ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ব্যয় হবে ২৭৭ কোটি টাকা;###;খুলনা সাতক্ষীরার আড়াই লাখ মানুষ সুপেয় পানি পাবে

উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু অভিযোজন সক্ষমতা বাড়াতে প্রকল্প

প্রকাশিত: ১১:০৪, ৩ অক্টোবর ২০১৯

উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু অভিযোজন সক্ষমতা বাড়াতে প্রকল্প

ওয়াজেদ হীরা ॥ উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু অভিযোজন সক্ষমতা ও সহিষ্ণুতা বাড়াতে প্রকল্প নিয়েছে সরকার। এতে দেশের প্রায় আড়াই লাখ মানুষের জন্য লবণাক্ততামুক্ত ও দুর্যোগ সহনশীল সুপেয় পানি নিশ্চিত হবে। বছরব্যাপী এই সুবিধা পাবেন খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার ৩৯টি ইউনিয়নের ৫৫ হাজার পরিবারের সদস্য। এছাড়াও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মিলিয়ে প্রায় সাত লাখের বেশি মানুষ সুবিধা পাবেন। এর জন্য খরচ হবে প্রায় ২৭৭ কোটি টাকা। একই সঙ্গে ওই অঞ্চলের ৪৩ হাজার পরিবারের নারী সদস্যদের জন্য জলবায়ু সহিষ্ণু জীবিকার সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও বিপণন ব্যবস্থা উন্নয়নের মাধ্যমে অভিযোজন সক্ষমতা গড়ে তুলতে চায় সরকার। সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় ‘উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর, বিশেষত নারীদের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত লবণাক্ততা মোকাবেলায় অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। মহিলাবিষয়ক অধিদফতর এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প নেয়ার পর মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প অবহিতকরণ সভায় এই প্রকল্প নিয়েও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সেবা দিতে উদ্যোগের কথা জানানো হয়। বলা হয়, এই প্রকল্পের আওতায় খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের নারী ও কিশোরীদের জলবায়ুসহিষ্ণু জীবিকা অর্জনের জন্য সহায়তা দেওয়া হবে, পাশাপাশি নিরাপদ ও বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির জন্য কমিউনিটিভিত্তিক বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় সাহায্য করা হবে। একনেকে পাস হওয়ার পর এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বসবাসরত বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর, বিশেষ করে নারীদের জলবায়ু পরিবর্তন সৃষ্ট লবণাক্ততার ঝুঁকি প্রশমন ও অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি করে সুপেয় পানির প্রাপ্যতা এবং জীবিকার মান উন্নয়নে সহায়ক হবে। এসব কারণেই এ প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন করা হয়েছে। নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুন নাহার জনকণ্ঠকে বলেন, প্রাথমিকভাবে এটি একনেকে পাস হয়েছে। এখন প্রশাসনিক অর্ডার পাব, ফান্ড পাব। আমরা প্রকল্পের জন্য পিডি নিয়োগ করব। এক কথায় যদি বলি তবে কাজটি চলমান। ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ওইসব অঞ্চলের বিশেষ করে নারীদের সুবিধা বাড়বে বলে মনে করেন সচিব। এর আগে প্রকল্প অবহিতকরণ সভা বিষয়ে সচিব বলেন, আমাদের অন্য প্রকল্পগুলো নিয়ে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সবাইকে অবহিত করেছি। যেহেতু এটি একনেকে পাস হয় তাই এর সুফল কি হবে সেটিও আলোচনা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন, কয়রা উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন, পাইকগাছা উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন এবং সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন, শ্যামনগর উপজেলার আটটি ইউনিয়নসহ মোট ৩৯টি ইউনিয়নের ৫৫ হাজার পরিবারের ৪৫ হাজার ৫১৬ জন মানুষ সারা বছরই সুপেয় পানি পাবেন। এছাড়াও প্রকল্পে সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠির সংখ্যা ৭ লাখ ১৯ হাজার ২৯ জন। প্রকল্প এলাকা বাছাইয়ে কারণ হিসেবে বলা হয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ঝুঁকি, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে অবস্থান, ক্রমাগতভাবে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি, দুর্ভোগের কারণে দারিদ্র্যতা বৃদ্ধিসহ এলাকার মানুষ জীবন-জীবিকা এবং পানীয় জলে লবণাক্ততার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এসব এলাকা প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দেওয়া হবে ৬৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আর বৈদেশিক সহায়তা বাবদ গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) থেকে পাওয়া যাবে ২০৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র আরও জানান, প্রকল্পের আওতায় উপকূলীয় কৃষিজীবী জনগোষ্ঠী বিশেষত নারীদের জলবায়ু সহিষ্ণু জীবিকায়নে অভিযোজন দক্ষতা বাড়ানো হবে। ৪৩ হাজার নারীকে জীবিকা সহায়তা দেওয়া হবে। এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ও উপকরণ দেওয়া হবে। কাঁকড়া চাষ, গৃহস্থালী পর্যায়ে সবজি চাষ, তিল চাষ, লবণাক্ততা সহিষ্ণু নার্সারি এবং বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন শেখানো হবে। কমিউনিটিভিত্তিক উদ্যোক্তা তৈরি হবে। বাজারজাতকরণ এবং সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের জন্য সহযোগিতা করা হবে। সমাজভিত্তিক মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়াও সম্প্রতি সময়ে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী ও কিশোরীর জন্য জলবায়ু অভিযোজন ও সহিষ্ণুতা বাড়াতে নেয়া প্রকল্পগুলো বিষয়ে এক অবহিতকরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। অবহিতকরণ কর্মশালায় এই প্রকল্প নিয়েও আলোচনা হয়। সেখানে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুন নাহার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে নারীদের ক্ষতি বেশি হয়। তাই তাদের সক্ষমতা বাড়াতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নারীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের চেঞ্জ এজেন্ট হিসেবে গড়ে তোলা হবে, যা হবে দৃষ্টান্তমূলক। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে জীবন ও জীবিকা রক্ষার জন্য নারীরা এখানে পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও পরিচালনা করবে। একই কর্মশালায় ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি সুদীপ্ত মুখার্জি বলেন, কাউকে পেছনে না ফেলে, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আর এই লক্ষ্যে আমরা সরকার ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা যেমন জিসিএফের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। নারীরা যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে, তাই তাদের বাদ দিয়ে কোনভাবেই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। জানা গেছে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার পাঁচটি উপজেলার ৩৯টি ইউনিয়নের ৪৩ হাজার পরিবারের নারী সদস্যদের জলবায়ু সহিষ্ণু জীবিকার সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও বিপণন ব্যবস্থা উন্নয়নের মাধ্যমে অভিযোজন সক্ষমতাও গড়ে তোলা হবে। এই ৩৯টি ইউনিয়নে ১০১টি নারী স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করা হবে। প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সহায়তার মাধ্যমে নারী সংবেদনশীল পূর্ব সতর্কীকরণ ও দুর্যোগ প্রস্তুতি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। মহিলাবিষয়ক অধিদফতর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু অভিযোজন বিষয়ক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রায়োগিক দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো হবে। সুপেয় পানির ব্যবস্থার লক্ষ্যে নলকূপ স্থাপনের জন্য নির্দিষ্ট সাইট ম্যাপিং, উপকারভোগী নির্বাচন এবং কমিউনিটি ব্যবস্থাপনা কাঠামো গঠন করা হবে। ১৩ হাজার ৩০৮ পরিবারের জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং এই পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকবে। ৪১টি পুকুরভিত্তিক পানি শোধনাগার নির্মাণ করা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত জীবিকায়ন এবং নিরাপদ খাবার পানি বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানো হবে। উপকূলীয় জীবনযাত্রা এবং জলবায়ু সহিষ্ণু জীবিকা সম্পর্কিত নারী-পুরুষ সাম্যতার প্রতি সংবেদনশীল কৌশল প্রণয়নে মহিলাবিষয়ক অধিদফতর এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও সমন্বয় দক্ষতা শক্তিশালীকরণের কাজ করা হবে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলেই প্রকল্পটি নেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর বিশেষত নারীদের উপকার হবে। এছাড়াও কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের মাধ্যমে ৪৩ হাজার দরিদ্র নারীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহজ হবে। ৪৩ হাজার নারীকে জীবিকা সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে এ প্রকল্প এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নোনা উপদ্রুত উপকূলীয় অঞ্চল হিসেবে ছয়টি জেলাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। জেলাগুলো হলো সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোর, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা। এসব জেলায় জীবন-জীবিকার উন্নয়নে বিশেষ বাজেট বরাদ্দ ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কর্মসূচী গ্রহণ করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পটি লবণাক্ততা সহিষ্ণু জীবিকায়ন ও নিরাপদ সুপেয় পানির ব্যবস্থা করে সরকারের উদ্যোগকে আরও শক্তিশালী করবে। পান করার জন্য এবং গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারের জন্য নিরাপদ পানির সহজ প্রাপ্তি নারীর ক্ষমতায়নকে প্রশস্ত করে। এতে তাদের যে সময় বেঁচে যায় সেই সময় তারা অন্য কোন উৎপাদনমুখী কাজে ব্যয় করতে পারবেন। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকা-ে নারীর অংশগ্রহণ বাড়বে। প্রকল্পটি ১৩ হাজার ৩০৮টি পরিবারভিত্তিক, ২১৮টি কমিউনিটিভিত্তিক এবং ১৯টি প্রতিষ্ঠানভিত্তিক বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্ল্যান্ট স্থাপন এবং ৪১টি পুকুরভিত্তিক পানি শোধনাগার স্থাপনের মাধ্যমে সরকারের কর্মকৌশল বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন উপকূলের মানুষ সারা বছর সুপেয় পানির জন্য যে কষ্ট করেন তার একটা সমাধান হতে পারে এর মাধ্যমে। এছাড়াও উপকূলের নারীরা অনেক সময় থাকে কর্মহীন। কাজের প্রশিক্ষণ পেলে নারীরা বাড়তি উপার্জন পাবে সেটি প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
×