ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

যাত্রাবাড়ীর নাঈমের মৃৃৃত্যু কিশোর গ্যাংয়ের কৌশলী হত্যাকাণ্ড

প্রকাশিত: ১১:১৫, ১ অক্টোবর ২০১৯

যাত্রাবাড়ীর নাঈমের মৃৃৃত্যু কিশোর গ্যাংয়ের কৌশলী হত্যাকাণ্ড

গাফফার খান চৌধুরী ॥ দীর্ঘ দুই বছর পর ঢাকার যাত্রাবাড়ীর কোনাপাড়া মান্নান উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র কিশোর নাঈমুল ইসলাম নাঈমের মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, পানিতে ডুবে নয়, পরিকল্পিতভাবে পিটিয়ে আধমরা করার পর সাঁতার না জানা নাঈমকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর খুনীরা বাড়িতে গিয়ে নাঈমের মাকে, নাঈম পানিতে নেমে আর উঠছে না বলে খবর দেয়। এমনকি তারা নাঈমের মায়ের সঙ্গে ঘটনাস্থলে যায়। যাতে কেউ তাদের সন্দেহ করতে না পারে। পানিতে ডুবে নাঈমের মৃত্যু হয়েছে, সবাই যাতে এমন ধারণা করে এজন্যই কৌশলী হত্যাকা-টি ঘটায় খুনীরা। হত্যাকা-ের সঙ্গে কোনাবাড়ি এলাকার একটি কিশোর গ্যাংয়ের তিন সদস্য জড়িত। তিন খুনীই নাঈমের সহপাঠী। খুনীরা কিশোর গ্যাং গড়ে তুলে নানা অপরাধ সংঘটিত করছিল। কিশোর গ্যাংয়ের নানা অপরাধ জেনে ফেলায় এবং গ্যাংয়ের সদস্য না হওয়ায় নাঈমকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে তারা। যাতে কিশোর গ্যাংয়ের কোন তথ্য বের না হয়। খুনীরা ওয়েস্টার্ন সিনেমায় ও জনপ্রিয় টেলিভিশন সিরিজ সিআইডিতে দেখা নানা কৌশলী হত্যাকা-ের ধারণা নিয়ে নাঈমকে হত্যা করে। মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সূত্রে জানা গেছে, ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট। ওইদিন বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে যাত্রাবাড়ী থানাধীন মাতুয়াইলের গোন্ডেন ব্রিজের নিচ দিয়ে যাওয়া খালের পানির নিচ থেকে নাঈমের (১৪) লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের ডুবুরিরা। নাঈমের পিতার নাম মোঃ শহীদুল ইসলাম (৪০)। মায়ের নাম নার্গিস বেগম (৩২)। বাড়ি মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানায়। পরিবারটি মাতুয়াইল কাঠেরপুল এলাকার আবদুল খালেক মিয়ার বাড়িতে থাকতেন। নাঈম পিতামাতার একমাত্র সন্তান ছিল। এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন নাঈমের মা। অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেন তিনি। নাঈমের মা ছেলের মৃত্যুর পেছনে ছেলের তিন বন্ধুর যোগসূত্র থাকার বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করলেও মামলায় তাদের নাম উল্লেখ করেননি। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, যাত্রাবাড়ী থানার এসআই মোঃ মোখলেসুর রহমান মামলাটির তদন্ত করেন। তদন্তের ধারাবাহিকতায় তিনি অভিযুক্ত তিন কিশোর নাঈমের সঙ্গে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়া যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলের কাঠেরপুল এলাকার বাসিন্দা মোঃ নাসিম হোসেন মুন্সী (১৫), মোঃ ফারদিত ইয়াসিন ওরফে তাজিন (১৪) ও মোঃ আবদুল মোতালেব ওরফে আবদুল্লাহকে (১৪) গ্রেফতার করে। তাদের কিশোর আদালতের ম্যাধমে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা হত্যাকা- সম্পর্কে ধারণা দেয়। আসামিদের টঙ্গীতে কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। বর্তমানে তিন আসামিই জামিনে মুক্ত। সূত্রটি বলছে, গ্রেফতারকৃতরা এলাকায় যথেষ্ট প্রভাবশালী। এ নিয়ে এলাকায় সালিশ দরবার হয়। তিন লাখ টাকায় মামলা নিষ্পত্তির প্রস্তাব দেয়া হয়। তাতে রাজি হননি বাদিনী। এ নিয়ে এলাকায় ব্যাপক শোরগোল চলতে থাকে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা হত্যাকা-ের প্রত্যক্ষদর্শী নিহত নাঈমের মামাত বোন শারমিন আক্তার ও তার পরিবারকে হুমকি দিতে থাকে। শেষ পর্যন্ত কিশোর গ্যাংয়ের অত্যাচারে শারমিনকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই নারায়ণগঞ্জে বিয়ে দিতে বাধ্য হয় তার পরিবার। এমন পরিস্থিতি চলার মধ্যেই মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা বদলি হয়ে যান। দ্বিতীয় দফায় মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) প্রদীপ কুমার কু-ু। তিনি পোস্টমর্টেম রিপোর্ট মোতাবেক পানিতে ডুবে নাঈমের মৃত্যু হয়েছে বলে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। আদালতে নাঈমের মা মামলার তদন্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি পুনরায় মামলাটির তদন্ত দাবি করেন। আদালত নারাজি আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মামলাটির তদন্তভার পিবিআইকে দেয়। মামলাটির সর্বশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রোর দক্ষিণ বিভাগের পরিদর্শক মোঃ আরিফুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, আপাত দৃষ্টিতে ঘটনাটি অপমৃত্যুর মনে হলেও তদন্তে বেরিয়ে আসতে থাকে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। জানা যায়, নিহত নাঈমের সঙ্গে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়াশোনা করত খুনী নাসিম, তাজিম ও আবদুল্লাহ। এরমধ্যে নাঈম তুলনামূলকভাবে অসচ্ছল। আর নাসিম, তাজিম ও আবদুল্লাহ তুলনামূলকভাবে অনেক সচ্ছল। এ তিনজন এলাকায় কিশোর গ্যাং গড়ে তুলে। তারা নাঈমকে দলে নাম লেখানোর জন্য চাপ দিতে থাকে। এতে নাঈম আপত্তি করে। অনেক বোঝানোর পরেও নাঈম তাদের সঙ্গে গ্যাংয়ে যোগ দেয়নি। সে একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে চলাফেরা করা অনেকটাই ছেড়ে দেয়। ততদিনে নাঈম তার বন্ধুদের গড়ে তোলা কিশোর গ্যাংয়ের অনেক অপরাধ কর্মকা- জেনে ফেলে। সেসব অপকর্ম প্রকাশ হওয়ার ভয়ে তিন খুনী নাঈমকে দলে ভেড়ানোর জন্য নানাভাবে সারাক্ষণ চাপ দিতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তারা নাঈমকে দলে ভেড়াতে ব্যর্থ হয়। মূলত এখান থেকেই হত্যাকা-ের সূত্রপাত। তিনি আরও জানান, হত্যাকারীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট নাঈমকে কোনাবাড়ির বালুর মাঠে খেলার নাম করে ডেকে নিয়ে যায়। যাওয়ার পর আটকে রাখে। অনেকক্ষণ বাসায় না ফেরায় নানি সাবিয়া বেগম বালুর মাঠে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন নাঈমকে তার তিন বন্ধু আটকে রেখেছে। নাসিমের মোবাইল ফোন ভেঙ্গে ফেলায় তাকে আটকে রাখা হয়েছে বলে জানায়। ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২ হাজার টাকা দাবি করে তারা। পরে তিনি দুই হাজার টাকা দিয়ে নাতিকে নিয়ে যান। পরদিন স্কুলে গেলে আবার ওই তিনজন নাঈমকে মারধর করে। মোবাইল কেনার জন্য দেয়া দুই হাজার টাকায় হবে না। আরও এক হাজার টাকা দিতে বলে। টাকা না দিলে এমন হাল করা হবে, যা চিরদিনের জন্য মনে থাকবে বলে হুমকি দেয়। এমন ঘটনার পর নাঈমের মা থানায় একটি জিডি করেন। এমন ঘটনার পর তিনজন বাড়িতে গিয়ে নাঈম, তার পিতামাতাসহ বাড়ির সবাইকে হত্যার হুমকি দেয়। এমন ঘটনায় পাড়ায় শোরগোল পড়ে যায়। এ সময় জনতা ওই তিন জনকে আটক করে। পরে তাদের অভিভাবকরা মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নেন। এ নিয়ে স্কুলে বিচার সালিশ হয়। পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোঃ শাহাদাত হোসেন তদন্তে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে জনকণ্ঠকে জানান, সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২২ আগস্ট ছিল নাঈমের পরীক্ষার শেষ দিন। পরীক্ষা শেষে নাঈমের সঙ্গে তিন খুনী বাড়ির দিকে রওনা হয়। গোন্ডেন ব্রিজের ওপর তিন খুনী নাঈমকে বেধড়ক মারধর করে। এ সময় তার ব্যাগ কেড়ে নিয়ে পাশের দোকানদার আবুল কাশেমের কাছে রাখে। মারতে মারতে আধমরা করার পর নাঈমকে ব্রিজ থেকে ধাক্কা দিয়ে খালের পানিতে ফেলে দেয়। নাঈমের সাঁতার না জানার বিষয়টি আগ থেকেই জানতে খুনীরা। এজন্য তারা নাঈমকে হত্যার উদ্দেশ্যে পানিতে ফেলে দেয়। পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার জনকণ্ঠকে জানান, নাঈমের সাঁতার না জানার বিষয়টি তার সহপাঠী কিশোর গ্যাংয়ের তিন সদস্য জানত। এটিকেই তারা পুঁজি করেছে। তিন কিশোর খুনী ওয়েস্টার্র্ন সিনেমায় এবং বর্তমানে বিভিন্ন টেলিভিশনে চলা সিআইডি সিরিজ দেখত। সেইসব সিরিজে নানা ধরনের কৌশলী হত্যাকা-ের বিষয়গুলো দেখানো হতো। কৌশলী নানা হত্যাকা-ের কলাকৌশল দেখে খুনীরাও কৌশলী হত্যাকা-ে পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মোতাবেক তারা প্রথমে নাঈমকে বেধড়ক মারধর করে। যেহেতু নাঈম সাঁতার জানে না, তাই প্রচ- মারধর করার পর পানিতে ফেললে আর ওঠতে পারবে না। নাঈমকে খুনীরা এতটাই মারধর করেছিল যে, সাঁতার জানার পরও কোন মানুষের পক্ষে পানি থেকে ওঠা সম্ভব ছিল না। আর নাঈম যেহেতু সাঁতার জানত না, এজন্য নাঈমের পক্ষে তো কোনক্রমেই ওঠা সম্ভব ছিল না। ফলে খালের পানিতেই নাঈমের মৃত্যু হয়। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তারা নাঈমের বাড়িতে খবর দিতে যায়। নাঈমের মাকে জানায়, নাঈম খালের পানিতে নেমে আর উঠছে না। নিজেদের সন্দেহের উর্ধে রাখতে তারা নাঈমের মায়ের পেছন পেছন ব্রিজের কাছেও যায়। ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা লোকজনদেরও একই কথা বলে। তারা বলে বেড়ায়, নাঈম সাঁতার জানত না, তাই পানিতে পড়ে মারা গেছে। আর পোস্টমর্টেম রিপোর্টে স্বাভাবিক কারণেই পানিতে ডুবেই নাঈমের মৃত্যু হয়েছে বলে তথ্য ওঠে আসে। মূলত এটি ছিল কিশোর গ্যাংটির কৌশলী হত্যাকাণ্ড।
×