এছাড়া পুরান ঢাকার নাগরিক সমস্যা সমাধানে অচিরেই বুড়িগঙ্গার শাখা নদীর দুই তীর দখলমুক্ত করতে স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। এদিকে জেলা প্রশাসন ও ডিএসসিসি বলেছে, বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার সব খাল-জলাধার দখলমুক্ত করতে প্রায়ই অভিযান চালানো হচ্ছে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পর ওইসব স্থানে ওয়াকওয়ে নির্মাণসহ সৌন্দর্যবর্ধনের নানা প্রকল্প নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সরেজমিনে কথা বলে জানা গেছে, বাবুবাজার ব্রিজ থেকে গাবতলী পর্যন্ত রাজধানীর দক্ষিণ-পশ্চিমের বেড়িবাঁধের কোলঘেঁষে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ-পশ্চিমের শাখা নদীর লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ ও মোহাম্মদপুরে বিস্তীর্ণ এলাকার প্রায় ২৪ হাজার ৫শ’ কাঠা (৩৫০ একর) একর বেদখল ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে। লালবাগ-চকবাজারের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন কামালবাগ-আলীরঘাট, শহীদনগর, আমলীগোলা, কামরাঙ্গীরচরের মুসলিমবাগ ঠোঁটা থেকে বেড়িবাঁধ ঘেঁষা লোহারপুল, রহমতবাগ, ব্যাটারিঘাট, কুড়ারঘাট, পূর্ব রসুলপুর, নবাবগঞ্জ সেকশন, কোম্পানীঘাট পাকা ব্রিজ ঘেঁষা বালুমাটি আর সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ফেলে নদী ভরাট করে দোকানপাট, ট্রাক-লেগুনা স্ট্যান্ড গড়ে তোলা হয়েছে। লালবাগ বড় মসজিদ ঢাল ও পূর্বরসুলপুর ২ নং গলির সংযোগ হাফেজ মূসা ব্রিজ, নবাবগঞ্জ সেকশন ও কামরাঙ্গীরচর রনি মার্কেটের সংযোগস্থলে নির্মিত পাকা ব্রিজ ঘেঁষা বিশাল এলাকা দখল করে মার্কেট ও বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। আমলীগোলা ঢাল সংলগ্ন বেড়িবাঁধ ঘেঁষা বুড়িগঙ্গার বুকে ময়লা-আর্বজনা ফেলে স্তূপ করে। সেখানে ট্রাকস্ট্যান্ড, পাশের নদীর বুকে পুরো দখল করে মাটি ফেলে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে নদীর বুক দখল করে ৫তলা পাকা দালান, টিনশেড বাড়িঘর বানানো হয়েছে। নবাবগঞ্জ সেকশন ও কামরাঙ্গীরচর রনি মার্কেটের সংযোগস্থলের পাশে আদি চ্যানেলের বুকে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে বক্স কালভার্ট নির্মাণ করায় পশ্চিমে নদী দখলের মহোৎসব চলছেই। বক্স কালভার্টে বর্জ্য ফেলায়, দখল-দূষণে বুড়িগঙ্গা এখানে মৃতপ্রায়। বুড়িগঙ্গার আদি এ চ্যানেলে রিক্সার গ্যারেজ থেকে শুরু করে টেম্পোস্ট্যান্ড, অবৈধ মার্কেট, ট্রাকস্ট্যান্ড, বাড়িঘর, এমনকি মসজিদ পর্যন্ত গড়ে উঠেছে। এছাড়া কোম্পানীঘাটে বিদ্যুত উপকেন্দ্রের চারপাশে নদীর বিশাল জায়গা দখল করে ম্যাটাডোর বল পেন, ম্যাটাডোর ফাউন্ডেশনের প্রস্তাবিত শিশু বিনোদন কেন্দ্র, ম্যাটাডোর জামে মসজিদ ও পান্না ব্যাটারি ফ্যাক্টরি গড়ে তোলা হয়েছে। হাউসিং ব্যবসায়ীরা নদীর বিশাল অংশ দখলের পর ভরাট করে প্লট আকারে বিক্রি করছে। বছরের পর বছর এসব অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠলেও সেসব দখলবাজি প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সবসময়ই নির্বিকার ভূমিকা পালন করে চলেছে। দেখা গেছে, কামরাঙ্গীরচর-হাজারীবাগের সেকশন বেড়িবাঁধ সংলগ্ন শাখা নদীর দু’পাশে সেমিপাকা ঘর, দোকান, গ্যারেজ বানানো হয়েছে। এসব দোকান থেকে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক হারে নিয়মিত ভাড়া আদায় করছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব দখল-দূষণ আর চাঁদাবাজিতে সম্পৃক্ত রয়েছে এলাকার ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা! এভাবে বেওয়ারিশ লাশের মতো বুড়িগঙ্গার বুক বালু দিয়ে ভরাট করে রাতারাতি দখল করে নিচ্ছে চিহ্নিত ভূমিদস্যুরা। জেলা প্রশাসক ও ভূমি জরিপ অফিসের এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে এসব ভূমিদস্যু মালিকানা কাগজপত্র বানিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করার পর তা দখলে নিয়ে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন জনের কাছে বিক্রি করে সটকে পড়ছে। এ বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান জনকণ্ঠকে জানান, বুড়িগঙ্গার পশ্চিমের এই শাখা নদীতে পালতোলা নৌকা, লঞ্চ, স্ট্রিমার, ইঞ্জিন বোটসহ বড় বড় নৌযান চলাচল করত। স্রোতের কলধ্বনি এক থেকে দুই মাইল দূর থেকে শোনা যেত। অথচ মাত্র তিন যুগের ধরে দখলে বুড়িগঙ্গা এখানে শীর্ণকায়। ঢাকা জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, চকবাজার, লালবাগ, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীচরের মধ্য দিয়ে গত শতকের মাঝামাঝিও বুড়িগঙ্গায় স্বচ্ছ পানি প্রবাহিত হতো। ১৯১২ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত প্রথম ভূমি জরিপে (ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে, সিএস) এটা প্রবাহমান নদী হিসেবে বুড়িগঙ্গা চিহ্নিত। চল্লিশের দশকে বুড়িগঙ্গায় দখলবাজি শুরু হয়। স্থানীয়রা শুষ্ক মৌসুমে নদীগর্ভে ধান চাষ করে তাদের প্রাথমিক দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এ সময় সিএস রেকর্ডে পরিবর্তন এনে বিভিন্ন দাগের দখলদার হিসেবে ভূমিদস্যুদের নাম বসিয়ে দেয়া হয়। সিএস রেকর্ডের এই বদলকে ‘পেটি সিএস’ বলা হয়ে থাকে ১৯৫৪ সালে এসএ (সার্ভে অব আর্টিকেল) রেকর্ড প্রণয়নকালে সিএস রেকর্ডের অনেক পরিবর্তন ধরা পড়ে। পেটি সিএসে নিজেদের অবস্থান দেখিয়ে দখলদাররা সংশ্লিষ্ট দাগের জমি জেলা প্রশাসন থেকে ইজারা নেন এবং এসএ রেকর্ডে তা লিপিবদ্ধ করা হয়। ’৭২ সালের সংশোধিত দখল জরিপের রিভাইজড সার্ভেতে (আরএস) দখলদাররা নদীর জমি তাদের দখলে দেখিয়ে মালিকানা পাকাপোক্ত করে নেয়। এর আগে-পরে ইজারাপত্র দেখিয়ে অনেকে জমি বিক্রি করে দেয়। সূত্র মতে, আশির দশক থেকে বুড়িগঙ্গার বুক ভরাট করে ঘরবাড়ি নির্মাণের হিড়িক পড়ে। ’৯৭ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছন (দক্ষিণ) থেকে লালবাগের নবাবগঞ্জ হাজারীবাগ, এমনকি মিরপুরের গাবতলী হয়ে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করায় বাঁধের ভেতরে বুড়িগঙ্গার বিশাল এলাকা পড়ে যায়। জালিয়াত চক্র এভাবেই নদীর জমি পুরোটা গ্রাস করে। আশির দশকে তুরাগের ডান তীরে ‘মরা’ বুড়িগঙ্গার প্রবেশ মুখে একটি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও বহুতল ভবন নির্মাণ করে বুড়িগঙ্গার এই অংশটির অপমৃত্যু ঘটানো হয়। এর দেখাদেখি আশপাশের দখলদাররাও ঘরবাড়ি বানায়। বুড়িগঙ্গায় দখলের মহোৎসব চলে জোট সরকার আমলেও। এ সময়ে কতিপয় প্রভাবশালীরা বুড়িগঙ্গায় দখল প্রক্রিয়া পুরোদমে শুরু করে দেয়। জোট সরকারের আমলে গাবতলী থেকে শুরু করে নবাবগঞ্জ সেকশন পর্যন্ত নদীর বুকে বালি বর্জ্য ফেলে ভরাট করে দখলে নেয় ভূমিদস্যুরা। তিন বছর আগে নদীর বুকে বাঁশ পুঁতে ঘেরাওয়ের সময় শ্রমিকদের হাতেনাতে ধরে থানা পুলিশের মাধ্যমে মামলা করে তাদের জেলহাজতে পাঠানো হয়। অথচ বুড়িগঙ্গার কত জমি বেহাত হয়েছে তার সঠিক হিসাব ঢাকা জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া যায়নি। সরকারের খাস জমি দেখভালের দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, লালবাগ, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর এলাকায় বেহাত জমির পরিমাণ প্রায় ৩৫০ একর। এর মধ্যে ২৫০ একর জমি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরে এবং একশ’ একর বাঁধের ভেতরে পড়েছে। ’১৪ সালের ২৩ জুন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ, বিআইডব্লিউটিএর ঢাকার চার নদীর দখলরোধে মানববন্ধন ও র‌্যালিতে যোগ দেন সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি যানজট ও দূষণমুক্ত নির্মল ঢাকা গড়ে তুলতে নদী-খাল রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। কিন্তু সেই আহ্বানে জনগণ সাড়া দিলেও ভূমিদস্যুদের হামলা-মামলার ভয়ে তা প্রতিরোধ করার আগ্রহ সবাই হারিয়ে ফেলে। গত ২৬ জানুয়ারি ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যার দখল-দূষণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ে জরুরী বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ বাস্তবায়নে নৌ প্রতিমন্ত্রীর উদ্যোগে ২৯ জানুয়ারি সোয়ারিঘাট থেকে দখল-দূষণ রোধে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে বিআইডব্লিউটিএ ও পাউবো। টানা ৩ মাস উচ্ছেদ অভিযান চললেও অদৃশ্য ইশারায় উচ্ছেদ অভিযান হঠাৎ রহস্যজনক কারণে থেমে যায়। এখানে নদীর বুক দখল করে গড়ে ওঠা ম্যাটাডোর, পান্না, হাজী মধু সিটিসহ অসংখ্য আবাসন ও শিল্পকারখানা উচ্ছেদ করা হয়নি। শুধু লোক দেখানো কিছু অংশের আবর্জনা তুলে নদী পাড়েই জমাট করে রাখা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বুড়িগঙ্গা এভাবে দখল হতে থাকলে রাজধানীর নিম্নাঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। তারা বলেছেন, ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে শীঘ্রই কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে নদী রক্ষা কমিটি গঠন জরুরী। নদী রক্ষা কমিটির সদস্যরা এসব ভূমিদস্যু ও ভূমি অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মকতা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে জেল-জরিমানাসহ কঠোর শাস্তি কার্যকর করলে কেবল নদী দখলমুক্ত হতে পারে। উচ্ছেদের নদীগর্ভে দ্রুত ওয়াকওয়ে করতে হবে। নইলে দেশের মানচিত্র থেকে বুড়িগঙ্গার শাখা-প্রশাখা চিরতরে হারিয়ে যাবে।
×