ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ওরহান পামুকের জীবন ও সাহিত্য জগত

প্রকাশিত: ১২:৫২, ৪ অক্টোবর ২০১৯

ওরহান পামুকের জীবন ও সাহিত্য জগত

১৯৫২ সালের ৭ জুন তুরস্কের ইস্তানবুলে জন্ম নেয়া ওরহান পামুক একাধারে একজন ঔপন্যাসিক ও চিত্র নাট্যকার। তাঁকে তুরস্কের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর লেখা তেষট্টিটি ভাষায় অনূদিত এবং এ পর্যন্ত তেরো মিলিয়নেরও বেশি বই বিক্রি হয়েছে। ‘সাইলেন্ট হাউস’ ‘দি হোয়াইট ক্যাসল’, ‘দি ব্লাক বুক, ‘দি নিউ লাইফ’, ‘মাই নেম ইজ রেড’, ‘¯েœা,’ ‘দি আদার কালার’ ও ‘দি মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স’ তাঁর যুগান্তকারী উপন্যাস। তিনি ২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি তুরস্কের সর্বপ্রথম নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক। ওরহান পামুক ইস্তানবুলের রবার্ট কলেজ থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ‘ইস্তানবুুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সি’তে তাঁর স্বপ্নের বিষয়Ñচিত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশোনা করেন। পেশা হিসেবে লেখালেখিকে গ্রহণ করার জন্য ‘ইউনিভার্সিটি অব ইস্তানবুুল’ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হন ও ১৯৬৭ সালে গ্র্যাজুয়েট করেন। পামুক ১৯৭৪ সাল থেকে নিয়মিতভাবে লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ড্রাকনেস এ্যান্ড লাইট’। এটি ১৯৭৯ সালে উপন্যাস প্রতিযোগিতায় মেহেত আরগুলুর সঙ্গে যৌথভাবে ‘মিলিয়েত প্রেস’ পুরস্কার লাভ করে। ১৯৮২ সালে উপন্যাসটি ‘মি চেভডেট এ্যান্ড হিজ সন্স’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় ও ১৯৮৩ সালে ‘ওরান কেমেল নোবেল’ প্রাইজ লাভ করে। তিনি এ উপন্যাসে ইস্তানবুুলের কাছে নিসানটাস জেলায় যেখানে বড় হয়েছেন সেখানকার একটি ধনী পরিবারের তিন প্রজন্মের গল্প লিখেছেন। পামুক তাঁর জীবনের প্রথমদিকে লেখালেখির জন্য বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৮৪ সালে তিনি তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘সাইলেন্ট হাউস’ এর জন্য ‘মেডারেল নোবেল প্রাইজ’ লাভ করেন। উপন্যাসটি ফ্রেন্স ভাষায় অনূদিত হওয়ার পর ১৯৯১ সালে তিনি ‘প্রিক্স দে লা ডেকোভার্ট ইউরোপিনি’ পুরস্কার পান। ১৯৮৫ সালে তুর্কি ভাষায় প্রকাশিত ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘বিয়াজ কেল (দি হোয়াইট ক্যাসল) এর জন্য পামুক ১৯৯০ সালে ‘ইনডিপেনডেন্ট এওয়ার্ড ফর ফরেন ফিকসান’ পুরস্কার লাভ করেন। এ পুরস্কার প্রাপ্তির ফলে বহির্বিশ্বে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ‘দি নিউইয়র্ক টাইমস বুক রিভিউ’ বর্ণনা করে লিখেছে, ‘পূর্বদিকে একজন নতুন তারকার উদয় হয়েছেÑ তিনি হলেন অরহান পামুক’। তিনি তাঁর জীবনের প্রথম দিকের কঠোর প্রকৃতিবাদ নিয়ন্ত্রিত লেখাগুলোর সঙ্গে আধুনিকোত্তর কৌশলের সঙ্গে পরিবর্তনের জন্য পরীক্ষণমূলক কাজ শুরু করেন। এ পরীক্ষণের ফল পাওয়ার জন্য পামুককে কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ১৯৯০ সালে ‘কেরা কিটাপ’ (দি ব্লাক বুক) বইটি জটিলতা ও সমৃদ্ধতার কারণে তুরস্কের সাহিত্যে ব্যাপকভাবে বিতর্কিত ও জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯৯৪ সালে ‘ইয়েন হায়াত’ (নিউ লাইফ) উপন্যাসটি তুরস্কের সাহিত্যে এক ধরনের সংবেদন সৃষ্টি করেছিল। বইটি প্রকাশের পরপরই তুরস্কের সাহিত্য ইতিহাসে দ্রুততম বিক্রির বইয়ের তালিকায় উপন্যাসটি স্থান পেয়েছে। এ সময় পামুক কুর্দিদের রাজনৈতিক অধিকারকে সমর্থন করে তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হন। ১৯৯৫ সালে পামুক একদল লেখকসহ তুর্কি সরকার কর্তৃক কুর্দিদের ওপর বৈরি আচরণের সমালাচনা করে লেখার চেষ্টা করেন। ১৯৯৮ সালে পামুকের লেখা উপন্যাস ‘মাই নেম ইজ রেড’ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিকভাবে তাঁর সুনাম বাড়তে থাকে। তিনি তার উপন্যাসে ষোড়শ শতাব্দীতে ইস্তাবুলের রহস্যময়তা, কল্পিত কাহিনী ও দর্শন সম্পর্কিত ধাঁধার মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। ১৫৯১ সালে অটোম্যান সুলতান মুরাট থ্রি এর রাজত্বের সময় নয় দিনের তুষারপাত ও ভয়াবহ শীতের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি ওই গ্রন্থে তাদের মুখোস খুলে দিয়েছেন। পামুক জরুরী দৃষ্টিকোণ থেকে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যকার উত্তেজনার অভিজ্ঞতা উর্ধশ্বাসে আহরণের জন্য পাঠকদের আহ্বান করেছেন। ‘মাই নেম ইজ রেড’ গ্রন্থটি পৃথিবীর চব্বিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং ২০০৩ সালে বিশ্বের অন্যতম সম্মানজনক পুরস্কার ‘ইন্টার ন্যাশনাল ডাবলিন এওয়ার্ড’ লাভ করে। ওরহান পামুকের ‘কার’ উপন্যাসটি ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে ২০০৪ সালে ‘¯েœা’ নামে ইংরেজী ভায়ায় তা অনুবাদ করা হয়। ওই উপন্যাসে তিনি সীমান্তবর্তী শহর কার্শ’এ ইসলামী জঙ্গীবাদ ও পশ্চিমি ধারার সঙ্গে আধুনিক তুরস্কের দ্বন্দ্বের কথা বিশ্লেষণ করেছেন। ‘¯েœা’ গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন, কিভাবে জঙ্গী মুসলিম গোষ্ঠী, স্কার্ফ পরিধানকারী পক্ষের সমর্থনকারী, নিরপেক্ষতাবাদী, সরকার ও বিভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্বের ফলে বিভিন্ন উচ্চমার্গীয় বিপরীতমুখী আদর্শের কারণে তারা একে অপরকে হত্যা করছে। ২০০৪ সালে ‘দি নিউইয়র্ক টাইমস’ এ গ্রন্থটিকে তাদের তালিকায় শীর্ষ দশের মধ্যে স্থান দিয়েছে। রাজনৈতিক উপন্যাসে সহানুভূতিশীল চরিত্র সৃষ্টি সম্পর্কে কার্ল বেকারের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে পামুক বলেছেনÑ আমি দৃঢ়ভাবে অনুভব করি মানুষের সাধ্যের মাধ্যমেই উপন্যাসের চরিত্র উদিত হয়, যদিও ওহার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ তারপরও তা অন্য মতকে শনাক্ত করতে সক্ষম। একমাত্র মানব জাতিই সেটি করতে পারে। তার জন্য প্রয়োজন চিন্তা শক্তি, একপ্রকার নৈতিকতা, বোধ শক্তির স্ব-আরোপিত লক্ষ্যসম্পন্ন ব্যক্তিÑযার মধ্যে রয়েছে অসাধারণত্ব ও আমাদের চেয়ে ভিন্নতা। ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার গ্রহণের পর ২০০৮ সালে ‘দি মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স’ নামে পামুক তাঁর প্রথম উপন্যাস প্রকাশ করেন। তিনি ইস্তানবুলে নিজস্ব একটি বাড়িতে সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রতিদিনের বিষয়সমূহ অবগত করার জন্যই প্রকৃতপক্ষে তাঁর ‘মিউজিক অব ইনোসেন্স’ সৃষ্টি করেছেন। তিনি ‘¯েœা’ এবং ‘মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স’ উভয় উপন্যাসেই ভালবাসার বিয়োগান্ত গল্প লিখেছেন, যেখানে পুরুষরা প্রথম দৃষ্টিতেই সুন্দরী নারীর প্রেমে পড়ে যায়। পুরুষরা কেন সুন্দরী নারীর প্রতি ভালবাসায় পতিত হয়, তিনি তার চিত্রায়ণ করে দেখিয়েছেন, সেখানে একটা প্রবলতাবোধ রয়েছে। যদিও এ সমস্ত প্রেমের গল্প উপরিগতভাবে সৃজন করা হয়েছে। পামুকের নায়কদের শিক্ষিত হওয়ার প্রতি ঝোঁক রয়েছে। কিন্তু তারপরও বিয়োগান্তভাবে সুন্দরের প্রতি তাদের আকর্ষণ রয়েছে। কিন্তু সেটিকে মনে হয় জরাজীর্ণ একাকিত্বের মতো। ‘মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স’ উপন্যাসে মুখ্য বিষয়গুলোর একটি হলো তুরস্কের সংস্কৃতিতে মহিলাদের ভূমিকা। যেসব মহিলা বিবাহের পূর্বে তাদের সতীত্ব হারিয়েছে তাদের একঘরে করে রাখার বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও অনেকেই বলেছেন, সত্তর দশকের দিকে ইস্তানবুুলে ‘আরও অধিক পশ্চিমা’ ধারার কারণে এটা হয়েছে। কিন্তু পামুক কুমারিত্ব নিষিদ্ধকরণকে তুরস্কের প্রাচীন প্রথার অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর উপন্যাস প্রায়শই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির দ্বন্দ্বের ফলে অনুসৃত হয়েছে। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পেছনে সেটি বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। এ উপন্যাসে জাদুঘর ও চলচ্চিত্র শিল্প ধারণার মাধ্যমে ইস্তানবুুলের সংস্কৃতিতে পশ্চিমা (ইউরোপ-আমেরিকা) প্রভাবকে ক্রমাগতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যা উপন্যাসের একটি বড় অংশ হয়ে উঠেছে। ২০১৬ সালে পামুকের দশম উপন্যাস ‘দি রেড হেয়ার্ড ওমেন’ প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি একজন কূপ খননকারী ও তার একজন সহযোগীসহ অনুর্বর জমিতে ফসল ফলানোর জন্য পানি অনুসন্ধানের গল্প বলেছেন। ১৯৮০ সালে মাস্টার মাহুত ও তার সহকারী ইস্তানবুলে প্রাচীন পদ্ধতিতে কূপ খনন করে। গল্পটিতে তাদের হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমের কথা ফুটে উঠেছে। রাষ্ট্র ও স্বাধীনতা, কর্তৃত্ববাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতা ইত্যাদি বিষয়ে পিতা-পুত্রের ধারণাচিত্র পুরো গল্পে ফুটে উঠেছে। এ বাস্তববাদী উপন্যাসে ত্রিশ বছর আগে ইস্তানবুলের কাছে ঘটে যাওয়া একটা হত্যাকা- যথাক্রমে প্রাচ্য ও প্রতিচ্য সভ্যতার দুটি মৌলিক শ্রুতির সাহিত্যভিত্তি কল্পিতরূপে সফোক্লিসের ‘ওডিপাস’এ পিতাকে হত্যার গল্প ও ফেরদৌসির ‘সোহরাব এবং রুস্তম’এ পুত্রকে হত্যার গল্পের সঙ্গে তুলনা করে আবর্তিত হয়েছে। পামুকের বইগুলো ধাঁধা ও বিচ্ছেদ চিহ্নিত করে থাকে। যার কিছু অংশ এসেছে প্রাচ্য ও প্রতিচ্যের মধ্যকার দ্বন্দ্বের মূল্যবোধ থেকে। তারা প্রায়ই বিরক্তিকর অথবা অনিশ্চিত ও চক্রান্ত চরিত্রের জটিলতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশেষ করে সৃজনশীল সাহিত্য ও চিত্র সম্পর্কে তাঁর রচনাসমূহ মুগ্ধকর ও আকর্ষণীয় আভাস দিয়ে থাকে। প্রাচ্য ও প্রতিচ্যের প্রচলিত প্রথা ও আধুনিকতাবাদ বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ এর মধ্যকার অতি গভীর অস্থিরতা পামুকের রচনায় সব সময় আলোচিত হয়েছে। তিনি তাঁর সৃজনশীলতা সম্পর্কে বলেনÑ ‘আমি অতি গভীরের গান শুনছি, কিন্তু তার সম্পূর্ণ রহস্য জানি না এবং জানতেও চাই না। আমি সেই মুহূর্তে খুব অবাক হয়ে যাই যখন অনুভব করি আমার কথা, স্বপ্ন ও ধারণাÑ যা আমাকে পরমানন্দে উচ্ছ্বসিত করে তোলে তা আমার নিজের কল্পনা থেকে উৎসারিত হয় না। সেখানে দেখতে পাই অন্য শক্তি যা আমাকে উপস্থাপিত করে উদারভাবে’। একদল লেখক বলতে চান, পামুকের কিছু রচনা অন্য লেখক দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত ছিল। তাঁর রচনার কিছু অংশ অন্য বই থেকে অবিকলভাবে উদৃত হয়েছে। পামুক নিজেই বলেছেন, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা দ্বারা তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন। মুরাত বারডাকছি নামে একজন জনপ্রিয় লেখক এবং জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক তুরস্কের ‘হুরাইয়াত’ পত্রিকায় পামুকের বিরুদ্ধে নকলকারী ও রচনাচোর হিসেবে অভিযোগ করেছেন। অন্য একজন লেখক পামুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলেছেন, ফুয়াদ করিমের লেখা উপন্যাস‘ ইজ ইস্তানবুল ইন দি টাইম কানুনি’ এর অনেক অংশ অবিকলভাবে পামুকের ‘দি হোয়াইট ক্যাসল’ এ স্থান পেয়েছে। ২০০৯ সালে বোষ্টন বুক ফেস্টিবেলে পামুক তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারিত এসব অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে বলেন, ‘না, আমি এগুলোর সঙ্গে জড়িত নই। আপনাদের পরবর্তী প্রশ্ন করুন’। তাঁর বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগগুলো আধুনিকোত্তর সাহিত্য সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি সবসময় তাঁর রচনায় পুরোপুরিভাবে সাহিত্য কৌশলের চিত্র তুলে ধরেছেন। পামুককে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল আপনি পূর্বের প্রজন্ম বলতে কি বোঝাতে চান? তিনি তার উত্তরে বলেছেন, আমি ওসব লেখকদের কথা বলি যারা সাহিত্যে নৈতিকতা, রাজনীতি ও সামাজিক দায়িত্ববোধ কে ধারণ করেছিল তারা স্পষ্ট বাস্তববাদী ও পরীক্ষণমূলক ছিল না। অনেক গরিব দেশের লেখকরা তাদের জাতির সেবা করার চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেদের প্রতিভা নষ্ট করেছিল। আমি তাদের মতো হতে চাইনি। কারণ, আমি যৌবন বয়সে ফকনার, ভার্জিনিয়া উল্ফের সাহিত্য উপভোগ করেছি। আমি সমাজ বাস্তববাদী স্তেইনবেক ও গোর্কির মতো মডেলের প্রতি কখনও আকৃষ্ট ছিলাম না। ষাট ও সত্তর দশকের সাহিত্য পুরনো হয়ে উঠেছিল। সুতরং নতুন প্রজন্মের লেখক হিসেবে আমাকে স্বাগত জানানো হয়েছে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়েরর পর আমার বইগুলো এমনভাবে বিক্রি শুরু হয়েছিল, যা তুরস্কের কেউ স্বপ্নেও দেখেনি। বেশিরভাগ তুর্কি সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ওই বছরই আমার মধুচন্দ্রিমা শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে বেশির ভাগ সময়ই আমার বইয়ের মূল বিষয়বস্তু আলোচনার চেয়ে প্রচার ও বিক্রয় সম্পর্কিত বিষয়ের প্রতি তাদের গুরুতর প্রতিক্রিয়া ছিল। আমি দুর্ভাগ্যবশত রাজনৈতিক বক্তব্যের জন্য কুখ্যাত হই- যার বেশিরভাগই আন্তর্জাতিক সাক্ষাতকার থেকে নেয়া হয়েছে। নির্লজ্জভাবে কিছু জাতীয়তাবাদী তুর্কি সাংবাদিক নিপুণতার সঙ্গে আমাকে রাজনৈতিকভাবে আগের চেয়ে আরও অধিক উৎসাহী ও বোকা বানাতে চায়’। ২০০৫ সালে পামুক আর্মেনীয় এবং কুর্দিদের হত্যার বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদানের পর উগ্র জাতীয়তাবাদী আইনজীবী কামাল করেনসিস পামুকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এই মামলার বিরুদ্ধে জোসে সারামাগো, গার্বিয়েল গার্সিয়া, গুন্টারগ্রাস, কার্লোস ফুয়েনেস এবং মারিও বার্গাস লোসা প্রমুখ লেখকরা প্রতিবাদ করেন। কিছুদিন মামলা চলার পর ২০০৬ সালের ২২ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ কোর্টে খারিজ হয়ে যায়। সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন‘ ডাস’এ এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘এখানে ত্রিশ হাজার কুর্দি এবং দশ লাখ আর্মেনীয় মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে অনেকেই কথা বলার সাহস পায়নি। কিন্তু আমি তা পেরেছি’। তাঁর এই বক্তব্যের পর তুর্কি ইতিহাসবিদরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। পামুক বলেছেন, এ বক্তব্যের পরিণামে তাকে ঘৃণা ও ক্রোধের শিকার হতে হয়Ñ যার পরিণামে তিনি দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ২০০৫ সালে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের জবাব দেয়ার জন্য তিনি দেশে ফিরে আসেন। বিবিসি নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে পামুক বলেন, তিনি চেয়েছিলেন তুর্কিদের বাক স্বাধীনতা রক্ষার আশার কথা, যা তাদের সঠিক ইতিহাসকে তুলে ধরবে। ১৯১৫ সালে অটোম্যান আর্মেনীয়দের ভাগ্যে কি ঘটেছিল, তুর্কিরা এই ধরনের বড় বিষয় গোপন রেখেছিল। সেটি প্রকাশ করা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আমাদের অতীতের কথা বলার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। পামুকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর প্রতিক্রিয়া হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। কোন কোন মহল ইউরোপীয় ইউনিয়নে তুরস্কের প্রভাব ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। ৩০ নবেম্বর ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ঘোষণা করে, কেমিয়েল ইউবলিংস এর নেতৃত্বে পাঁচজন এম ইপি সদস্য বিচারকার্য পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠাবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্প্রসারণ কমিশনার পরবর্তীকালে বলেছিলেন, পামুকের মামলাটি ছিল তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে সদস্য পদ পরিমাপের মানদ-ের ‘লিটমাস টেস্ট’। ডিসেম্বরের ১ তারিখে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল পামুক এবং তার সঙ্গে আরও ৬ জনের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানায়। ‘পেন আমেরিকান সেন্টার’ পামুকের বিরুদ্ধে অভিযোগের নিন্দা জানিয়ে বলেছে, ‘যে রাষ্ট্র রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার সম্পর্কিত জাতিসংঘের নীতি ও ইউরোপীয় মানবাধিকার কনভেনশনকে অনুমোদন দিয়েছে সে রাষ্ট্রের নীতিমালা এসবের সঙ্গে স্পষ্টভাবে বিপরীত’। ১৩ ডিসেম্বর ৮ জন বিখ্যাত লেখক জোসে সারামাগো, গার্বিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, গুন্টার গ্রাস, আমবাটো ইকো, কার্লোস ফুয়েনটেস, জুয়ান গোয়েটিসিলো, জন আপডাইক ও মারিও ভার্গাস ইয়োসা এক যৌথ বিবৃতিতে পামুকের পক্ষ সমর্থন করেন ও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেন। ২০০৬ সালের ২২ জানুয়ারি তুরস্কের বিচার মন্ত্রণালয় নতুন দ-বিধির আওতায় পামুকের বিরুদ্ধে মামলা করার বৈধতা নেই বলে উল্লেখ করে। স্থানীয় আদালতে পরেরদিন মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। এই ঘোষণাটি যখন দেয়া হয় তার ঠিক এক সপ্তাহ পূর্বে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তুর্কি বিচার ব্যবস্থা পর্যালোচনা শুরু করার পরিকল্পনা করছিল। ২০০৬ সালের ১২ অক্টোবর সুইডিশ নোবেল একাডেমি ওরহান পামুককে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করে। পুরস্কার ঘোষণার পর অনেক প-িত ব্যক্তি বিস্মিত হয়েছেন, তাঁদের ধারণা ছিল সিরিয়ান কবি আলী আহমদ সাঈদ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হবেন। পামুককে নোবেল বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করার কারণে খোদ তুরস্কে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। অনেকে বলেছেন, পামুককে নোবেল পুরস্কার প্রদানের পেছনে রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা কাজ করেছিল। এসব অভিযোগের উত্তরে সুইডিশ একাডেমি বলেছে, ‘তার নিজস্ব শহরে মর্মান্তিক আত্মার সন্ধানের জন্য পামুক সংঘর্ষ ও সংস্কৃতিকে একত্রিত করে নতুন এক প্রতীক আবিষ্কার করেছেন’। ২০০৬ সালের ৭ ডিসেম্বর সুইডেনের স্টকহোমে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি অনুষ্ঠানে তুর্কি ভাষায় তিনি তার বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, ‘আজকের সাহিত্যে সর্বাধিক প্রয়োজন মানবতার মৌলিক সম্প্রতি সম্পর্কে বলা ও তদন্ত করা : বাইরে থাকার ভয় ও কিছু করার জন্য ভয় থেকে এসব মূল্যহীন ভয় উদ্ভূত হয়। সমষ্টিগত অবমাননা, দুর্বলতা, অগ্রাহ্যতা, অসন্তোষ, সংবেদিতা, কল্পনাপ্রসূত অপমান, জাতীয়তাবাদী উৎসাহ সম্প্রসারণ ও পরবর্তী সক্রিয়তাÑ যখনই আমি এ ধরনের সংবেদনশীলতার মুখোমুখি হই; অযৌক্তিক ও অতিরঞ্জিত ভাষা যা তারা প্রকাশ করেÑআমি জানি তারা আমার ভেতর একটা গোপনীয়তাকে স্পর্শ করে। আমরা পশ্চিমা বিশ্বের বাইরের জনগণ, সমাজ ও জাতিকে দেখেছি। আমি সহজে তাদেরকে শনাক্ত করতে পারি। মাঝে মাঝে তারা ভয়ে নিমজ্জিত হয়ে নির্বুদ্ধিতার দিকে ধাবিত হয়। এসব ঘটে থাকে অবমাননাকর ও সংবেদনশীলতার জন্য। আমি পশ্চিমা বিশ্বের লোকদেরকেও সহজে শনাক্ত করতে পারিÑ তারা তাদের সম্পদ নিয়ে অতিরিক্ত অহঙ্কার করে। তাদের অর্জন আমাদের মাঝে মাঝে দিয়েছে নবজাগরণ, জ্ঞান ও আধুনিকতা। এতে করে তারা আত্মতুষ্টিতে নিমজ্জিত হয়েছে; এটাও এক ধরনের নির্বুদ্ধিতা।’ পামুকের নোবেল প্রপ্তি সংবাদ প্রকাশের পর সুইডেনে দুই লাখেরও বেশি বই বিক্রি হয়েছে। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপকদের মধ্যে পামুকের বই সুইডেনে সর্বাধিক বিক্রির তালিকায় স্থান পেয়েছে। তিনি বর্তমানে কলনিবুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক বিভাগের শিক্ষক। সেখানে পামুক লিখন বিদ্যা এবং তুলনামূলক সাহিত্য সম্পর্কে শিক্ষাদান করেন।
×