ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সব নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হবে?

প্রকাশিত: ১১:২১, ৩ অক্টোবর ২০১৯

সব নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হবে?

বহুদিন ধরেই সবার মুখে মুখে ঘুরছে যে, ১) সব কাজ করার নির্দেশ কেন প্রধানমন্ত্রীকেই দিতে হয়? ২) জামায়াত-বিএনপির ক্যাডাররা কেন আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করে সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হওয়ার কাজটি চালিয়ে যেতে পারছে? এখন যে কোন সাধারণ-অসাধারণ ঘটনা ঘটলেই মন্ত্রী-সংসদ সবার মুখে এক রা- ‘প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী নির্দেশ দিয়েছেন!’ বিষয় কি? এটাও কোন ষড়যন্ত্রের অংশ নয়তো? ১৯৭২ থেকে বঙ্গবন্ধুকে অনেক বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল সে সময়ে সদ্য স্বাধীন ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশের অবকাঠামো থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে অসংখ্য কর্মসূচী গ্রহণের জন্য। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হচ্ছিল, যেগুলো আজ দেখা যাচ্ছে এতটাই জরুরী এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিল যে, জাতির পিতার অসাধারণ প্রজ্ঞা, সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও ধারণা আমাদের বিস্মিত করছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, সে সময়ই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি তাঁর, তাঁর পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে সুকৌশলে চরিত্রহানিকর প্রচারণা চালাচ্ছিল দেশী-বিদেশী শক্তির সহযোগিতায়। যার মধ্যে অন্যতম ছিল দরিদ্রবান্ধব বঙ্গবন্ধুকে স্বৈরশাসক, সামন্ত জমিদার হিসেবে প্রচার করা। এ প্রচারণা শুরু হয়ে গিয়েছিল যখন ‘বাকশাল’ গঠিত হয়েছিল, যেটি ছিল দল-মত নির্বিশেষে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের বিপক্ষে ঐক্যবদ্ধ করার একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। পাশাপাশি এর পরিপূরক হিসেবে জেলা গবর্নর ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রশাসনকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর পদক্ষেপটি মাত্র ১৬ আগস্ট একটি সম্মেলনের মাধ্যমে সূচিত হওয়ার কথা ছিল! এর ফল হতো সূদূরপ্রসারী। কেননা, সদ্য যুদ্ধজয়ী আমলা, প্রশাসনের কর্মকর্তারা তখন ছিল পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী, যারা প্রত্যন্ত জেলায় সদ্য মুক্তিযুদ্ধ করে এসেছেন। তারা এই জনকল্যাণমুখী কার্যক্রমকটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতেন এবং দরিদ্র গ্রাম ও মফস্বলবাসী সব রকম সেবা সহজে লাভ করত। এদিকে সবুজ বিপ্লব চলছে কৃষিখাতে। অন্যদিকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমও চলছে সমান তালে, যেমন পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে শুরু হয়েছিল! যাই হোক, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাঙালী শুধু যে জাতির জনক ও তাঁর পরিবারকেই হারিয়েছে তা নয়, তাদের মুক্তিযুদ্ধও সাময়িকভাবে এর বিরোধীপক্ষের কাছে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পরাজিত হয়েছিল। এখন আমাদের মনে এ প্রশ্ন উঠেছে- কেন বিশাল জঙ্গী দমন, মাদক ব্যবসা দমন এবং সর্বোপরি হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি দমনের মতো অপরাধে নিযুক্ত, এর বিশাল উপকারভোগী, বিশাল ক্ষমতাবান নানা পেশার ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর একমাত্র নির্দেশদাতা হিসেবে সরকারী দলের উঁচু-নিচু সব পর্যায়ের নেতারা প্রধানমন্ত্রীর নাম উচ্চারণ করছেন কেন? তাহলে তাদের এত দীর্ঘদিনের রাজনীতি কি কোনভাবেই দায়িত্ববান করেনি? প্রশ্ন উঠেছে- ১. প্রধানমন্ত্রীকে সামনে এগিয়ে দিয়ে সরকারী দলের সব নেতা কি এই দুর্নীতি দমন অভিযান থেকে নিজেদের কিছুটা বিযুক্ত রাখছেন? তারা নিরাপদ দূরত্বে সরে থাকছেন কি? আমি তো লজ্জায় মাথা নুয়ে থাকি যখনি আওয়ামী লীগের নেতারা বীরদর্পে এ অভিযান যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে চলছে, সেটি বারংবার ঘোষণা করেন! কেন ওনারা লজ্জিত বোধ করছেন না? এ প্রশ্ন না করে পারি না। ২. আমার প্রশ্ন- কেন এই দুর্বৃত্ত, প্রাক্তন ছাত্রদল কর্মী, হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত অপরাধী হাজার হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে বড় বড় সরকারী মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে? শুনছি, এই বিশাল বডিগার্ড নিয়ে চলা মাফিয়ার উত্থানের ফলে ভাল ঠিকাদাররা টেন্ডারে অংশ নেননি এবং টেন্ডারে এমন সব শর্ত আরোপ করে মিথ্যা অভিজ্ঞতা যুক্ত করেছে মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পদাধিকারী আমলা-প্রকৌশলীরা! জনগণ আশা করে, তাকে অনেক অন্যায়ের মাধ্যমে যেসব ঠিকাদারি কাজ দেয়া হয়েছিল, সেসব দুর্বৃত্ত সহায়ক কর্মকর্তাদেরও তদন্ত করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। নতুবা এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ব্যর্থ হয়ে যাবে। একবার যদি সাপ মাথাটি মুক্ত করতে পারে, তাহলে শুধু প্রধানমন্ত্রী নয়, সরকারের সব মন্ত্রী-নেতা সবাইকে সর্বশক্তি দিয়ে সে ছোবল দেবে। এ কথাটি স্মরণে রাখতে অনুরোধ করছি। যে কাক্সিক্ষত কাজটি শুরু হয়েছে সেটি কিন্তু কোন অবস্থায় কোন রকম ভয়ের কাছে যেন মাথা না নোয়ায় এবং তদন্ত, বিচার ও দণ্ড প্রদানের শেষ স্তর পর্যন্ত হাতে নেয়া কার্যক্রমটি সম্পন্ন করতে হবে। নতুবা, কারও নিস্তার নেই। ৩. জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বঙ্গবন্ধু তাঁর অসীম কর্মকুশলতার দ্বারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে যাদের তিনি ‘চাটার দল’ নামে অভিহিত করতেন, তাদের চাকরিচ্যুত করেছিলেন, যাদের মধ্যে আমলা ছিল সর্বাধিক। এর কিছুদিন পরই ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা- এবং এর পর পর ৩ নবেম্বর ঢাকা জেলে তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানের মতো উজ্জ্বল রাজনীতিক, বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহচর চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয় এবং ৩ থেকে ৭ নবেম্বরের মধ্যে ক্যু হিসেবে উল্লিখিত সেনা বিদ্রোহ ও সেনা বিশৃঙ্খলায় হত্যা করা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হায়দার, কর্নেল নাজমুল হুদাসহ কতিপয় সেনাকে। আওয়ামী লীগ সরকার ও দলকে সতর্ক করে দিয়ে বলতে চাই, ‘কান টানলে মাথা আসা’র মতোই দলও সরকারের। প্রশাসনের আমলা, যারা এসব দুর্বৃত্তকে ঠিকাদারির কাজগুলো দিয়েছে, থানা-পুলিশের যারা নাকের ডগায় দুর্বৃত্তদের সরল সহজ যুবকদের জুয়ার ফাঁদে ফেলে শূন্যহস্ত করার কাজটি দিনের পর দিন চালিয়ে যেতে দিয়েছে তাদের সবাই এতক্ষণে একজোট হয়ে গেছে। তারা কোন দ্বিতীয় ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্র করছে কিনা, সে বিষয়ে গোয়েন্দাদের তথ্য সংগ্রহ করে দ্রুততম সময়ে এদের গ্রেফতার, ঠিকাদারি কাজ বন্ধ করে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া দরকার। কোন আইনী পদক্ষেপ গ্রহণে বিলম্ব করা যাবে না। এমনকি এদের জামিনও যাতে দেয়া না হয়, সে বিষয়ে আইনজীবীদের অনুরোধ করতে হবে। আইনজীবীদের জঙ্গীদের জামিনের জন্য না দাঁড়ানোর অনুরোধ আগেও করা হয়েছিল, যেটি তারা মানেননি। এবারে, এই দুর্বৃত্তদের জামিন দেয়া হবে আরও আত্মবিনাশী, এতে কোন সন্দেহ নেই। একটা কথা মনে পড়ছে- প্রধানমন্ত্রী যখন আমলা ও সরকারী কর্মকর্তাদের বেতন দ্বিগুণ করেন, তখন আমাদের অনেকেরই মনে হয়েছিল একটা কথা সমাজে প্রচলিত আছে- ‘স্বভাব যায় না ম’লে’। আমলারা অনেক অর্থের প্রকল্প নাড়াচাড়া করেন। দীর্ঘদিনের চুরির অভ্যাস সেই টাকার পার্সেন্টেজ লাভের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে। সে অভ্যাস কি চলে যাবে? দেখতে পাচ্ছি, যা সন্দেহ করেছিলাম তাই ঘটছে। পার্সেন্টেজের অর্থের লোভ থেকে ওরা মুক্ত হতে পারেনি! ওরা ওদের পছন্দের দুর্বৃত্ত ঠিকাদারকেই হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও কৌশলে দিয়েছে। আমলাদের ফাইল আটকে কাজ বন্ধ রাখা যেমন দেখেছি, তেমনি দুর্বৃত্তপ্রেমী আমলারা এখনও বহাল তবিয়তে আছে দেখতে পাচ্ছি। বেতন দ্বিগুণ করে কোন লাভ হয়েছে কি? এদিকে ব্যাংকে ঋণখেলাপী, শেয়ারবাজার লুটেরাও বহাল তবিয়তে আছে। ওরাও দুর্নীতিবাজদের তালিকার ওপরেই অবস্থান করে। ওরাও বার্তা পেয়েছে। সন্দেহ হয়, ওরাও ওদের সঙ্গে মিলে কোন ষড়যন্ত্রে নিয়োজিত কিনা! এখন আওয়ামী লীগ সরকার ও দলকে নিজস্ব উৎস থেকে দুর্বৃত্তদের অপতৎপরতার তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। ওদের পরিকল্পিত কোন আসন্ন দুর্যোগ-ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তরুণ প্রজন্ম দেশপ্রেমিক। তাদেরও জাতির বর্তমান ক্রান্তিকালে মুক্তিযুদ্ধের সরকারের পাশে উপযুক্ত সহায়তা দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×