ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শহুরে চটুল সুরে হারিয়ে যাচ্ছে শিকড়ের লোকগান

প্রকাশিত: ১০:১৪, ৫ অক্টোবর ২০১৯

 শহুরে চটুল সুরে হারিয়ে যাচ্ছে শিকড়ের লোকগান

গৌতম পান্ডে ॥ নদীর বুকে পালতোলা নৌকার মাঝিদের গলায় এখন আর শোনা যায় না ‘মনমাঝি তোর বৈঠা নেরে আমি আর বাইতে পারলাম না।’ মাঠে কৃষকরা এখন আর খালি গলায় গায় না ‘নক্সিকাঁথার মাঠেরে আজো কান্দে রূপাই মিয়ার বাঁশের বাঁশি।’ ‘বাঙালীর গোলাভরা ধান আর গলায় গলায় গান’ -প্রবাদটি এখন কথার কথা। হাজার জাতের ধানের সঙ্গে গানও হারিয়ে গেছে। ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়া, জারি-সারি, বাউল-মুর্শিদি, মারফতি, কবিগান, কীর্তন এ রকম কয়েকটি লোকগীতির নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হলেও এর ধারা কিন্তু এখন সমান বহমান নয়। ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে মানুষের মনন ও দার্শনিকতায় জারিত হয়ে লোকগীতির উদ্ভব, বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছিল। মহাকালের প্রভাবে সে পরিবেশের রূপান্তর ঘটেছে। লোকগীতিও তার কনটেকচুয়াল পটভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছে। নদ-নদী, খালে-বিলে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকার ভট ভট আওয়াজের মধ্যে নির্জন এককের গান ভাটিয়ালি গাওয়া শোনা দু-ই অসম্ভব। ভাওয়াইয়াও এখন আর গাড়িয়াল বন্ধু, মৈষাল বন্ধু কিংবা খর¯্রােতা নদীর নাইয়া বা মাঝির গান নয়। গরু-মোষের গাড়িও নেই, বৈঠা বা দাঁড়টানা নৌকাও নেই। ক্ষেত্রবিশেষে নৌকাবাইচ থাকলেও নৌকার সারি গান নেই বললেই চলে। ক্ষেতনিড়ানির সারি গানও বিলুপ্ত। এখন ক্ষেত-খামারে যারা কাজ করে তারা মোবাইলে সিনেমার চটুল গান শোনে। ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়াসহ আমাদের লোকগান গানই বহুকাল আগেই মাঠ-ঘাট, বিল-বাঁওড়, হাওড়-নদী ছেড়ে উঠে এসেছে শহরের আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় তারকাখ্যাতি-প্রত্যাশী হঠাৎ আবির্ভূত শিল্পীর কণ্ঠে। বেতারে একসময় পল্লীগীতি নামেও প্রচুর লোকগানের প্রচার হতো। গ্রামের কৃষক-শ্রমিক-মজুর সে গান শুনত বিশেষ আগ্রহ নিয়ে। শহুরে মধ্যবিত্ত সংস্কৃতিমনা সমাজের মানুষও সে গান শুনে আনন্দ পেত। বেতার বা রেডিও এখন চলে গেছে জকিদের দখলে। সেখানে জোকারি যতটা হয়, ইঙ্গ-বঙ্গ বা বাংরেজি ভাষায় শুধু কথার কেরিকেচার যতটা হয়, ততটা সময় নিয়ে কখনোই কোন লোকগীতির আসর বসে না। সেখানে সিনেমার চটুল গানই বেশি বাজানো হয়। লোকশিল্পী ও গবেষক ইন্দ্রমোহন রাজবংশী এ প্রসঙ্গে বলেন, এক কথায় লোকগান ধ্বংসের মুখোমুখি। একে খুঁজে বের করা, চর্চা ও সংরক্ষণের বিষয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো যারা এখন লোকগান গাইছে তাদের কণ্ঠমাধুর্যে সেই মাদকতা নেই। নেই এ কারণে যে তাদের সাধনা নেই। যদিওবা কারও কণ্ঠে সেই মাদকতা আসছে তারাও টিকতে পারছে না ডামাডোলে। অযোগ্য জিনিসগুলো উঠে আসছে, যোগ্য নিচে পড়ে যাচ্ছে। আমাদের মিডিয়াতে তেল-পানি একই দাম। পুরনো শিল্পীদের তারা বর্জন করেছে। টিভিতে আমাদের কথা বলতে ডাকে কিন্তু গান গাইতে ডাকে না। এখনও যে আমরা গাইতে পারি, এখনও যে আমাদের নিয়ে ভাল গান হতে পারে, এ বিষয়টা তারা ভুলে গেছে। এখানে কর্পোরেট পুঁজি এখানে লেগে গেছে। এখানে সুন্দরী মেয়েদের অগ্রাধিকার পুরুষরা অচল। সঙ্গীত শিক্ষা বা চর্চার নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে দেশে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েও অনেক দিন থেকে সঙ্গীত বিভাগ খোলা হয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে একজন আব্বাসউদ্দীন, আবদুল আলীম, কছিমুদ্দিন, নীনা হামিদ, ফেরদৌসী রহমান, ফরিদা পারভীন কিংবা মমতাজের মতো শিল্পীর আবির্ভাব ঘটছে না। বরং ভুল সুর, ভুল উচ্চারণে (কখনও বা শুদ্ধ উচ্চারণে অর্থাৎ আঞ্চলিক ভাষার টোনালবৈশিষ্ট্য ভুল মনে করে) হরহামেশাই গাওয়া হচ্ছে লোক গান। শিল্পী কিরণ চন্দ্র রায় বলেন, লোকগান আমাদের মাটির গান। একটি বৃক্ষ মাটিতেই জন্মে, এর জন্য লাগে বাতাস আর জল। এটাকে যদি মাটি থেকে উপড়ে ফেলা হয়, বা কেউ যদি এটা করতে চায়, সেটা যেমন কল্পনা করা যায় না, আমাদের লোকগানের দশাটা আজ সেই পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। এর সঠিকতা নিয়ে কোন চর্চা হচ্ছে না, কিন্তু ব্যাপকতা বেড়েছে। বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্কৃতির মাধ্যমে এর ব্যাপকতা বাড়লেও শুদ্ধতা লোপ পেয়েছে। যারা লোকগান করতেন তারা অনন্তকাল ধরে গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে তাদের যে সম্পর্ক ছিল তা তাদের রক্তে উজ্জীবিত করেছিল লোকগান গাওয়ার প্রয়ানে। কিন্তু ওই জায়গাটি আজ হয়ে গেছে সাজানো। এটা এখন উচ্চবিত্ত মুখরোচক নাগরিক কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কালের ¯্রােতধারা এত গতিসম্পন্ন যে সব ভাসিয়ে উজাড় করে নিয়ে যাচ্ছে। এখন শিল্পের মাধ্যম দাঁড়িয়েছে ইউটিউব। এটা অত্যন্ত একটা অস্থির মাধ্যম। আজ যদি সারা বিশ্বে কোন কারণে এই নেটওয়ার্কটা স্তব্ধ হয়ে যায়, কাল তো এর কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না। তখন কি হবে? এর জন্য গবেষণাগার, সংগ্রহশালা, সংরক্ষণ ও একটি ব্যাপক অনুরাগী গোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যদি তৈরি করা না যায়, তাহলে ভবিষ্যত অন্ধকার। প্রাতিষ্ঠানিক বা গুরুমুখী শিক্ষা দিয়ে এক ধরনের সাঙ্গীতিক দক্ষতা হয়তো অর্জিত হয়, কিন্তু লোকগানের গায়কী ছাড়াও আঞ্চলিক ভাবানুষঙ্গ বা বিশেষ ঢং ও উচ্চারণ রপ্ত করা কঠিন। লোকগীতি আসলে কোন প্রথাগত সঙ্গীত চর্চা নয়, এতে মানুষের প্রাণের আকুতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হয়। গায়কের মেজাজ, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত ও পরিবেশের ওপর লোকগীতির গায়নরীতি অনেকটাই নির্ভর করে। প্রখ্যাত লোকসঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছেন, ‘লোকসঙ্গীতের ঘরানা নেই, আছে বাহিরানা।’ বাংলাদেশে বর্তমানে লোকসঙ্গীতকে ঘরবন্দী করে বাইরের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটানো হয়েছে। ‘বাহিরানা’ প্রসঙ্গে আরও বলতে হয়, এখনও গ্রাম-গ্রামান্তরে অনেক প্রতিভাবান লোকসঙ্গীত ¯্রষ্টা ও শিল্পী পড়ে আছে যাদের যথাযথ মর্যাদা দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসতে পারলে বাংলা লোক গানের প্রসার বাড়তে পারে। লোকসঙ্গীত শিল্পী, গবেষক ও সংগ্রাহক মুস্তাফা জামান আব্বাসী এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, অনাদরে, অবহেলায় মরতে বসেছে লোকগান। লোকগানের অবস্থা ভাল না। কারণ, ব্যান্ড এসে গেছে, এরা গ্রামে গ্রামে যাচ্ছে বড় বড় যন্ত্র নিয়ে। ফলে আগে যে বাউল গান, ভাটিয়ালি গান, বিচ্ছেদি গানের বড় বড় আসর হতো সেগুলো এখন আর হয় না। তার মানে হলো, গ্রাম বংলার লোকও আজকাল লোকগান শোনে কম, ফলে নতুন শিল্পী উঠে আসাও ক্রমে বন্ধ হওয়ার পথে। আব্বাসউদ্দিন, আব্দুল আলীম মারা গেছেন, রথীন্দ্রনাথ রায়, নীনা হামিদের মতো কেউ কেউ চলে গেছেন বিদেশে। এতে তৈরি হয়েছে বড় রকমের শূন্যতা। এ মুহূর্তে টিভি- রেডিওতে যারা গাইছেন তাদের অধিকাংশেরই শিল্পী হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মুস্তাফা জামান আব্বাসী। বর্তমানে দেশে বাউল গানই সবচেয়ে জনপ্রিয়। প্রায় সব বয়সের শ্রোতাই সবটা না বুঝলেও এ গান শুনে আন্দোলিত ও আপ্লুত হয়। অন্যদিকে বাউলসাধক ও গীত রচয়িতার সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। বাউলের আখড়ায় যে সাঙ্গীতিক আবহ তৈরি হয় সেটি এখনকার শহরের চোখধাঁধানো, বর্ণিল আলোচ্ছটায় এবং হুল্লোড়ে ভরা মঞ্চে নানা ধাতব বাদ্যযন্ত্রের উচ্চগ্রামের কর্ণপীড়ক শব্দের মধ্যে পাওয়া যায় না। বাউল গানে নানা বিকৃতি ও পরিবর্তন আসছে। তা সত্ত্বেও প্রবীণ বাউল গুরু যারা এখনও গান করছেন তারা তাদের সাধনমার্গের অঙ্গ হিসেবেই করছেন। তারা গুরুপরম্পরায় পাওয়া বাণী ও সুর মেনেই গান গাইছেন। তবে নতুন প্রজন্মের বাউল গায়করা রাতারাতি খ্যাতি লাভ এবং নিজেকে তারকাশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর। নানা কালোয়াতি করে শ্রোতার মন মাতানোই তাদের কাছে মুখ্য, বাউল গানের আদি সুর-বাণী এবং বক্তব্য নিয়ে তাদের তেমন মাথা ব্যথা নেই। ইদানিং ব্যান্ড বা রক মিউজিক যারা করছেন তারা তাদের নিজস্ব স্টাইলে ইচ্ছে মতো সুর বদলে বাউল গান গাইছেন। এদের ব্যঞ্জনার চেয়ে বড় হয়ে উঠছে দর্শক-শ্রোতাকে উত্তেজিত করে একটা উন্মত্ত পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রবণতা। আবার কোন কোন শিল্পী বাউল গানের ফিউশনও করছেন, যা মঞ্চে ও টিভিতে প্রচার হচ্ছে। এসব কারণে বাউল গানের আদি সুরকাঠামো ভেঙ্গে যাচ্ছে। বলা যেতে পারে প্রজন্মগত ব্যবধান কিংবা জেনারেশন গ্যাপে আমাদের ঐতিহ্যবাহী গেরুয়া আলখেল্লা পরা বাউলের পাশাপাশি জিন্স-টিশার্ট পরা (নারী-পুরুষ উভয়ই) অনেক বাউল শিল্পীর দেখা মিলছে। আব্দুল আলীমের ছেলে লোকগানের শিল্পী আজগর আলীম বললেন, লোকসঙ্গীতের দূরবস্থা চলছে। অনেক জায়গায় লোকগান পরিবেশন হচ্ছে। কিন্তু তার মূল ধারা থেকে অনেকেই বেরিয়ে আসছে। যেখানে দোতারা, বাঁশি বা একতারা দরকার সেখানে চলছে গিটার, কিবোর্ডে। এভাবে লোকগীতি হারিয়ে যেতে বসেছে। লোকগানের বাণী ও সুরের অনেক বিকৃতি ঘটছে। আগে লোকগান যারা লিখতেন, আবদুল লতিফ, মমতাজ আলী খান, কসিম উদ্দিন, সিরাজুল ইসলাম, কানাইলাল শীল তারা যত বড় মাপের গুণীশিল্পী ছিলেন তাদের মতো গীতিকার সুরকার আর হচ্ছে না। সেসব কণ্ঠও আর নেই। বিউটি, নোলক বাবু গাইছে- কিন্তু সুরের বিকৃতি ঘটচ্ছে। এখন লোকগান যেভাবে ফিউশন করে গায় শুনে আমি নিজেও কনফিউজড হয়ে যাই। আমি যদি আধুনিক গানকে পল্লীগীতি বানাই তাহলে তো হবে না। প্রত্যেক গানের একটা বৈশিষ্ট্য আছে, ধারা আছে, চলন আছে, গায়কী আছে কিন্তু এ প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে এটা দেখা যায় না। ব্যান্ডে যারা গায় তারা তো পল্লীগীতিকে মৃত বানিয়ে ফেলে। চিৎকার করে গাইলেই তো আর লোকগানের গায়কী হবে না। ফরিদা পারভীন বলেন, নানা জায়গায় লোকগান নিয়ে কম্পিটিশন চলছে। যদিও ওভারঅল লোকগানের ভাল চর্চাটা হচ্ছে না। টিভি চ্যানেলগুলো তাৎক্ষণিক বাহবা বা যশ পেতে যাকে তাকে দিয়ে প্রেজেন্ট করছে, তাকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। আমার কথা হচ্ছে যিনি সবচেয়ে ভাল গান করেন, এ বিষয়ের প্রতি যার দক্ষতা আছে সেই শিল্পীদেরই নিয়ে কাজ করা উচিত। গোটা বিশ্বে লোকগীতির অন্যতম প্রধান উপকরণ কিন্তু বাংলাদেশে। আমাদের লোকগানকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। এটি আমাদের আদি, অকৃত্রিম এবং শেকড়। এটাকে যথেচ্ছ বা যেনতেন ব্যবহার না করাই ভাল। লালন গবেষক সরদার হীরক রাজা বলেন, বাংলাদেশে লোকসঙ্গীত বা বাউল গান যেটাই বলি না কেন এটার আধ্যাত্মিক চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য মূল্য অনেক। বাউল গানের শক্তিশালী ফিলোসফি ও মানুষের কাছে এর চাহিদা আছে। দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানুষ এখন লালনে প্রভাবিত হচ্ছে। গান গ্রহণ করলেও বাউলরা অনেকটা উপেক্ষিত। অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করে। প্রকৃত বাউলদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। সত্যিকারের বাউল গানের চর্চা যারা করছে তারা উপেক্ষিত এবং এক প্রকার মানবেতর জীবনযাপন করছে। মাগুরার সমীর বাউল, কুষ্টিয়ার টুনটুন বাউল, রাজ্জাক বাউল, চুয়াডাঙ্গার লতিফ বাউল, ফরিদপুরের পাগলা বাবুল, ঢাকার শফি মন্ডল, নড়াইলের এনাম সাঁই- সবাই জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা অনেক কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করছি। কেউ এখন আর আমাদের গান গাইতে ডাকে না। বাউল গান এখন শহুরে গান হয়ে গেছে। সারাজীবন বাউল গান করে আমাদের অনেকেই শেষ জীবনে চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে পারে না। কুদ্দুছ বয়াতী বলেন, লোকগান যদি অন্যদিকে চলে যায়, তাহলে দেশ তো অন্যদিকে চলে যাবে। লোকগান আমাদের আদি গান, আমাদের বাপ-দাদার গান। সে গান হারালে তো বাপ-দাদার নামই হারিয়ে যাবে। এ গান আমাদের সংস্কৃতি ধরে রাখবে, একে হারাতে দেয়া যাবে না। কিভাবে এ গানকে বাঁচিয়ে রাখা যায় সবারই এদিকে নজর দেয়া উচিত। এখনকার সচেতন সংসারী শিল্পীরা সম্মানের চেয়ে সম্মানীকেই প্রাধান্য দেন। এমন বাস্তবতার ভেতর দিয়েই বর্তমান বাংলাদেশে শিল্পীরা সঙ্গীতচর্চা করে যাচ্ছেন। এখন বাংলাদেশে দক্ষিণাঞ্চলের কয়েক জেলা ছাড়া কোথাও কবিগানের আসর বসে বলে শোনা যায় না। কীর্তন, অষ্টক ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষঙ্গের গানও উঠেই যাচ্ছে। গম্ভীরা থেকে শিব প্রসঙ্গ উঠে গেছে অনেক আগেই। পটগানেরও ধর্মীয় অনুষঙ্গ সমাদর পায় না। এখন এটি পরিবেশ বিপর্যয়, ভোটের প্রচার, সামাজিক নানা সমস্যা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজে ব্যবহৃত হয়। এক সময় পালাগান ও বিচার গানের সমাদর ছিল তত্ত্বভাবুক শ্রোতার কাছে। সৃষ্টিতত্ত্ব, আদম-হাওয়া, আল্লাহ-রসুল, শরীয়ত-মারেফত, নারী-পুরুষ ইত্যাদি বিষয়ে তত্ত্বাশ্রিত বিতর্কমূলক গানের আসর এখন আর আগের মতো বসে না। গ্রামীণ নিরক্ষর নারীরা একসময় বিয়েশাদি, মুসলমানী কিংবা অন্নপ্রাসন উপলক্ষে নিজেরা একত্র হয়ে গান করত- যার কেতাবি নাম গীত। এখন ওসব আনুষ্ঠানিকতায় আড়ম্বর বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু মেয়েদের মুখে আর সেই গান এখন নেই। কেবল গ্রাম্যজীবনভিত্তিক কোন কোন নাটক-সিনেমায় মাঝে-মধ্যে ‘লীলাবালি লীলাবালি ভর যুবতী সই গো/ কি দিয়া সাজাইমু তরে’ গানটি শোনা যায়। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও এখন মাইকে বা আধুনিক সাউন্ডসিস্টেমে হিন্দী সিনেমার গান বাজলেও বিয়ের গান শোনা যায় না।
×