ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিরূপ প্রভাব জলবায়ু পরিবর্র্তনের;###;দ্রুত গলছে বরফ, বাড়ছে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা;###;বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমছে ৮০ থেকে এক শ’ ভাগ

উধাও হবে শীত ॥ ৫০ বছর পর

প্রকাশিত: ১০:১২, ৫ অক্টোবর ২০১৯

উধাও হবে শীত ॥ ৫০ বছর পর

শাহীন রহমান ॥ শীতকালের ব্যাপ্তি ক্রমেই কমে আসছে। কমপক্ষে দুই মাস তীব্র শীতে জবুথবু গোটা দেশের চিত্র এখন অতীত। গত কয়েক বছর হাড়কাঁপানো শীত পড়েছে হাতে গোনা কয়েক দিন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে দেশের শীত ঋতুর ওপর। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বিশ্ব ক্রমশ উষ্ণ হয়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ৫০ বছর পর (৭০ সাল নাগাদ) এই অঞ্চলের প্রকৃতি থেকে শীত ঋতু উধাও হয়ে যাবে। আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমেই শীত ঋতুর ব্যাপ্তি কমে আসছে। এই ঋতুতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে ৮০ থেকে ১শ’ ভাগ পর্যন্ত কম হচ্ছে। গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়ছে। ২০৩০ সালেতাপমাত্রা বাড়ার হার প্রধানত দেখা দেবে শীতের মাসগুলোতে। ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জ আইপিসিসি বা জলবাযু বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্যানেলের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্ট হতে শুরু করছে। প্রায় সব ঋতুতে এর প্রভাব পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের এই বিজ্ঞানী প্যানেল হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, মানুষের নানা কর্মকা-ের পরিণতিতে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে এখন দ্রুত হারে সাগর পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এবং বরফ গলছে। বরফ গলা পানি গিয়ে পড়ছে সাগরে। আইপিসিসির নতুন এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, সাগরে তাপ বাড়ার ফলে আবহাওয়া দিনকে দিন বিপজ্জনক আচরণ করবে। সামুদ্রিক ঝড় বেশি হবে, জলোচ্ছ্বাস বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে গ্লোবাল কমিশন অন এ্যাডাপটেশন (জিসিএ) আয়োজিত অনুষ্ঠানে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর অস্তিত্বের জন্য হুমকি। জলবায়ুর চরমভাবাপন্ন বৈরী আচরণ আমাদের টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনকে আরও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। আবহাওয়া অফিসের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শীতকালে স্বাভাবিক তাপমাত্রা বাড়ছে। শীতকালে (ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে) যেখানে স্বাভাবিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ধরা হয়েছে ২৫.৪ ও ২৬.৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৪.২ ও ১২.৪ ডিগ্রী। দেখা গেছে, এই তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব বাংলাদেশে শীতের ওপর পড়ছে। ফলে শীতকালের ব্যাপ্তি কমছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে পৌষ-মাঘ এই দুই মাসকে শীত ঋতু ধরা হলেও ঋতু বৈচিত্র্যের ধরন অনুযায়ী প্রকৃতিতে অনেক আগেই শীতের আনাগোনা শুরু হয়। শীতের এই বৈশিষ্ট্যে এখন আর নেই। ভরা মৌসুমেও শীতের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। তারা জানান, শীতকালে তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে শীতের ফসল উৎপাদনের ওপর এর প্রভাব পড়বে। তারা বলেন, আগামীতে জলবায়ু পরিবর্তনকে কখনও উচ্চ তাপমাত্রা, প্রচুর বৃষ্টিপাত, কখনও অতিরিক্ত আর্দ্রতা এবং ঋতুভিত্তিক ভিন্নতা ইত্যাদি বিষয় দ্বারা সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বাড়ার হার প্রধানত শীতের মাসগুলোতেই বেশি পরিলক্ষিত হবে। আগামীতে শীত শুষ্ক মৌসুমে পরিণত হবে। এ ঋতুতে বৃষ্টিপাত প্রায়ই হবে না। উষ্ণতা বাড়বে, দেখা দেবে খরা। শীতের মাত্রাও আস্তে আস্তে কমে আসবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শীতকালেই বেশি স্পষ্ট হবে। সম্প্রতি হিসেবেও শীতকালে এই প্রভাবটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রতি বছর এই মৌসুম প্রায় বৃষ্টিপাতহীন থাকছে। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আবহাওয়া অধিদফতরের হিসেবে দেখা গেছে, স্বাভাবিকের চেয়ে শীতে বৃষ্টিপাত প্রায় ১শ’ শতাংশ কম হচ্ছে। আগামীতে এই প্রভাবটা আরও বাড়তে পারে। শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বের অন্যান্য দেশেও জলবায়ু পরিবর্তনের একই প্রভাব বিরাজ করতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বাংলাদেশ সেন্টার ফর এ্যাডভান্স স্টাডিজ পরিচালিত এক সমীক্ষায় তুলে ধরা হয়েছে, ২০৩০ সাল পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের হার মাঝামাঝি হলেও ২০৭৫ সালে হার দ্বিগুণ হয়ে যাবে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাপমাত্রা পরিবর্তনের হার অনেক বেড়ে যাবে। ২০৩০ সালে তাপমাত্রা বাড়ার হার প্রধানত দেখা দেবে শীতের মাসগুলোতে। যদিও শীত পরবর্তী মাসগুলোতে (এপ্রিল, মে ও জুনে) বেশিরভাগ পরিবর্তন দেখা দেবে। ২০৭৫ সালের এপ্রিল-মে মাসের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার বেশি হবে। প্রায় ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এ গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৭০ সালের শীত, গ্রীষ্ম ঋতুতে বাষ্পীভবনের অনেক পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। গবেষণায় উঠে এসেছে যে, এ পরিবর্তনের ফলে বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হবে। যার ফলে ব্যাপক বন্যা দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে শীতকালে বৃষ্টিপাত প্রায় হবেই না। ফলে শীতকাল শুষ্ক ও খরা মৌসুমে পরিণত হবে। অবশ্য এতে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের শীতকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমার হার হবে নগণ্য। কিন্তু ২০৭৫ সালে শীতকালে বৃষ্টিপাত প্রায় হবেই না। এতে বলা হয় বাংলাদেশের জলবায়ুকে এর উচ্চ তাপমাত্রা, প্রচুর বৃষ্টিপাত, কখনও অতিরিক্ত আর্দ্রতা এবং ঋতুভিত্তিক ভিন্নতা ইত্যাদি বিষয় দ্বার সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব। যদিও দেশটির বেশিরভাগ অংশ উত্তরক্রান্তি রেখায় অবস্থিত। তারপর হিমালয় পর্বতের প্রভাবে বাংলাদেশের জলবায়ু পুরো বছর ধরেই কম বেশি উষ্ণ থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু সাধারণত নিয়ন্ত্রিত হয় গ্রীষ্ম ও শীতকালীন বায়ু দ্বারা। উষ্ণ, আর্দ্র এবং অস্থিতিশীল বাতাস বহনকারী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু উৎপন্ন হয় ভারতীয় মহাসাগর থেকে। শীতল বাতাস সমৃদ্ধ উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু আসে সাইবেরিয়ান মরুভূমি থেকে। যা সাধারণত ঝড়ো হাওয়া ও শীতের সময় প্রবাহিত হয়। এ কারণে পুরো দেশজুড়ে সাধারণ আর্দ্র, উষ্ণ এবং গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু দ্বারা পরিলক্ষিত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন কর্মকা-ের ফলে জলবায়ুতে যে পরিবর্তন সাধিত হয় তার অন্যতম ভুক্তভোগী হচ্ছে বাংলাদেশ। আবার বাংলাদেশ বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর অন্যতম। অর্থনৈতিক উন্নয়নের তালিকায় সব পরিমাপের দিক দিয়ে নিম্ন। এ কারণেই দেশের মানুষ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে খুবই বিপদাপন্ন। দেশের মাত্র ২০ ভাগ জিডিপি আসে কৃষি থেকে। কিন্তু ৬০ ভাগ মানুষ কৃষি থেকে জীবিকা নির্বাহ করে। জলবায়ু পরিবর্তন ও ঋতু বৈচিত্র্যের পরিবর্তনের ফলে কৃষি, উপকূলীয় অঞ্চল, পানি সম্পদ, বনাঞ্চল, মৎস্য, স্বাস্থ্য এবং জ্বালানি খাত বেশি বিপন্নতার মধ্যে পড়তে পারে। তাদের মতে, এ সমস্যা মোকাবেলা ও ঝুঁকি কমাতে সরকারী-বেসরকারী ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। এখন প্রতিবছর অনাবৃষ্টি, খরা, বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে ৯ থেকে ১০ মাসই দেশের সব নদী-খাল-বিল শুষ্ক থাকছে। কৃষি কাজের জন্য এ সময় পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। ভূগর্ভস্থের পানিও দিন দিন নেমে যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুম ছাড়াও দেশের বেশিরভাগ নদ-নদীও শুকিয়ে খালে পরিণত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক সময় বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও বিগত কয়েক বছরের তাপমাত্রার অস্বাভাবিক আচরণে সেই পরিচিত ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ১৯৬০ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪২.৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ৩০ মে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় (রাজশাহীতে) ৪৫.১ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এরপর ১৯৯৫ সালে এসে রেকর্ড হয় ৪৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ২০০৯ সালের ২৬ এপ্রিল ৪২.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস (যশোরে)। যা ছিল বিগত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপমাত্রার এই রেকর্ডে যদিও মনে হচ্ছে তাপমাত্রা কমছে। কিন্তু অতীতে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রার পরিমাণ ছিল কম। বর্তমানে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রার পরিমাণ অনেক বেশি। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে শুধু ঢাকা শহরের মে মাসের গড় তাপমাত্রা ১৯৯৫ সালের তুলনায় বেড়েছে ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস। নবেম্বর মাসে এই তাপমাত্রা ১৪ বছর আগের তুলনায় বেড়েছে ০.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদফতরের হিসাবে দেখা গেছে, গত ৫০ বছরে দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার শতকরা ০.৫। ধারণা করা হচ্ছে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের তাপমাত্রার গড় ১.৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং ২১শ’ সাল নাগাদ ২.৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়বে। তাপমাত্রা বাড়ার এই ধারা অব্যাহত থাকলে প্রকৃতি থেকে শীত ঋতু উধাও হয়ে যাবে।
×