ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ নিশ্চিতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি

প্রকাশিত: ১১:১৪, ১ অক্টোবর ২০১৯

শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ নিশ্চিতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি

রশিদ মামুন ॥ চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি, এরপরও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। গ্রাম ও শহরের গৃহস্থালিতে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহে বিতরণ জটিলতা রয়েছে। কিন্তু শিল্পের জন্য যে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ প্রয়োজন তারও ব্যবস্থা করতে পারেনি কোন বিতরণ কোম্পানি। এতে উদ্যোক্তারা গ্রিডের বিদ্যুতে ভরসা পাচ্ছে না। তবে সরকার শিল্পে বিদ্যুত সরবরাহ উন্নত করতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে। দেশের গ্রিড সংযুক্ত কেন্দ্রের মোট বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ১৯ হাজার ৫৭ মেগাওয়াট। এখন পিক আওয়ারে (সান্ধ্যকালীন) বিদ্যুতের যে চাহিদা রয়েছে তা ১২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের মধ্যে থাকে। দিনে চাহিদা আরও কমে ১০ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট হয়। অর্থাৎ গ্রিড সংযুক্ত সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াটের বেশি কেন্দ্র চাহিদা না থাকার কারণে চালানো যায় না। এই অবস্থা যখন গ্রিডের তখনও শিল্পে বিদ্যুত চাহিদা আশানুরূপ বৃদ্ধি না পাওয়াটা হতাশার বিষয়। এখন বিদ্যুতের যে নতুন চাহিদা তৈরি হচ্ছে তার বেশিরভাগই গৃহস্থালির। শুধুমাত্র গৃহস্থালির জন্য বিদ্যুত উৎপাদনকে লাভজনক বিবেচনা করা যায় না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কেন গ্রিডের বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পায় না এমন প্রশ্নে বিদ্যুত বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল আর কোন ক্যাপ্টিভ বা নিজস্ব উদ্যোগে স্থাপিত বিদ্যুত কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হবে না। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তে সরকার অনড় থাকেনি। নতুন করে এলএনজি আমদানির শুরুতেই ৮০০ কারখানায় ক্যাপ্টিভ বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়। এখানে মালিক বা উদ্যোক্তাদের যেহেতু গ্রিডের বিদ্যুতে আস্থা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি তাই ক্যাপ্টিভের বিদ্যুতেই চলছে শিল্প। তিনি বলেন, এখন দেশে আরও তিন হাজার মেগায়াটের বেশি ক্যাপ্টিভ বিদ্যুত উৎপাদন হচ্ছে। এর সঙ্গে আরও ৮০০ কারখানার ক্যাপ্টিভ যুক্ত হচ্ছে। সব মিলেয়ে সহসাই শিল্পে চাহিদা বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে বলেও মনে করেন না এই কর্মকর্তা। বিদ্যুত বিভাগ বলছে, গ্রামে বিতরণ ব্যবস্থার ত্রুটি থাকায় সরবরাহ বিঘিœত হচ্ছে। কিন্তু শহরের আবাসিকে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের ঘোষণা দিতে পারছে না বিদ্যুত বিভাগ। এক্ষেত্রেও বিতরণ ত্রুটি রয়ে গেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গ্রাম ও শহরে বিদ্যুতের সহনীয় পরিবেশ থাকলেই মানুষ খুশি। সেক্ষেত্রে লোডশেডিংকে সহনীয় পর্যায়ে রাখলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে শিল্পের ক্ষেত্রে যা একেবারেই অসম্ভব। অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে লোডশেডিং করলে কাঁচামাল নষ্ট হয়। সঙ্গত কারণে গ্রিডের বিদ্যুত থেকে তারা বরাবর দূরে থাকে। কারণ, গ্রিডের বিদ্যুত একেবারে যাবে না এই নিশ্চয়তা এখনও উদ্যোক্তাদের দিতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে লোডশেডিংয়ে কাঁচামাল বিনষ্ট হবে না এমন শিল্প মালিকদের অভিযোগ নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ না পেলে তাদের উৎপাদন বিঘিœত হয়। কর্মীর শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়। সর্বোপরি ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী সময়মতো পণ্য সরবরাহে ঝুঁকি থাকে। সঙ্গত কারণে শিল্প মালিকরা ক্যাপটিভ পাওয়ার বা নিজস্ব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুত উৎপাদনে বেশি আগ্রহী। সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিয়ে বৈঠকে বসে সরকার। এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রিডের বিদ্যুতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহী করে তোলা। তবে ওই বৈঠকেই ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামের শিল্পাঞ্চলে এখনও প্রতিদিনই লোডশেডিং করা হয়। এক বছরের একটি পরিসংখ্যান দিয়ে সাভার, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে লোডশেডিং করা হচ্ছে বলে ব্যবসায়ীদের তরফ থেকে জানানো হয়। বলা হয় এসব এলাকায় মাসে সর্বোচ্চ ৪৬ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করা হচ্ছে, যা শিল্পের জন্য কোন অবস্থাতেই কাম্য নয়। আগস্ট-২০১৮ থেকে আগস্ট-২০১৯ পর্যন্ত বিদ্যুতের সরবরাহ বিশ্লেষণ করে বলা হচ্ছেÑ একেকদিন লোডশেডিংয়ের চিত্র একেক রকম। কোনদিন সাভারে লোডশেডিং বেশি হচ্ছে তো কোন কোন দিন নারায়ণগঞ্জে লোডশেডিং বেশি হচ্ছে। এই চিত্রের পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করছেন শিল্প মালিকরা। উদ্যোক্তারা বলছেন একবার এক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুত গেলে মূলত দুই ঘণ্টা শ্রমের অপচয় হয়। একজন শ্রমিক একবার কাজ ছেড়ে উঠে গেলে তার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে কাজে বসতে আবার সময় অপচয়ের কথা বলছেন তারা। জানতে চাইলে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল সামাদ বলেন, আমরা গ্রিড থেকে বিদ্যুত নিতে চাই। কিন্তু গ্রিডের বিদ্যুত সকালে ৫ ঘণ্টা থেকে ১ ঘণ্টা চলে গেল। আবার লাইন সংস্কারের কথা বলে দিনেরবেলায় বন্ধ করে রাখা হলো, এমন বিদ্যুত চাই না। আমরা সরকারকে বলেছি নিরবচ্ছিন্ন এবং মানসম্মত বিদ্যুত দিতে হবে। সরকার যদি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ করতে পারে। আমাদের সেই বিদ্যুতে শিল্প চালাতে তো কোন সমস্যা নেই। এখন সরকারও বিষয়টি চিন্তা করছে। আশা করা যায় একটি সুরাহা হবে। যদিও বিদ্যুত বিভাগ বলছে, শিল্পখাতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ জ¦ালানি ও বিদ্যুত গবেষণা কাউন্সিলের (ইপিআরসি) চেয়ারম্যান সুবীর কিশোর চৌধুরীকে প্রধান করে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিদ্যুত ও জ¦ালানি উভয় বিভাগের সচিবকে কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। এছাড়া বিদ্যুত বিতরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি উদ্যোক্তারা রয়েছেন এই কমিটিতে। ইপিআরসির সদস্য মোঃ শমসের আলী জানান, গত সপ্তাহেই কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যদের কাছে অন্তভর্ূুক্তির বিষয়টি জানানোও হয়েছে। এখন বিদ্যুত সচিব ও ইপিআরসি চেয়ারম্যান উভয়ই দেশের বাইরে রয়েছেন। সঙ্গত কারণে এ বিষয়ে কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। আগামী দুই মাসের মধ্যে এই কমিটির প্রতিবেদন দেয়ার কথা। কমিটি দেশের শিল্পে কিভাবে নিরবচ্ছিন্ন এবং মানসম্মত বিদ্যুত সরবরাহ করা সম্ভব সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেবে। সরকার ওই প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে, যাতে শিল্প মালিকরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত পায়। তবে এই সুপারিশ বাস্তবায়নে সময় লাগবে এক বছর। বিদ্যুত বিভাগের পাওয়ার সেল নিরবচ্ছিন্ন শিল্পের বিদ্যুত নিয়ে অনেকদিন কাজ করছে। তারা বলছেন, শিল্পে এখন যেমন একটি লাইনে সরবরাহ করা হয় তখন দুটি লাইনে বিদ্যুত সরবরাহ করতে হবে।
×