ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পুরনো বাড়ি ঘিরে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা

বাংলাবাজার জমিদার বাড়ির প্রতিমা, ৪১ বছরের ঐতিহ্য

প্রকাশিত: ১১:১৭, ২ অক্টোবর ২০১৯

বাংলাবাজার জমিদার বাড়ির প্রতিমা, ৪১ বছরের ঐতিহ্য

মোরসালিন মিজান ॥ বাংলাবাজারের জমিদার আর নেই। জমিদার বাড়ির অস্তিত্বও বিলীন হয়ে গেছে। তবে কিছু স্মৃতিচিহ্ন এখনও চোখে পড়ে। আর এ স্মৃতির সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রতিমা গড়ার ঐতিহ্য। ৪২ বছর ধরে এখানে প্রতিমা গড়ার কাজ হচ্ছে। সারা বছরই কম বেশি হয়। এখন ব্যস্ততা চরমে। প্রতিমা শিল্পীরা খাওয়া ঘুম ভুলে কাজ করছেন। নর্থব্রুক হল রোডের পুরনো ম-পে গড়া প্রতিমা চলে যাচ্ছে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে। একই স্থানে অনেক প্রতিমা তৈরি করা হয় বলে পরিবেশটাও অন্যরকম। উৎসবের আগেই এখানে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের রং। যে জমিদারের কথা বলা হচ্ছে, অনেকেই জানেন, তিনি সুধীর চন্দ্র দাশ। নর্থব্রুক হল রোডসহ আশপাশের বহু জমি ও বাড়ির মালিক ছিলেন। অঢেল সম্পত্তি রেখে ১৯৭০ সালে পরলোক গমন করেন তিনি। পরের বছর ১৯৭১ সালে বিদায় নেন জমিদার পতœী ত্রিনয়নী দাশ। তাদের কোন সন্তান ছিল না। স্বাধীনতার পর ভারতের বহরমপুর থেকে কয়েকজন আত্মীয়স্বজন ঢাকায় এসে সম্পত্তি দেখভাল শুরু করেন। ১৯৭৫ সালের দিকে কেয়ারটেকারকে দায়িত্ব দিয়ে আবারও বহরমপুরে ফিরে যান তারা। বর্তমানে এটি দেবোত্তর সম্পত্তি। মন্দিরের দেবতার উদ্দেশ্যে এই সম্পত্তি উৎসর্গ করা হয়েছে। জানা যায়, জমিদার সুধীর চন্দ্র দাস বেঁচে থাকা অবস্থায় জমিদার বাড়িতে পূজার আয়োজন করা হতো। এখন পূজা কমিটি আছে। নর্থবুক হল সার্বজনীন পূজা উদ্যাপন কমিটি ১৯৭৭ সালে এখানে প্রথমে সরস্বতী পূজার আয়োজন করে। ১৯৭৮ সাল থেকে হচ্ছে দুর্গাপূজা। পূজার পাশাপাশি ম-পে সারা বছরই প্রতিমা তৈরির কাজ হয়। জমিদারবাড়ি ম-পের জন্য প্রতিমা গড়া হয়। একইসঙ্গে চলে অন্যান্য ম-পের জন্য প্রতিমা গড়া। মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকটি পুরনো ভাঙ্গা বাড়ি এখনও টিকে আছে। বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা। পাশেই ম-প। ম-পের ভেতরে অনেক প্রতিমা। বেশিরভাগই প্রস্তুত। বাকিগুলো প্রস্তুত করতে কাজ করছেন প্রতিমা শিল্পীরা। আগামী শুক্রবার ষষ্ঠী পূজার আগেই ক্লায়েন্টকে প্রতিমা বুঝিয়ে দিতে হবে। তাই চলছে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা। পূজা উদ্যাপন কমিটির সাবেক সভাপতি ও কার্যনির্বাহী সদস্য বেনু পাল জানান, ঢাকার অধিকাংশ ম-পে প্রতিমা তৈরির কাজ করেন বাইরে থেকে আসা শিল্পীরা। বাংলা বাজার জমিদার বাড়িতে ঢাকার শিল্পীরাই কাজ করেন। এক জায়গায় এতকাল ধরে তৈরি করার ফলে এখানকার প্রতিমার খবর সকলেই জানেন। আলাদা পরিচিতি পেয়েছে। ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবারও প্রতিমা তৈরির কাজ হচ্ছে। তিনি জানান, রথযাত্রার দিন কাঠামো পূজার মধ্য দিয়ে জমিদার বাড়িতে প্রতিমা তৈরি শুরু হয়েছিল। তারপর থেকে চলছে। জমিদার বাড়িতে এবার ১৭ সেট প্রতিমা গড়া হয়েছে। কিছু প্রতিমা ইতোমধ্যে সরবরাহ করা হয়েছে। বাকিগুলোর কাজও আজ কালের মধ্যে শেষ হবে। প্রতিমা শিল্পীরা তাই প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত কাজ করছেন। জানা যায়, জমিদার বাড়ির মূল শিল্পীর নাম বলাই পাল। পঞ্চাশ অতিক্রম করা শিল্পী এই কাজ করছেন গত ২৫ বছর ধরে। তার আগে ঠাকুর দা এবং বাবা প্রতিমা গড়ার কাজ করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় এসেছেন তিনি। এদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় বলাই পালের সঙ্গে। তিনি বলেন, একসময় ‘বাংলা মূর্তি’ বানাতাম। বাংলা মূর্তি মানে, বাসন্তী রঙে গড়া দেবী দুর্গা। গায়ে আলাদা করে শাড়ি পরানো হতো না। আর পরালেও দেশীয় তাঁতের শাড়ি পরানো হতো। এখন দামী শাড়ি পরানো হয়। এক প্রতিমা সাজাতে একই রকম দু’টি শাড়িরও প্রয়োজন হয় বলে জানান তিনি। জমিদার বাড়িতে এবার গড়া হয়েছে ‘নটরাজ’ ‘অজান্তা’ ইত্যাদি ডিজাইনের প্রতিমা। আছে ‘নেপালী’ ডিজাইনও। এসবের বাইরে অনেকে ইন্টারনেটে ছবি নামিয়ে সে অনুযায়ী প্রতিমা গড়ে দিতে বলেন। তাও করা হয়েছে এবার। শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিমা তৈরির কাজটি মোটেই সহজ নয়। এ জন্য প্রথমে কাঠ ও বাঁশের কাঠামো গড়ে নিতে হয়। তার পর ধামরাই সাভার কাশেমপুর শিমুলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মাটি সংগ্রহ করে প্রতিমা তৈরি করতে হয়। রং করা, চুল বসানো, পোশাক অলঙ্কার ইত্যাদি দিয়ে সাজানোসহ আরও অনেক কাজের পর প্রস্তুত হয় প্রতিমা। প্রতি সেটের দাম পড়ে ৭০ হাজার টাকা থেকে ৩ লাখ পর্যন্ত। এর পরও খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রতিমা শিল্পীদের পকেটে তেমন কিছু থাকে না। থাক বা না থাক, জমিদার বাড়ির প্রতিমা শিল্পীরা মন দিয়ে কাজ করেন। বলাই পাল বেশ জোর দিয়ে বললেন, আমরা তো শিল্পী। কাজ করার সময় টাকা পয়সার কথা মাথায় থাকে না। টাকা কম দিক বা বেশি, আমরা শ্রদ্ধা ভালবাসার সাথে কাজটা করি। এটা সাধনার বিষয়। এ পর্যায়ে অবাক করা তথ্য দেন তিনি। বলেন, দুর্গা মায়ের শুধু চোখ আঁকতেই কোন কোন সময় আড়াই তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়। হাসিটা ঠিকমতো ফুটিয়ে তুলতে লেগে যায় আরও কয়েক ঘণ্টা। সবই মন দিয়ে করার চেষ্টা করি। শিল্পীর মনের ক্ষুধা তবু দূর হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, কাজ শেষ করার পরও মন চায় আরেকটু করি। করতে পারলে হয়ত আরও সুন্দর ও নিখুঁত হবে! বলাই পাল বলেন, আমাদের গড়া প্রতিমা দেখে কেউ যখন মুগ্ধতা প্রকাশ করেন তখনই মনে হয় শ্রম সার্থক হয়েছে। পূজার সময় নিজের তৈরি করা প্রতিমা দেখতে ম-পে যাই। দেখি। কষ্টের কথা তখন আর মনে থাকে না। তাছাড়া মায়ের কাজ করি তো, সবাই পারে না। আশীর্বাদ লাগে। জমিদার বাড়ির প্রতিমা শিল্পীদের ওপর দেবী দুর্গার আশীর্বাদ আছে বলেই বিশ্বাস করেন তিনি।
×