ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এশিয়ার সর্ববৃহৎ দুর্গাপূজা

সেই শিকদার বাড়িতে এবার ৮০১ প্রতিমার মণ্ডপ

প্রকাশিত: ০৯:২৪, ২ অক্টোবর ২০১৯

সেই শিকদার বাড়িতে এবার ৮০১ প্রতিমার মণ্ডপ

বাবুল সরদার, বাগেরহাট ॥ দেবী দুর্গা মর্ত্যে আগমন করেছেন। ঢাকে কাঠি পড়েছে। শারদীয় উৎসবের দোলা লেগেছে প্রকৃতিতে। বাঙালী মনেও সেই দোলার ঢেউ আছড়ে পড়ছে। সাজ সাজ রব চারপাশে। আর এই সাজ-সজ্জার আড়ম্বরে এশিয়ার সর্ববৃহৎ দুর্গাপূজার ম-প বরাবরের মতো এবারও রঙ্গীন হয়ে উঠেছে। সুন্দরবন ঘেঁষা গাঢ় সবুজের জেলার হাকিমপুরের শিকদার বাড়ির এই ম-পে প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল প্রায় ছয় মাস আগে। এখন প্রতিমায় মৃৎশিল্পীর শেষ আঁচড় পড়ছে। সু-নিপুন করে তুলতে তারা মহাব্যস্ত। আসলে আয়োজনের কোন কমতি নেই। আয়োজকেরাও অকৃপণ, উদার হস্ত। এবছর ৮শ’ ১ প্রতিমা নিয়ে এ ম-প সাজানো হয়েছে। পুণ্যক্ষণ বরণের সব আয়োজন প্রায় সম্পন্ন। তবুও কোথায় যেন ভালবাসার সবুজ একটি পর্দা সরে গেছে। চেনা পরিসর যেন গভীরতম ভালবাসার অচেনা অবয়ব। এখানে হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালা যে আর নেই। মানুষের ভালবাসায় আজীবন সিক্ত হৃদ্দিমান সেই পুরুষ ডাঃ দুলাল কৃষ্ণ শিকদার ইহলোক ত্যাগ করেছেন। তিনি এ বাড়ির কর্তা ছিলেন। ম-পের প্রতিমা নির্মাণের কাজ যখন প্রায় দুই তৃতীয়াংশ শেষ হয়েছে এমন সময় গত ১৪ জুলাই তিনি চিরদিনের মতো চলে যান। এবার শারদীয় উৎসবে তাকে দেখা যাবে না। এই শুন্যতা পূর্ণ হবার নয়। তার ছেলে লিটন শিকদার এবং বৌমা পূজা শিকদারের ভাষায়, ‘বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী এবার ৮০১ প্রতিমার ম-প সাজানো হয়েছে। সব হচ্ছে কিন্তু তিনি নেই। আসলে নিয়তির কাছে আমরা সবাই অসহায়, বাবুর শুন্যতা তো থাকবেই। তবুও জীবন টা-তো বহতা নদীর মতো।’ সর্ববৃহৎ এ দুর্গা ম-পে ভাস্কর, মৃৎ শিল্পীরা রং তুলির শেষ আঁচড়ে নিপুণ কারুকাজ ফুটিয়ে তুলতে মহাব্যস্ত। এই ব্যস্ততার ফাঁকে কথা হয় ম-পের প্রধান ভাস্কর বিজয় কুমার বাছাড়-এর সঙ্গে। ৬ মাস আগে ১৫ শ্রমিক নিয়ে ৮০১টি প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছরের মতো এবারও আমরা মানুষকে নতুন থিম উপহার দেয়ার চেষ্টা করছি। এ বছর ৮০১টি প্রতিমার নিয়ে ম-প সাজানো হয়েছে। সৃষ্টির রহস্য তুলে ধরার প্রয়াস করা হয়েছে। কার্তিক, গনেশ, নারদ এরা কীভাবে জন্ম নিলেন। নারায়ণ ব্রহ্মা রূপ ও চক্র পেলেন কীভাবে, মানুষ কিভাবে সৃষ্টি হলো ইত্যাদি আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। উপনিষদ, রামায়ন, মহাভারত যার উৎস। আর এসব করা হয়েছে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপড় ও কলি যুগের সনাতন ধর্মীয় কৃষ্টি-কালচার, পৌরানিক কাহিনী ও পার্বনের অবলম্বনে। ধর্মীয় ভিন্ন ভিন্নœ দৃশ্যের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতায় অনন্য আয়োজনে প্রতিমা নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘পুকুরের মধ্যে এবার অষ্ট সখি নিয়ে কৃষ্ণের নৌকা বিলাসের প্রতিকৃতি দেখে দর্শনার্থীরা আনন্দ পাবেন। অন্যবারের থেকে এ বছর দর্শকদের আরও বেশি ভাল লাগবে।’ প্রতিমা শিল্পী বিথেন বাছার, সঞ্জিত বাছার ও ইমন বাছার বলেন, ‘১৮ই বৈশাখ বিজয় দা’র সঙ্গে এখানে এসেছি। সবাই মিলে খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছি। বিশ্রামের তেমন সময় না থাকলেও দেব-দেবীর প্রতিমা তৈরির কাজ করতে পেরে ভালই লাগছে। এত বড় ম-পের কাজ এ বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও করিনি। তাই কোন ক্লান্তি মনে হয় না।’ পূজা ম-পে রয়েছে অতিথিদের আগমনের প্যান্ডেল ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার জন্য মঞ্চ। এ কাজে নিয়োজিত রয়েছেন দক্ষিণাঞ্চলের বিখ্যাত মাগুরার বৈশাখী ডেকরেশন। সাজ-সজ্জা বিভাগের প্রধান আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ‘প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস ধরে ১৫ জন শ্রমিক ম-পের বাহ্যিক সাজ-সজ্জার কাজ করছে। গতবছরের তুলনায় এবার দর্শনার্থীরা প্রতিমার পাশাপাশি সাজ-সজ্জা দেখেও মুগ্ধ হবেন।’ অপরূপ আলোক সজ্জায় গোট ম-প প্রাঙ্গণ সাজানো হচ্ছে। প্রতিদিন বরেণ্য শিল্পীদের নানা পরিবেশনায় থাকছে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। সরকারী এবং নিজস্ব ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি নিরাপত্তায় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অমিত রায় এবং জেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি শিবপদ ঘোষ বলেন, সার্বিক আয়োজনে এ ম-প মনোমুগ্ধকর। শান্তিপূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত পরিবেশে জেলায় এবার শারদীয় দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হবে বলে তারা দৃঢ় আশাবাদী। বাগেরহাট সদর উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের হাকিমপুর গ্রামের শিকদার বাড়িতে ২০১১ সাল থেকে এই বড় আয়োজনের যাত্রা শুরু হয়। সে বছর ২৫১টি প্রতিমা তৈরি করা হয়। এরপর আর কমেনি বরং বেড়েই চলেছে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে প্রতিমার সংখ্যা হয় ৬৫১টি। ২০১৮ সালে তা পৌঁছায় ৭০১টিতে। এবার সেই সংখ্যা দাঁড়াল ৮০১টিতে। প্রয়াত দুলাল শিকদারের সহধর্মীনী রমা শিকদার মনে করেন, বহুমূর্তি নিয়ে আঙ্গিক ও বৈচিত্রে অসাধারণ এ মন্দির দর্শন করে মানুষ উজ্জ্বীবিত হবে। যা মানুষে মানুষে সম্প্রীতির বন্ধন আরও সুদৃঢ় করতে সহায়তা করবে। জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ ও পুলিশ সুপার পঙ্কজ চন্দ্র রায় বলেন, এ বছর জেলায় ৬৪১টি দুর্গা ম-প তৈরি হয়েছে। আনন্দঘন পরিবেশ নিশ্চিত করতে সব রকম ব্যবস্থাপনা ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
×