ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কন্টেনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রম জিম্মি মুক্ত করার দাবি

প্রকাশিত: ০৯:১৯, ২ অক্টোবর ২০১৯

কন্টেনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রম জিম্মি মুক্ত করার দাবি

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ দেশের সামুদ্রিক বাণিজ্যের একক বৃহত্তম কেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দর। এ বন্দর আবার দেশের প্রধান ও বৃহত্তমও বটে। সমুদ্র পথে দেশে পণ্য আমদানি ও রফতানির প্রায় ৯০ শতাংশ এ বন্দর দিয়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে। এ বন্দরের বাৎসরিক বর্তমান গড় আয় ২ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। গড় ব্যয় ১ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা। সরকারকে বছরে আয়কর পরিশোধ করছে ৪৩৪ কোটি টাকা। গেল বছর নিট মুনাফা করেছে ৮৬৮ কোটি টাকা। এ বন্দরের প্রবৃদ্ধির হার ৩৭ শতাংশ। জাতীয় অর্থনীতির প্রাণ প্রবাহিনী শিরা হিসাবে খ্যাত এ বন্দর স্বাভাবিক, অর্থাৎ নিজ গতিতে চলতে পারলে গড় আয় এবং মুনাফা দুটোই এবং প্রবৃদ্ধি আরও বৃদ্ধি পেত। এর পাশাপাশি গড় আয় ও মুনাফাও বেড়ে যেত। এছাড়া জাহাজ জট নামে যে কথাটি প্রায়শ উঠে আসে তারও অবসান হতো। কন্টেনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রম পরিকল্পিতভাবে একক হাতে জিম্মি হয়ে থাকার বিষয়টি এ বন্দরের অন্যতম বড় একটি অন্তরায় হয়ে আছে। এ বন্দরকে বিভিন্নভাবে জিম্মি করে রেখেছে প্রভাবশালীদের একটি অংশ। এদের গডফাদাররা সময়ের পরিক্রমায় সর্বদা সরকারদলীয় নেতাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে। ফলে এ বন্দরের পণ্য হ্যান্ডলিং কার্যক্রম থেকে শুরু করে টেন্ডারসহ সর্বক্ষেত্রে এসব প্রভাবশালীদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিরাজমান। বর্তমান সরকারের আমলে এ বন্দর বিশে^র উন্নত বন্দরগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিপূর্ণভাবে কন্টেনারাইজেশনের পথে। অতীতের ডক শ্রমিক দিয়ে পণ্যের হ্যান্ডলিং কার্যক্রম বাদ দিয়ে ২০০৭ সাল থেকে এ বন্দরে চালু হয়েছে বাথ অপারেটিং সিস্টেম। এ সিস্টেম চালু হওয়ার পর তাতে সুফল আসায় তা আর বাদ দেয়া হয়নি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ বন্দরের বার্থ অপারেটিং সিস্টেম প্রভাবশালীদের জিম্মিত্ব বরণ করে আছে। বর্তমানে এ বন্দরের জিসিবিতে (জেনারেল কন্টেনার বার্থ) ৬ অপারেটিং প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। পক্ষান্তরে সিসিটি (চিটাগং কন্টেনার টার্মিনাল) ও এনসিটির (নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল) ৭ বার্থে একচ্ছত্রভাবে একটি প্রতিষ্ঠানই কাজ করছে। এবং বারবার এ প্রতিষ্ঠানই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে কাজ হাতিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। বন্দর ব্যবহারকারীদের সূত্রে জানানো হয়েছে, জিসিবিতে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে ৬ প্রতিষ্ঠানের মাঝে সমানতালে প্রতিযোগিতা বিরাজমান। বন্দরের শর্তে রয়েছে যে প্রতিষ্ঠান পণ্য হ্যান্ডলিং আগেভাগে সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে সে প্রতিষ্ঠানই নতুন আরেকটি জাহাজের পণ্য খালাসের সুযোগ পাওয়ার সুবিধা থাকবে। এর ফলে জিসিবির বার্থগুলোতে অপারেটরদের ত্বরিত পণ্য খালাসের বিষয়টি দৃশ্যমান। পক্ষান্তরে সিসিটি ও এনসিটির সাতটি বার্থ একটি মাত্র অপারেটরের হাতে বরাবরই থাকছে বিধায় এরা ত্বরিত কর্মসম্পাদনের বিষয়টিকে থোড়াই কেয়ার করে না। ফলে প্রায়শ জাহাজজট লাগার বিষয়টি সৃষ্টি হয়। বহির্নোঙ্গরে পণ্য খালাসকারী জাহাজগুলোর লাইন পড়ে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জিসিবির বার্থগুলোতে জাহাজের অবস্থানকাল সর্বনি¤œ ৪৮ ঘণ্টা এবং সর্বোচ্চ ৬০ ঘণ্টা। অথচ, সিসিটি ও এনসিটিতে জাহাজের অবস্থান থাকে সর্বনি¤œ ৭২ ঘণ্টা এবং সর্বোচ্চ ৯৬ ঘণ্টা। সিসিটি ও এনসিটিতে কোন ধরনের প্রতিযোগিতা না থাকায় একটি প্রতিষ্ঠানের একক আধিপত্য এ বন্দরে পণ্য খালাসে বিলম্ব এবং জাহাজজট সৃষ্টির বিপরীতে দেশেরই সুনাম বিদেশে খর্ব হচ্ছে। এছাড়া বন্দরের বিপুল অঙ্কের রাজস্বও হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। পণ্য খালাসে বাড়তি সময় গ্রহণ এবং জাহাজের জেটি ত্যাগে কালক্ষেপণের নেপথ্যে ওপারেটিংয়ে একক আধিপত্যের বিষয়টি অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। চলতি বছরে চবক (চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ)এনসিটির জন্য যে টেন্ডার আহ্বান করে সেখানে অন্যরা যাতে কাজ না পায় তার জন্য অযৌক্তিক কিছু শর্ত জুড়ে দেয় বলে বন্দর ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে অজ¯্র অভিযোগ রয়েছে। ফলে বারবার একটি প্রতিষ্ঠানই টেন্ডারের শর্ত পূরণ করে কাজ পেয়ে যায়। এ কারণে আগ্রহীদের পক্ষে আাদলতের দ্বারস্থ হওয়ার পর উচ্চ আদালত ওই দরপত্র স্থগিত করেছে। এতেও একক আধিপত্য সৃষ্টিকারীদের লাভ, অর্থাৎ পুরনো হিসাবে ওই এক প্রতিষ্ঠানই এনসিটি ও সিসিটিতে পুরো কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করে যাচ্ছে। এ বিষয়টি নিয়ে সরকারী ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি বন্দরের এমন কন্টেনার হ্যান্ডলিং কাজ প্রাপ্তির ঘটনায় অর্থমন্ত্রী আ ন হ মোস্তফা কামাল উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের এমনও বলেছেন, ঝুঁকি বিবেচনায় কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ে বিকল্প ভেবে দেখা উচিত। এছাড়া এ কাজ সরকারী পর্যায়ে করা যায় কিনা তাও বিবেচনা করা প্রয়োজন। কারণ একটি মাত্র সোর্স থেকে সেবা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ঝুঁকির বিষয়টি থেকে যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরে যারা ব্যবসা করে তাদের মধ্যে শিপিং এজেন্ট, বন্দর ব্যবহারকারী, বিজিএমইএ ও চট্টগ্রাম চেম্বারের পক্ষ থেকে সিসিটি ও এনসিটির এ দুই টার্মিনালে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে একাধিক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য ইতোমধ্যে সুপারিশ করেছে। এসব সংস্থার বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বন্দরের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি এবং বারবার একটি অপারেটিং প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি হয়ে থাকার বিষয়টি দূর করার জন্য একাধিক অপারেটর নিয়োগ আবশ্যক। এতে জাতীয় অর্থনীতি উপকৃত হবে, বন্দরের কাজে গতিশীলতা আরও বাড়বে, জবাবদিহিতা ও প্রতিযোগিতা বিরাজমান থাকবে। এর পাশাপাশি সরকারের আর্থিক সাশ্রয় যেমন হবে, তেমনি তৈরি পোশাক শিল্প ও জাহাজ মালিকরা উপকৃত হবে, বাড়বে এ বন্দরের সুনাম, অবসান ঘটবে জাহাজ জটের বিষয়টি। বন্দর ব্যবহারকারীদের পক্ষ থেকে বারবার প্রশ্ন উঠানো হচ্ছে এই বলে যে, জিসিবির ৬ বার্থে ৬ অপারেটর যেখানে কাজ করছে সেখানে সিসিটি ও এনসিটির ৭ টার্মিনালে একচ্ছত্রভাবে কোন এক প্রতিষ্ঠানকে অব্যাহতভাবে অপারেটিং কাজ করতে দেয়ার অবকাশ থাকে না। এ ব্যাপারে বার্থ অপারেটর এ্যাসোসিয়েসন সূত্র নিশ্চিত করেছে, দরপত্র আহ্বানের সময় অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে কিছু শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। এসব শর্ত পিপিআর অনুযায়ী হলে বহু প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে পারে। কিন্তু বর্তমানে এমন কিছু অনাকাক্সিক্ষত ও ইচ্ছাকৃত শর্ত দেয়া হয় যেখানে ৪০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানও টেন্ডারে অংশ নিতে পারছে না। আগে থেকেই ঠিকঠাক করে রাখা একটি প্রতিষ্ঠানই বরাবর কাজ পেয়ে যাচ্ছে এবং হ্যান্ডলিং কার্যক্রমে স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়টি কেবলই বাড়ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, দেশে আমদানি ও রফতানির ভলিউম প্রতিবছর বাড়তে থাকার প্রেক্ষাপটে এ বন্দরের সক্ষমতাও বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার। ইতোমধ্যে আরও ৪টি নতুন টার্মিনাল প্রতিষ্ঠার কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রস্তাবিত হিসাবে রয়েছে বে-টার্মিনাল, পতেঙ্গা টার্মিনাল, কর্ণফুলী টার্মিনাল ও লালদিয়ার চর টার্মিনাল।
×