ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

১৯৪৬-৪৭ সালে মি. গান্ধী নোয়াখালীতে হেঁটে ৪৭ গ্রাম পরিদর্শন করেন

প্রকাশিত: ০১:৪২, ২ অক্টোবর ২০১৯

১৯৪৬-৪৭ সালে মি. গান্ধী  নোয়াখালীতে হেঁটে  ৪৭ গ্রাম পরিদর্শন করেন

অনলাইন ডেস্ক ॥ ভারত ভাগের এক বছর আগে নোয়াখালীতে যে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয় তার পর মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ঐ অঞ্চলে গিয়ে প্রায় মাস তিনেক সময় কাটান। এ সময় বেশিরভাগ পায়ে হেঁটে তিনি পুরো অঞ্চলটি ঘুরে বেড়ান, হিন্দু-মুসলমান সমাজের নানা অংশের সাথে কথা বলেন, এবং বিভিন্ন জনসভায় গিয়ে ভাষণ দেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল একটাই: এই হানাহানি বন্ধ করে দুর্বলকে রক্ষা করা। মি. গান্ধীর ঐ সফরের এক পর্যায়ে তাঁর একটি ছাগল চুরি যায়। তিনি ছাগলের দুধ পান করতেন। ফলে, এই চুরির ঘটনার জন্য দায়ী করে নোয়াখালীবাসীকে হেয় করার প্রচেষ্টা আজকের দিনেও দেখা যায়। কিন্তু ঐ সামান্য ঘটনার আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে ঐ অঞ্চলের এক রক্তাক্ত ইতিহাস। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের এক বছর আগে থেকেই অবিভক্ত বাংলা প্রদেশ ছিল অগ্নিগর্ভ। হিন্দু ও মুসলমান সমাজের পারষ্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস আর ঘৃণা এমন এক অবিশ্বাস্য পর্যায়ে পৌঁছেছিল যার জেরে ১৬ই অগাস্ট, ১৯৪৬ ঘটে যায় পূর্ব ভারতের ইতিহাসের কুখ্যাত সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞ - 'দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস'। দাঙ্গা শুরুর প্রথম ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রাণ হারান ৪,০০০ নিরীহ হিন্দু ও মুসলমান, এবং গৃহহীন হন এক লক্ষেরও বেশি মানুষ। ঐ দাঙ্গার কিছু বিলম্বিত প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন নোয়াখালীতে শুরু হয় আরেকটি হত্যাযজ্ঞ। যেভাবে শুরু হয় দাঙ্গা: দশই অক্টোবর ছিল কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন। উত্তপ্ত সাম্প্রদায়িক আবহাওয়ার মধ্যে হঠাৎ করেই একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে। গুজবটি ছিল: লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থানার করপাড়ার জমিদার রাজেন্দ্রলাল চৌধুরীর বাড়িতে ভারত সেবাশ্রম সংঘের এক সন্ন্যাসী এসে উঠেছেন। তার নাম সাধু ত্রিয়াম্বাকানন্দ। তিনি নাকি ঘোষণা করেছেন, পূজার জন্য ছাগবলির বদলে এবার তিনি মুসলমানের রক্ত দিয়ে দেবীকে প্রসন্ন করবেন। এটা বারুদে স্ফুলিঙ্গের কাজ করে। করপাড়া থেকে সামান্য দূরে শ্যামপুর দায়রা শরীফ। গোলাম সারোয়ার হুসেইনী এই পীর বংশের উত্তর পুরুষ। গুজব পত্রপল্লবে ছড়িয়ে পড়ার পর তিনি ১০ই অক্টোবর ভোরবেলা চৌকিদারের মারফৎ রাজেন্দ্রলাল চৌধুরীর কাছে একটি চিঠি পাঠান এবং বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেন। কিন্তু মি. চৌধুরী এতে সাড়া না দিলে গোলাম সারোয়ার হুসেইনী সকালে শাহ্‌পুর বাজারে তার অনুগত ভক্ত এবং মুসলমানদের এক সমাবেশ ডাকেন। সেখানে তিনি মুসলমানদের সেই সময়কার অবস্থান তুলে ধরেন এবং হিন্দু জমিদারকে উৎখাত করার ডাক দেন। অভিযোগ রয়েছে, ঐ সমাবেশ থেকে তিনি জমিদার ও সাধুর কল্লা কেটে আনার নির্দেশ দেন। এরপরই সহিংসতার আগুন ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। শাহ্‌পুর বাজারের সব হিন্দু ব্যবসায়ীদের দোকানপাট লুঠ করা হয় এবং আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। রামগঞ্জ এবং দশঘরিয়া বাজার লুঠ হয়। নারায়ণপুরের জমিদার সুরেন বোসের কাছারি বাড়িতে হামলা হয়। পরের দিন ১১ই অক্টোবর সকাল বেলা করপাড়ার চৌধুরী বাড়িতে হামলা হয়। পরিবারটি প্রথম দিকে বন্দুক ব্যবহার করে হামলাকারীদের ঠেকিয়ে রাখলেও একসময় তাদের গুলি ফুরয়ে যায়। উত্তেজিত জনতা এসে রাজেন্দ্রলাল চৌধুরীর মাথা কেটে ফেলে। সাধু ত্রিয়াম্বাকানন্দ এর আগেই কোনক্রমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যান। রায়পুরের জমিদার চিত্তরঞ্জন রায় চৌধুরী নোয়াখালীতে মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক শক্তিকে গোড়া থেকেই মেনে নিতে পারছিলেন না। এ নিয়ে তার সাথে গোলাম সারোয়ার হুসেইনীর শুরু হয় দ্বন্দ্ব। কংগ্রেস নেতাদের কাছে চিঠি: যেহেতু মি. রায় চৌধুরী কংগ্রেসের সাথে যুক্ত ছিলেন, তাই মি. হুসেইনী কংগ্রেসের বিভিন্ন নেতা এমনকি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর কাছেও চিঠি পাঠিয়ে জমিদারের অত্যাচারের কথা জানান এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু কোন সাড়া না পেয়ে তিনি নিজেই চিত্তরঞ্জন রায় চৌধুরীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের ডাক দেন। তার অধীন আধাসামরিক বাহিনী 'মিয়ার ফৌজ' এবং এক সহযোগীর অধীন 'কাশেম ফৌজ'র সদস্যরা রায়পুরের জমিদার বাড়ি অবরোধ করে। এ নিয়ে শুরু হয় সংঘর্ষ, যার পরিণামে মি. রায়চৌধুরী তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করেন। এসব ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়লে নোয়াখালী জেলার রায়পুর, রামগঞ্জ, বেগমগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, ছাগলনাইয়া এবং পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা (বৃহত্তর কুমিল্লা) জেলার চাঁদপুর, চৌদ্দগ্রাম, হাজীগঞ্জ, ফরিদগঞ্জ এবং লাকসাম থানার বিশাল এলাকাজুড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ধারণা করা হয়, এসময় ঐ অঞ্চলের পাঁচ হাজারেরও বেশি হিন্দু প্রাণ হারান। ইতিহাসবিদরা মূলত তিনটি কারণে নোয়াখালীর হত্যাযজ্ঞকে ভারতের অন্যান্য জায়গার হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সাথে তুলনা করতে চান না। প্রথমত, এখানে দুই পক্ষের শক্তি সমান ছিল না, যেমনটি দেখা গিয়েছিল কলকাতা দাঙ্গার সময়। এখানে মূলত হিন্দু জনগোষ্ঠী হামলার শিকার হন। দ্বিতীয়ত, ঐ হত্যাযজ্ঞের সময় এবং পরে বহু হিন্দু নারীকে ধর্ষণ করা হয়। তৃতীয়ত, হাজার হাজার হিন্দু নারী-পুরুষদের জোর করে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়। যাদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল তাদের কাছ থেকে লিখিয়ে নেয়া হয়েছিল যে তারা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু যাকে কেন্দ্র করে এসব ঘটনা ঘটছিল সেই গোলাম সারোয়ার হুসেইনীর একটি রাজনৈতিক পরিচয়ও ছিল। গদ্দিনশীন পীর ছাড়াও তিনি ছিলেন নোয়াখালী কৃষক সমিতির অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা। কৃষকের খাজনা মওকুফ, ঋণ সালিশি বোর্ড থেকে সুদখোর ব্যবসায়ীদের উৎখাত করা এবং জমিদারি বাজার বয়কট করার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি তৎকালীন নোয়াখালীর ক্ষমতাধর হিন্দু জমিদার এবং মহাজনদের চক্ষুশূল হয়েছিলেন। ১৯৩৭ সালে রামপুর ও রায়গঞ্জ নির্বাচনী এলাকার কৃষক প্রজা পার্টির টিকেটে নির্বাচন করে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে ১২,০০০ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন এবং বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। অবশ্য পরে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগ প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। কিন্তু তার কৃষকপন্থী নীতির কারণে তিনি কখনই নোয়াখালীর 'হিন্দু ভদ্রলোকদের' কাছের মানুষ হতে পারেননি। যার পরিণতিতে কংগ্রেস তার ব্যাপারে প্রথমদিকে আগ্রহী হলেও পরে আর তাকে দলে টানতে পারেনি। বলা যায়, নোয়াখালীর মুসলমান কৃষকের দলে টানার প্রচেষ্টা মূলত তিনি নস্যাৎ করে দেন এবং এককভাবে নোয়াখালীর গ্রামীণ সমাজের ক্ষমতার বিরোধকে 'হিন্দু-মুসলমান ইস্যুতে' পরিণত করেন। শান্তির লক্ষ্যে পদযাত্রা: নোয়াখালী দাঙ্গার চার সপ্তাহের মধ্যে হাজার হাজার হিন্দু ঘরবাড়ী হারিয়ে কুমিল্লা, চাঁদপুর, আগরতলা ও অন্যান্য জায়গার অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে আশ্রয় নিতে শুরু করেন। এই পটভূমিতে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী নোয়াখালীতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। গবেষকরা বলছেন, নোয়াখালীতে গিয়ে কী করতে চান কিংবা কী হবে তার কৌশল -- যাত্রার আগে, এমনকি যাত্রার সময়ও, মি. গান্ধী সে সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। তিনি শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন যে তার সেখানে যাওয়া দরকার। পরিস্থিতির জটিলতা অনুধাবন করে তার সফরের এক পর্যায়ে তিনি তার সেক্রেটারি নির্মল কুমার বোসকে বলেছিলেন, তাকে হয়তো নোয়াখালীতে বহু বছর থাকতে হবে। মি. গান্ধী নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন ৬ই নবেম্বর। পরদিন চৌমুহনীতে যোগেন্দ্র মজুমদারের বাড়িতে দুই রাত কাটিয়ে ৯ই নবেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি তার শান্তির লক্ষ্যে পদযাত্রা শুরু করেন। এর পরের দিনগুলোতে তিনি খালি পায়ে মোট ১১৬ মাইল হেঁটে প্রায় ৪৭ টি দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাম পরিদর্শন করেন। এসময় তিনি নিয়মিত প্রার্থনা সভা পরিচালনা ছাড়াও স্থানীয় মুসলমানদের সাথে বৈঠক করে হিন্দুদের আস্থা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। নোয়াখালীতে এসে মি. গান্ধী গোলাম সারোয়ার হুসেইনীর সাথেও দেখা করতে চান। মি. হুসেইনী ততদিনে মি. গান্ধীর ওপর সম্পূর্ণভাবে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাই তিনি প্রথম দিকে সাক্ষাতে রাজী ছিলেন না। পরে মি. গান্ধীর আহ্বানে চাটখিলে দুজনের মধ্যে বৈঠক হয়। বৈঠকে তিনি গান্ধীকে বলেন যে, দাঙ্গার সূত্রপাত নোয়াখালীতে নয়। কলকাতা ও বিহারে যখন দাঙ্গা থেমে যাবে তখন নোয়াখালীতেও হানাহানি বন্ধ হবে। গান্ধীর ছাগল: মি. গান্ধী ছাগলের দুধ পান করতেন। তাই তিনি সাথে করে একটি ছাগল এনেছিলেন। কিন্তু চাটখিলের বৈঠকের আগে কাশেম ফৌজের লোকজন ছাগলটিকে হস্তগত করেছিল। চাটখিলে ঐ বৈঠকে সেই ছাগলের রান্না মাংস নিরামিষাশী মি. গান্ধীর সামনে পরিবেশন করা হয়। এর মাধ্যমে মি. হুসেইনী একটি বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলেই জানা যায়। তবে নোয়াখালীতে হিন্দু-মুসলিমে সম্পর্কের মধ্যে যে পারষ্পরিক ঘৃণা ও অবিশ্বাসের দেয়াল তৈরি হয়েছিল মি. গান্ধীর মতো ক্ষমতাধর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও তা ভেঙে ফেলতে ব্যর্থ হন বলেই গবেষকরা বলছেন। ইতোমধ্যে নোয়াখালীর ঘটনার জের ধরে বিহারে শুরু হয় দাঙ্গা। এতে প্রচুর মুসলমান প্রাণ হারাতে শুরু করলে মুসলিম লীগ নেতারা তাকে বিহারে যেতে অনুরোধ করে। ভগ্নহৃদয়ে নোয়াখালী শান্তি মিশন অসমাপ্ত রেখেই মি. গান্ধী ১৯৪৭ সালের ২রা মার্চ বিহারের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। নোয়াখালী সফরের একমাস পর যখন তাকে জানানো হয় যে সেখানে তখনও সহিংসতা চলছে, তখন মি. গান্ধী পরিতাপের সাথে মন্তব্য করেছিলেন, নোয়াখালীর অবস্থা এমনই দুর্বিষহ যে হিন্দুদের হয় নোয়াখালী ছাড়তে হবে, নয়তো ধ্বংস হয়ে যেতে হবে। সূত্র :বিবিসি বাংলা
×