ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০৯:২৪, ৪ অক্টোবর ২০১৯

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা

বাংলাদেশ ও ভারত দুটি প্রতিবেশী দেশ। দুই দেশ আলাদা হলেও দুটি দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতিতে রয়েছে অনেক মিল। দুই দেশেরই রয়েছে সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলনের আগেও অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ভারতীয় সরকারের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। স্বাধীন বাংলাদেশের জনক জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণের পথে ভারত সরকার ছিল বলতে গেলে প্রায় একক বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ। ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানী সেনা তথা হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তখন ভারতীয় জনসম্প্রদায় এবং ভারত সরকার অসহায় বাংলাদেশী মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। আশ্রয় দিয়েছিল, অন্ন দিয়েছিল সেদিনের সব হারানো অসহায় বাংলাদেশীদের। আর এর মধ্য দিয়েই ভিত রচিত হয়েছিল বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সেই দুর্দিনে ভারতের দেয়া সমর্থন ও সাহায্যের কথা আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি আমরা। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ও ভারতের ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে ‘দীর্ঘমেয়াদী বন্ধুত্ব ও নিরাপত্তা’ চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের চুক্তি যথার্থ ছিল বলে মতামত ব্যক্ত করেন বোদ্ধারা। উভয় দেশই পরস্পরের ভৌগোলিক সীমারেখা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। দুই দেশের মানুষ যখন তাদের ইতিহাস-ভূগোল-সংস্কৃতির এক অপূর্ব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় সম্পর্ককে এক বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে, ঠিক তখনই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তি একদল কুলাঙ্গার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং এর মাধ্যমে ক্ষমতা দখলে নেয় পাকিস্তানের পরাজিত শক্তি। ক্ষমতায় এসেই শুরু করে ভারত বিরোধিতা এবং জাগিয়ে দেয় সাম্প্রদায়িক উস্কানি। যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিভিন্ন প্রকার অপকর্ম এবং বিনষ্ট হয় একাত্তরের মিলিত রক্তস্রোতে পাওয়া বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে সামরিক শাসন এবং সামরিক সমর্থন পুষ্ট সরকারের স্টিমরোলারে ধ্বংস হয় বাঙালী জাতিসত্তার সকল মূল্যবোধ, ঐতিহ্য এবং নাগরিক অধিকার। দীর্ঘ ২১ বছর অপশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ক্ষমতায় আসেন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষমতায় এসেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দেশের সম্পর্ক পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা শুরু করে বাড়িয়ে দেন বন্ধুত্বের হাত। যার অন্যতম ফল হিসেবে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক গঙ্গা জল বণ্টন চুক্তি হয়। সে সময় বাংলাদেশ ও ভারতের নিরাপত্তা বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও সাধিত হয়। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি ভারতের সহায়তা ছাড়া অসম্ভব ছিল। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নতুন নতুন যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে এই সময় দুই দেশের সম্পর্ক আরও এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু তা আর বেশিদিন সম্ভব হয় না। আবারও শুরু হয় ষড়যন্ত্র। ফলে দুই দেশের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক তৈরি হতে শুরু করে। এর সঙ্গে আবারও যোগ দেয় স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তানপন্থী অপশক্তি। ফলে ২০০১ সালে কারসাজির কারণে ক্ষমতা হারান শেখ হাসিনা। ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচার, সীমান্তে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ চোরাচালান চেষ্টা, একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রীকে হত্যার চেষ্টায় জনসমাবেশে গ্রেনেড হামলাসহ অনেক জঘন্য কাজ ২০০১-২০০৬ -এ সংঘটিত হয়। তবে আবারও সত্যের জয়ের মতোই সকল দুর্যোগ সামাল দিয়ে ২০০৮-এর শেষে ক্ষমতায় ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। যার মধ্য দিয়ে আবারও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নয়নের একটি নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। ২০০৮ থেকে ২০১৯ টানা ১১ বছর ক্ষমতায় আছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এখন তিনি সফল রাষ্ট্রনায়ক এবং জনপ্রিয় বিশ্বনেত্রী। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে অর্থনৈতিক বিনিময় বিস্তৃতকরণের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক ত্বরান্বিত হয়। শেখ হাসিনা সরকারের জোরালো সাম্প্রদায়িক বিরোধী অবস্থান ভারতীয়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একই সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ উত্থানের সম্ভাবনাকেও তিনি শক্ত হাতে দমন করেন। যার ফলে বাংলাদেশে ভারত বিরোধী শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাকে নিয়ন্ত্রণ করার দুর্লভ সুযোগ লাভ করে। ফলশ্রুতিতে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কে নতুন দিগন্তের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ট্রানজিট সুবিধা, সীমান্ত সমস্যার সমাধান, ভারত থেকে বিদ্যুত আমদানি, ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ দান, যৌথ সমর্থনে ভুটান- নেপাল ট্রানজিট সুবিধা, ছিট মহল বিনিময়, প্রতিবছর ১৫ লাখ বাংলাদেশীকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিসা প্রদানসহ অনেক উল্লেখযোগ্য বিষয় রয়েছে গত এগারো বছরের খতিয়ানে। তাছাড়া ২০১১ সালে ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ও ২০১৪ সালে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা দেয় ভারত বাংলাদেশকে। প্রধানমন্ত্রী ৩-৬ অক্টোবর ভারত সফর করবেন। মূলত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের নিমন্ত্রণে যাচ্ছেন তিনি। বিশ্বের অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও বিজনেস আইকন থাকবেন এই প্রোগ্রামে। ৫ অক্টোবর মোদি-হাসিনা বৈঠকের দিন ধার্য হয়েছে। আর এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে অনেক সম্ভাবনাময় দিক খুলে যাবার প্রত্যাশাই করছে দুই দেশ। দুই মিত্র দেশের সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে কিছু অমীমাংসিত ইস্যু। যেমন, বহুল আলোচিত তিস্তা চুক্তি। আশা করা যায়, নতুন ও ইতিবাচক পথ খুলবে দুই নেতার আন্তরিক বৈঠকে। রোহিঙ্গা শরণার্থী সম্যস্যার মতো রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের জোরালো ভূমিকা বাংলাদেশ আশা করে। নাগরিকত্ব নির্ধারণ শুমারি (এন আর সি), এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; যা নিয়ে দু’দেশেই উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে আশা করা যায় নিষ্পত্তি হবে সকল উৎকণ্ঠার এবং সুন্দর সমাধানের মধ্য দিয়ে অটুট রবে বন্ধুত্ব। তাছাড়া দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত সুরক্ষা, ব্লু-ইকোনমি, মহাকাশ গবেষণা, সাইবার নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতাসহ নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়ে দুই বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের মাধ্যমে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় ও শক্তিশালী হবে, এটাই সকলের প্রত্যাশা । লেখক : সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদশ [email protected]
×