ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আবু নোমান

বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁর রজনী উপন্যাস

প্রকাশিত: ১২:৫০, ৪ অক্টোবর ২০১৯

বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁর রজনী উপন্যাস

লেখক সচেতনে বা অবচেতনে তাঁর সমকালীন পারিপার্শ্বিকতাকেই ধারণ করেন। যদিও একটি সময়ে এবং একটি স্থানে লেখকের বসবাস, তথাপি অতীত ও ভবিষ্যতে তাঁর বিচরণ অবারিত। লেখক মানুষ হয়েও উত্তর মানুষের চরিত্রকে ধারণ করতে পারেন অনায়াসেই। বর্তমানে বাস করেও অবলীলায় ঘুরে ফেরেন অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত কিংবা উত্তর-ভবিষ্যতে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রজনী উপন্যাস পড়ে এ ধারণা হওয়া অসঙ্গত হয় না। নিতান্দই মামুলি আকৃতির ছোট্ট একটি উপন্যাস রজনীতে বঙ্কিমচন্দ্র সমকালীন সমাজ মানসকে উন্মোচন করেছেন, ধারণ করেছেন নিজস্ব শিল্পকুশলতায় সার্বজনীন মানবিকতাকে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সরকারী চাকরিজীবী ছিলেন। তবে তাঁর লিখা ও চিন্তাকর্মে তিনি তার প্রভাব ফেলতে দেননি। লেখক হিসেবে সঙ্গত কারণে অনেকে তাঁকে সাম্প্রদায়িকও বলেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখক হবার পেছনে আলোচকগণ চারটি বিষয় খুঁজে পেয়েছেন। এগুলো হলো-আধুনিক সংস্কারকদের তিনি তাঁর সমকালে পেয়েছিলেন। যেমন, রামমোহন রায়, ইশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ, দ্বিতীয়ত এ সময়ে সংবাদপত্র এবং সাময়িকীর উত্তরোত্তর ক্রমবিকাশ ঘটে, তৃতীয়ত নব্য হিন্দুত্ববাদের উত্থান এবং শেষটি হলো বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব। তিনি এ সমস্ত সুযোগগুলোকে খুব ভালভাবেই কাজে লাগিয়েছিলেন। একজন চৌকস সরকারী কর্মকর্তার অবস্থান থেকে বঙ্কিমচন্দ্র লেখক জীবনকে সম্পূর্ণভাবে আড়ালে রেখে তাঁর লিখালিখির জগত তৈরি করে সেখানেই তিনি নীরবে বিচরণ করে গেছেন। তবে বাংলাকে দেখার সুযোগ তিনি গ্রহণ করেছিলেন আপন লেখকের দৃষ্টির আলোতেই। আর সেখান থেকেই তিনি বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকে করেছেন আত্মস্থ। জনগণের সঙ্গে তিনি মিশেছিলেন একজন সাধারণ মানুষের মতো আর তাদের মধ্য থেকেই তিনি চরিত্র গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের জন্ম ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুন চব্বিশ পরগণার কাঁঠালপাড়া গ্রামে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন বঙ্কিম, তার পরিচয় তিনি ছাত্র অবস্থায় যেমন দিয়েছেন তেমনি জানান দিয়েছেন সাহিত্য সৃষ্টিতে। ছাত্রজীবন শেষে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর পদে নিয়োগ লাভ করেন। কিন্তু সাহিত্য জীবনকে তিনি বেশি উপভোগ করেছেন। উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে সাফল্য অর্জন করেছিলেন বঙ্কিম। প্রকৃতপক্ষে বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথম সচেতনভাবে পাশ্চত্যের উপন্যাসরীতিকে গ্রহণ করে বাংলা ভাষায় উপন্যাস রচনা করে এর সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। তাঁর আগে ভবানীচরণ বন্দোপাধ্যায়ের নববাবুবিলাস (১৮২৫), প্যারিচাঁদ মিত্রের (১৮১৪-৮৩) আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৭) ও কালিপ্রসন্ন সিংহের (১৮৪০-৭০) হুতোম প্যাঁচার নক্সার (১৮৬২) মতো কিছু উপন্যাস রচিত হলেও বঙ্কিমই প্রথম পাঠকদের মনোরঞ্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর দুর্গেস নন্দিনী (১৮৬৫) এর কথা সর্বাগ্রে উল্লেখ করা যায়। পূর্ণাঙ্গ কাহিনীর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে পাঠকসমাজ তাঁকে বাংলা উপন্যাসের জনক অভিধায় বিভূষিত করে। আর রবীন্দ্রনাথ তাঁকে স¦াগত জানান চমৎকারভাবে। রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘বঙ্কিমচন্দ্র আনলেন সাত সমুদ্র পারের রাজকুমারকে আমাদের সাহিত্য-রাজকন্যার পালঙ্কের শিয়রে। তিনি যেমনি ঠেকালেন সোনার কাঠি, অমনি সেই বিজয়-বসন্ত, লায়লী-মজনুর হাতির দাঁতে বাঁধানো পালঙ্কের ওপর রাজকন্যা নড়ে উঠলেন। চলতিকালের সঙ্গে মালাবদল হয়ে গেল, তারপর থেকে তাঁকে আর ঠেকিয়ে রাখে কে?’ তারপর একে এক অনেক রচনা করেছেন উপন্যাস। পৌঁছে গেছেন সম্র্রাটের সুউচ্চ চূড়ার আসনে। বিশুদ্ধ পারিবারিক হলেও বাংলা ভাষায় মনোস্তত্ত্বমূলক উপন্যাস হিসেবেও বঙ্কিমচন্দ্রের রজনীকে স্থান দেয়া যেতে পারে। স্বকথনরীতিতে রচিত এই উপন্যাসটিতে রয়েছে মূলত চারটি চরিত্র। অমরনাথ, লবঙ্গলতা, রজনী এবং শচীন্দ্রনাথ। এদের মধ্যে নায়িকা হিসেবে রজনী যতটা তার চেয়ে লবঙ্গলতাকেই গুরুত্ব দেয়া যায় বেশি। রজনী জন্মান্ধ নারী। অন্ধ হলেও মানুষের সুখের অনুভূতি থাকে। হয়তো চক্ষুষ্মান আর অন্ধত্বের সেই অনুভূতির মধ্যে রয়েছে ভিন্নতা। যার চোখ আছে সে রূপ দেখে সুখী হয় আর অন্ধরা শব্দ শুনেই রূপ অনুভব করে। রজনী অন্ধ হলেও ক্ষুদ্র ফুলের মালা গাঁথতে পারে। কিন্তু তার আক্ষেপ সেই মালা পরে কেউ কখনো তার প্রতি কৃতজ্ঞতার কথা একটিবারের জন্যও বলেনি তাঁকে। রজনীর পিতা নগরে নগরে ফুল বিক্রি করে বেড়ান। বলে নেয়া ভাল, এই পিতা প্রকৃত পিতা নন। কিন্তু লেখক প্রথমতো তা প্রকাশ করেননি। বালিগঞ্জের প্রান্তে তাদের একটি ফুলের বাগান, সেখান থেকে প্রতি সকালে তার এই পিতা ফুল এনে রজনীকে দিতেন। রজনী সেই ফুল সুক্ষ্ম সুচাগ্রে সুতা দিয়ে বিদ্ধ করে একটির পেছনে আরেকটি সাজিয়ে মালা গেঁথে চলেতো। সেই মালা তার পিতা নগরে মহানগরের পথে পথে বিক্রি করে উপার্জন করতো। কিন্তু ফুল বিক্রি করে সংসার চালানো ছিল দুঃসহ। রজনীর বাবা পথে পথে হেঁকেহেঁকে ফুল, ফুলের মালা বিক্রি করতেন আর তার মা কয়েকটি বাড়িতে প্রতিদিন ফুল নিয়ে যেতেন। এদের মধ্যে অন্যতম এজন ছিলেন রামসদয় মিত্র। রামসদয় মিত্রের বয়স তেষট্টি কিন্তু তাঁর ছোট স্ত্রীর বয়স মাত্র উনিশ বছর। ছোট স্ত্রী সুন্দরী, গুণপনা এবং স্বামীর প্রতি ভীষণ যতœশীল। স্বামীর বয়সজনিত সমস্ত দুর্বলতাগুলোকে তার বুদ্ধি দিয়ে মানিয়ে চলতো। রজনীর মা ফুল নিয়ে তাদের বাড়ি গেলে লবঙ্গলতা জোর করে মূল্যের অতিরিক্ত টাকা হাতে ধরিয়ে দিত। গাঁয়ের গরিব-দুঃখীদের প্রতি আপন খেয়ালে সাহায্য সহযোগিতা করতো, সোনাদানা দান করতো, বিয়ে-সাদিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত। তার দানেই রজনীদের অভাব কিছুটা লাঘব হতো। অসুস্থতার কারণে একদিন মা যেতে না পারায় রজনী ফুল নিয়ে লবঙ্গলতাদের বাড়িতে যায়। লবঙ্গলতা রজনীকে দেখে অবাক হয়ে তার স্বভাবসিদ্ধ কথামালার সাহায্যে রজনীকে গ্রহণ করে। রামসদয়ের বড় স্ত্রীর মেজ ছেলে শচীন্দ্র বাবু তার ছোট মা লবঙ্গলতার কাছে মেয়েটির পরিচয় জানতে চায়। লবঙ্গলতা রজনীর পরিচয় দিয়ে সে যে জন্মান্ধ সে কথাও জানায়। শচীন্দ্র একজন ডাক্তার হিসেবে রজনীর চোখ দেখতে তার চিবুক স্পর্শ করতেই রজনী আবেগ আপ্লুত বিবস-পরবস হয়ে এক স্বর্গীয় সুখ অনুভব করলো। এ সুখ অনুভব কোন চক্ষুষ্মানের পক্ষে সম্ভব নয়, এ অন্ধের পক্ষেই সম্ভব। শচীন্দ্র বাবু চোখ দেখে বুঝলো, এ অন্ধত্ব সারবার নয়। লবঙ্গলতা বললো, তা না সারুক, তবে এ মেয়েটির বিয়ের ব্যবস্থা হতে অসুবিধা নেইতো! শচীন্দ্র বাবু বললো, সে বিয়ের জন্য পাত্রের খোঁজ খবর করতে পারে। এইসব কথাবার্তায় রজনী লজ্জা পায়, কিন্তু শচীন্দ্র বাবুর প্রতি ভাল লাগার সুখ অনবরত তার মধ্যে প্রবাহিত হতে থাকে। সেদিনের পর থেকে রজনীর ইচ্ছে হয় প্রতিদিন বড় বাড়ি যাবার। কিন্তু শচীন্দ্র বাবু কখন বাড়ি থাকেন সেটি তার জানা নেই। সে নিজেও জানে না, সে কি শুধুমাত্র শচীন্দ্র বাবুর জন্যেই যেতে চায়? অথচ শচীন্দ্র বাবুর চেহারা সে দেখতে পায় না। শুধু কণ্ঠস্বর শুনেই তার প্রতি এ প্রগলভতা? নাকি সেদিনের সেই স্পর্শ-কোনটির প্রতি টান তার? সে জানে না, কিন্তু মনে হয় সে যেন প্রতিদিন অন্তত একবার কোন এক আকর্ষণে সেখানে যায়। এটিই কি প্রেম? প্রেম কি তবে অন্ধের পক্ষেও সম্ভব? তারপর যা হবার তাই হলো। রজনীর বিয়ে ঠিক হলো শচীন্দ্র বাবুর বাড়ির কাজের লোক গোপালের সঙ্গে। গোপাল বিবাহিত, তবে নিঃসন্তান। অন্ধ হওয়ার কারণে রজনীর জন্য এটি ভাল সম্বন্ধ বিবেচনা করে রজনীর বাবা-মা ভীষণ পুলকিত। কিন্তু রজনী শচীন্দ্রকে ভালবেসে ফেলেছে, তার পক্ষে আর কাউকেই বিয়ে করা সম্ভব নয়। রজনীর আর্থিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থান এমনই যে, সে মুখ ফুটেও কাউকে শচীন্দ্রকে ভালোবাসার কথা বলতে পারে না। এদিকে গোপালের স্ত্রী গোপালের দ্বিতীয় বিয়ের খবরে ক্ষুব্ধ হয়ে রজনীকে নিরস্ত্র ও ধমক দিতে আসলে রজনী গোপালের স্ত্রীকে বিয়েতে নিজ অনাগ্রহের কথা ব্যক্ত করে। এমতাবস্থায় গোপালের স্ত্রী তার ভাই হীরালালের মাধ্যমে তার মায়ের বাড়ি হুগলিতে লুকিয়ে রাখার প্রস্তাব দেয়। রজনী এতে সম্মত হয়। পথিমধ্যে নৌকায় গোপালের স্ত্রীর ভাই নিজে রজনীকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে রজনী তা প্রত্যাখ্যান করে। ফলে নদীপারে রজনীকে রেখে সে ফিরে আসে। রজনী নিঝুম অন্ধকারে নিঃসঙ্গ একাকী নিজের অসহায়তার কথা ভাবতে ভাবতে নদীতে ডুবে মরতে ইচ্ছে করে। এই মধ্যবর্তী পরিসরে ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র অমরনাথের জীবনের ঘটনা বর্ণনা শুরু করেন। অমরনাথের কুলবংশ এতটা উচ্চ নয়, তবে সংসার যাপনের প্রয়োজনীয় সম্পদের অভাব তার ছিল না। অমরনাথের পিসির বাড়িতে যে মেয়েটি প্রায় আসতো তার সঙ্গেই পিসি অমরনাথের বিয়ের সম্বন্ধ স্থির করেছিল। সে মেয়েটিই লবঙ্গলতা। কিন্তু কথা চলতে চলতেই লবঙ্গলতার বিয়ে হয়ে যায় বয়স্ক ধনি রামসদয় মিত্রের সঙ্গে। তারপর থেকে অমরনাথ গৃহ ত্যাগ করে নানা দেশে ঘুরে বেড়াতে থাকে। সম্পদ, সুখ ফেলে এই গৃহত্যাগী অমরনাথ এক নিঃস্বহায় নিঃসম্বল হয়ে ঘুরে বেড়ায়। মৃত্যুর প্রতি আকাক্সক্ষা তৈরি হয়। ইতোমধ্যে অমরনাথ রজনীর পরিচয় জানতে পারে। রজনী যে একেবারেই সম্পদহীনা নয় তা পাঠককেও জানানো হয়। এক দারোগা অনাথ রজনীর স্বর্ণসম্পদ অন্যায়ভাবে হরণ করেছিল, তা এই অংশে পাঠকও অবগত হয়। পিতা বাঞ্ঝারাম কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে রামসদয় বাবু উত্তরাধিকারী হারিয়ে পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘটনা পরিপ্রেক্ষিতে আবার তা ফিরে পায়। কিন্তু এটি যথার্থ ছিল না। বাঞ্ঝারামের সম্পদের প্রকৃত মালিক ছিল তারই বন্ধু মনোহর দাস। মনোহার দাসের একমাত্র ভ্রাতুষ্কন্যা হওয়ার কারণে এ সম্পদের প্রকৃত মালিক আসলে রজনীই, কিন্তু এ কথা উকিল-আদালত কর্তৃক প্রতিষ্ঠা ছাড়া কেউ মানবে না। অমরনাথ এক আত্মীয় বাড়ির নিমন্ত্রণে যাওয়ার পথে জঙ্গলের মধ্যে শত্রুপরিবেষ্টিত রজনীকে পেয়েছিলেন। নিজে আহত হয়েও কোনক্রমে রজনীকে রক্ষা করতে পারেন কিন্তু প্রথম অবস্থায় তার সন্দেহ ছিল এই-ই রজনী কিনা! পরিচয় নিশ্চিত হয়ে অমরনাথ এখানে এই অবস্থার কারণ জানতে চাইলে রজনী গোপালের সঙ্গে বিয়ে প্রসঙ্গ ও শচীন্দ্র বাবুর প্রতি তার প্রগলভতার কথা বাদ দিয়ে পূর্বাপর সবকিছু জানায়। অমরনাথ রজনীকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় আসে। রজনীর বাবা হিসেবে পরিচিত রাজচন্দ্রের সঙ্গে কথা হয় অমরনাথের। অমরনাথ রজনীর প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করলে রাজচন্দ্র অনুরোধ করে, রজনী যেন এ কথা না জানে যে, রাজচন্দ্র তার পিতা নয়। লেখক শচীন্দ্রের বক্তব্য বর্ণনা করেছেন পূর্বাপর। হারিয়ে যাওয়ার দিন থেকেই কেউ কেউ রজনীকে ভ্রষ্টা চরিত্রের ভাবলেও শচীন্দ্র সে কথা কখনোই বিশ্বাস করেনি। দু’একবার এ ধারণা হলো যে, হয়তো কৌমার্যবস্থা থেকেই কারো প্রতি প্রণয়াশক্ত হয়ে বিয়ের আশঙ্কায় গৃহত্যাগ করেছে রজনী। কিন্তু একজন অন্ধের পক্ষে এ ধারণা যৌক্তিক ছিল না। এ কথাও বিশ্বাস হয়নি, একজন অন্ধ মেয়ে কী করে প্রেমে পড়তে পারে! হীরালালকে সন্দেহ হয়েছিল, কিন্তু কয়েকদিন পর হীরালালকে দেখা যাওয়ায় সেটি সন্দেহেই সীমাবদ্ধ থাকল। সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেয়া থেকে শুরু করে অনেক খোঁজাখুঁজি হলো কিন্তু কোন হদিস মিললো না। রজনীর প্রতি শচীন্দ্রের মনোভাবে ব্যাকুলতা ছিল কিন্তু আকাক্সক্ষা ছিল না। এর কারণ রজনীর আর্থিক দীনতা। অবশ্য সৌন্দর্যে, আচরণে, ধীরতায় কোনটিতেই তার সে দারিদ্র্যবস্থার প্রমাণ মিলতো না। দরিদ্র এবং অন্ধের জন্য বিয়ের পাত্র পাওয়া সহজ নয়। নিজের পক্ষে এ দরিদ্র ও অন্ধকে বিয়ে যেহেতু সম্ভব নয় তাই গোপালকে এর যোগ্য বিবেচনা করে শচীন্দ্র নিজেই এ বিয়ের চেষ্টা করে। তবে কেউ কেউ শচীন্দ্রকে এ প্রশ্নও করেছিল যে, তোমার কি রজনীকে বিয়ের ইচ্ছে? কিন্তু এটি তো সম্ভব নয়। কারণ রজনী অপরূপ সুন্দরী হতে পারে, কিন্তু অশিক্ষিতা, কুলহীন, দরিদ্র এবং সর্বোপরি একজন অন্ধ মেয়ে। শচীন্দ্র রজনীকে কখনোই স্ত্রী হিসেবে কল্পনা করতে পারে না। স্ত্রীর কাজতো সার্বক্ষণিক যতœ নেয়া, খোঁজ-খবর নেয়া, তদারকি করা, তা কি একজন অন্ধের পক্ষে সম্ভব? হঠাৎ রাজচন্দ্রের অর্থাৎ রজনীর পিতা হিসেবে যিনি পরিচিত তার কাছ থেকেই রজনীকে খুঁজে পাওয়ার খবর জানা যায়। কিন্তু কী করে, কোথায়, কীভাবে সে কথা রাজচন্দ্রের কাছ থেকে জানা গেল না। এরপর থেকে রজনী কিংবা তার মা-বাবার শচীন্দ্রদের বাড়িতে আসা বন্ধ হয়। শচীন্দ্রের ছোট মা অর্থাৎ লবঙ্গলতা রজনীদের খোঁজ নিতে লোক পাঠালে তারা ফিরে এসে জানায় তারা অন্যত্র বেড়াতে গেছে। এরপর একমাস পর পরিচয় হলো অমরনাথের সঙ্গে শচীন্দ্রের। প্রথম পরিচয়ে বেশ বুদ্ধিমত্ত্বা, সচেতনতা ও রুচিশীলতা দেখে শচীন্দ্র বেশ মুগ্ধ হলেন। সাহিত্যবিষয়ক অনেক গল্প-সল্পের শেষ পর্যায়ে রজনীর কথা জিজ্ঞেস করলো অমরনাথ। অমরনাথ রজনীকে বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করে তার প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করে বললো, আপনাদের বিষয় সম্পদের মালিক আসলে এই রজনীই। এতে শচীন্দ্র বিষ্মিত হলেন এবং অবিশ্বাস করলেন। অমরনাথ বললো, তাহলে উকিলের কাছেই তার সংবাদ শুনবেন। উকিলের নোটিস পেয়ে শচীন্দ্র প্রথমতো আবিশ্বাস করলেও হতবাক হলো শক্ত প্রমাণ দেখে। আদালতের নথিপত্র, জবানবন্দী সবকিছুই রজনীর পক্ষে। এমতাবস্থায় বাধ্য হয়ে শচীন্দ্র বাবু রজনীর বিষয় আশায় ছেড়ে দিল বা দিতে বাধ্য হলো, কিন্তু রজনীদের পক্ষে সে সম্পদ গ্রহণ করতে কেউ এগিয়ে এলো না। কিছুদিন পর রাজচন্দ্র দেখা করতে এলো। শচীন্দ্র জিজ্ঞেস করলো, রজনীর কি অমরনাথের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে? রাজচন্দ্র জবাবে বললো, তাঁর এখন অনেক সম্বন্ধ আসছে বটে, তবে আপনার বাবার ইচ্ছে আপনিই রজনীকে বিয়ে করেন। আমরাও সেটি ভাল মনে করি। শচীন্দ্র বিব্রত হন। তিনি কিছুতেই এ বিয়েতে আগ্রহী নন। আগ্রহী না হওয়ার কারণ এতে তাঁর ও তাঁর বাবার সম্পদের প্রতি এক ধরনের আত্মসমর্পণ। অনেক তর্ক-বিতর্ক শেষে ছোট মা লবঙ্গলতার কাছে গিয়েও শেষ রক্ষা হলো না। কারণ ছোট মা লবঙ্গলতাও তাঁর এই বিয়ের পক্ষে। লবঙ্গলতা শচীন্দ্রকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করলো। একজন সন্যাসীকে আমন্ত্রণ জানানো হয় বাসায়। তার সঙ্গে শচীন্দ্রের আলাপের সুযোগ হয়। প্রথমতো তার কর্মকা- অপছন্দ হলেও পরবর্তীতে সন্ন্যাসীকে ভাল লাগে শচীন্দ্রের। বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরের মাঝে শচীন্দ্র তাঁকে জ্ঞানীগুণী বলে বিশ্বাস করেন। শচীন্দ্র বিয়ে প্রসঙ্গে হতাশা ব্যক্ত করলে সন্ন্যাসীর পরামর্শমতো ঘুমাতে গিয়ে সেই অন্ধ মেয়ে রজনীকেই স্বপ্নে দেখলেন। এতে শচীন্দ্র অবাক হন। এই পরিসরে লবঙ্গলতা শচীন্দ্রের সঙ্গে রজনীর বিয়ের সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করতে বদ্ধপরিকর হলো। সে মালি বৌ এবং অমরনাথের সঙ্গে দেখা করে। রজনী এক পর্যায়ে অমরনাথের কল্যাণে প্রাপ্ত তার সমস্ত সম্পদের অধিকার লবঙ্গলতাকে অর্পণের ইচ্ছা জানায়। অমরনাথ এ কথা শুনেও বিষ্ময়বোধ কিংবা হিংসা কোনটাই করলো না। বিষ্মিত হলো লবঙ্গলতা। কথাবার্তার এক পর্যায়ে লবঙ্গলতা রজনীকে এক কোণে একাকী ডেকে তার এহেন ইচ্ছের জবাবে তার নিজের আরেকটি শর্তযুক্ত ইচ্ছের কথা জানালো, বললো, শচীন্দ্র নামে আমার এক পুত্র আছে তাকেই তুমি গ্রহণ কর। এ কথার জবাবে রজনী কাঁদলো ভীষণভাবে। লবঙ্গলতাকে খুলে বললো তার ভালবাসার পূর্বাপর সমস্ত কাহিনী। লবঙ্গলতা আপ্লুত হলো। শচীন্দ্রের সঙ্গে বিয়ের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে বললো, কিন্তু রজনী অনড়। সে কিছুতেই শচীন্দ্রকে বিয়ে করবে না। অমরনাথের প্রতি কৃতজ্ঞতাই মূলত শচীন্দ্রকে বিয়েতে তার বাধা। বঙ্কিমচন্দ্রের রজনী উপন্যাসটি এভাবেই এগিয়েছে। কখনো দ্রুত কখনো ধীর গতিতে। ধীরে ধীরে শচীন্দ্রের মনে রজনীর আকাক্সক্ষা শচীন্দ্রকে অসুস্থ করে তুললো। উত্তরোত্তর অসুস্থতা বেড়েই চলেছে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল রজনীর আগমন এ অসুস্থতা থেকে মুক্তির উপায়। উপন্যাসে বঙ্কিম যে বিচিত্র ঘরানা ও দ্যোতনা তরঙ্গ রচনা করেছেন তা সে সময়ের সাহিত্য জগতে দুর্লভ সৃষ্টি। পারিবারিক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক এমনকি মনোস্তাত্ত্বিক উপন্যাস রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর রচিত রজনী উপন্যাস একটি বিশুদ্ধ মনোস্তত্ত্বমূলক পারিবারিক উপন্যাস হিসেবে বিবেচনা করা যায়। গঠনশৈলী ও চরিত্র চিত্রণের দিক থেকে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা ভাষার উপন্যাসে সে সময়ে একটি অভিনব ধারার সূচনা করেছিলেন এই রজনী উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে। অবশ্য বর্তমানেও অভিনবত্বের সে জায়গায় বর্ষা সিঞ্চিত হয়েছে বলে মনে হয় না। একজন অন্ধের পক্ষে তার বেদনা, ভালবাসা, কষ্ট, অভিমান, বিরহ, যন্ত্রণার বর্ষণকে বঙ্কিম রজনীর চরিত্রে প্রবাহিত করেছেন অনায়াশ ভঙ্গিমায়। আর তার চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে আমন্ত্রণ করেছেন লবঙ্গলতা, শচীন্দ্র, অমরনাথসহ আরো কয়েকটি চরিত্রকে। প্রাসঙ্গিকতায় কখনো কখনো লবঙ্গলতাই হয়ে উঠেছেন প্রধান চরিত্র। আবার শচীন্দ্রের চেয়ে অমরনাথও কখনো পাঠকের কাছে বেশি মানবিক, বেশি কল্যাণকামী বিবেচিত হয়েছে, যেটি পাঠকের লক্ষ্যকে করেছে অনিশ্চিত কিন্তু কৌতুহলী। এতে অবশ্য বঙ্কিমের সুক্ষ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণী শক্তির ওস্তাদীই প্রমাণিত হয়েছে সবশেষে। আর এভাবেই মানবচিত্তের গভীরে প্রবেশ করেছেন তিনি।
×