ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ঐতিহাসিক লালকুঠি থিয়েটার হল

ঢাকার নাট্যচর্চার প্রাণকেন্দ্র্র এখন শুধুই স্মৃৃতি

প্রকাশিত: ১১:১৩, ১ অক্টোবর ২০১৯

ঢাকার নাট্যচর্চার প্রাণকেন্দ্র্র এখন শুধুই স্মৃৃতি

সমুদ্র হক ॥ ঢাকার নাটকের প্রাণকেন্দ্র লালকুঠি। আদিবাসী ঢাকাইয়া কুট্টিরা দীর্ঘদিন লালন করেছে পুরান ঢাকার নাটক চর্চা কেন্দ্র এই লালকুঠি। মহিলা সমিতি, গাইড হাউস, মহানগর নাট্যমঞ্চ, এমনকি হালের শিল্পকলা একাডেমির আগে ঢাকার নাটকপাড়া বলতে লালকুঠিকেই বোঝাত। চার শ’ বছর আগে রাজমহল থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত হলে বেড়ে যায় ঢাকার গুরুত্ব। শোনা যায় সুবে বাংলার প্রথম শাসক সুবেদার ইসলাম খান ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ঢাকায় ঢাক বাজানোর নির্দেশ দেন। জনশ্রুতি আছে, ঢাকির বাদ্যের তালে ঘুরে বাংলার (তদানিন্তন বাংলা বিহার উড়িষ্যার কিছু অংশ) রাজধানীর নামকরণ হলো ঢাকা। মুঘল সম্রাটকে ঔদার্য্যরে স্বীকৃতিস্বরূপ বহুভাষার মিশ্রণের এক অভিনব সংস্কৃতির ধারায় যুক্ত হয় ঢাকাইয়া কুট্টিভাষা। ভাষার বৈচিত্র্যে আদি ঢাকাইয়ারা পরিচিতি পায় কুট্টি নামে। অবশ্য এ নামে ঢাকার আদিবাসিন্দারা পরিচয় দিতেও গর্ববোধ করে থাকে। ঢাকার প্রাণ স্রোতস্বিনী বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ঢাকাইয়া সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর লালকুঠি। ফরাশগঞ্জের ছাপাখানায় ট্রেডল মেশিনের ঘড়ঘড়ানি, বাংলা বাজারের পুস্তক বেচাবিক্রির হল্লোড় আর সাহিত্য সংস্কৃতিকর্মীদের আড্ডাস্থল বিখ্যাত বিউটি বোর্ডিং ঘিরে আবর্তিত হয় লালকুঠি নাটকপাড়ার প্রাণচাঞ্চল্য। ইদানীং পুরান ঢাকার স্মৃতি কথা বলার লোকজন খুঁজে পাওয়া যায় না। বর্তমানের প্রবীণরা যা বলেন তা পূর্বসূরিদের কাছে থেকে শোনা। চকবাজারের একজন বললেন, বাবজানে ‘কইছ্যে রেসকোর্সে ঘোড় দৌড় হইতো। হালায় সূর্য ভি ওঠবার দেয়নাই ক্য। সাহেব সুবারা যাইয়া তাগড়া জুয়ান ঘোড়া দেইখ্যা থাবা দিয়া কইতো এইডা ঠিক কর! ঘোড়ার পিঠে জরির কাপড় বইয়া রাজা বানাইয়া দিত। হেই ঘোড়া দৌড়াইয়া এক নম্বর হইলে বাজি জিইত্যা যাইতো।’ সেদিনের রেসকোর্স ময়দান আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছিল ঢাকা গেটের বাইরে। অর্থাৎ বলা চলে ঢাকা থেকে অনেক দূরে...। বংশাল রোডের নিজামউদ্দিন বললেন ‘আমাগর এইহ্যানে কী যে কাওয়ালী হইত বুঝাইবার পারুম ন্যা। সামিয়ানা টাইঙ্গা স্টেজ ভি বানাইয়া হারমোনিয়াম তবলা লইয়া বইত কাওয়ালরা। কম্পিটিশন করতো। এক কাওয়াল আরেক কাওয়ালরে কাইত কইরা ফ্যালাইত। বহুত নামকরা কাওয়াল আছিল। আমাগর এইহ্যানে বহুত কিছু আছিল। মনের মইধ্যে বহুত সুখ শান্তি ভি আছিল। মগর অহন সুখও নাই শান্তিও নাই ক্যা।’ কেন নেই এমনটি জানতে চাইলে বলেন ‘আবে হালায় থাকবো ক্যামতে। দ্যাখবার পারতাছেন না। যে দিন যায়গা উ দিন আর আহে নাইক্যা।’ পুরান ঢাকা ছিল সাহিত্য সংস্কৃতি বিনোদন ঐশ^র্যে পরিপূর্ণ এক সমৃদ্ধ জনপদ। লাঠিখেলা, পালা গান, জারি গান, খোল, কনক, সাঁনাই, বাঁশি বাজিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। প্রায় সন্ধ্যায় বিভিন্ন উঠানের অনুষ্ঠানে বাড়ির বৌ-ঝিরা ঘোমটার আড়ালে গান শুনতো। যাত্রা ও নাটকের ক্ষেত্রে পুরান ঢাকার নামডাক ছিল। বিলুপ্ত শাবিস্তান সিনেমার পাশে আর্মেনিয়ান গির্জার সামনে ছিল একটি নাট্যমঞ্চ। সেদিনের যুবক ও তরুণ আন্তরিকতার সঙ্গে নাট্য চর্চা করত। আর্মানিটোলার আব্দুস সামাদ বললেন, ‘হুনছি বাজান এইহ্যানে নাটক করত’। জানালেন পুরান ঢাকার নাটকের খ্যাতি ছিল। ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত লালকুঠি থিয়েটার মঞ্চ ছিল বিখ্যাত নাট্য কেন্দ্র। ঢাকার শৌখিন ব্যক্তিরা নিজেরা নাটক করতেন, তরুণদের নাটক করতে উৎসাহ দিতেন। দেশী মেলোড্রামার পাশাপশি বিদেশী নাটক মঞ্চস্থ হতো। এই লালকুঠি মঞ্চেই ঢাকার অনেক বিখ্যাত শিল্পীর হাতেখড়ি। মন মানসিকতায় নাট্যচর্চার মানোন্নয়নের পাশাপাশি সেদিনের উদ্যোমী তরুণরা যাত্রার সঙ্গে নাটকের সীমারেখার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়। নাটক ও যাত্রা দুই মাধ্যমকেই শক্তিশালী করে তারা। সে সময় নাটকে নারী শিল্পী ছিল হাতেগোনা। কখনও পুরুষদের মেয়ে সাজিয়ে মঞ্চে নামানো হতো। আধুনিক ধারার নাটকের মঞ্চায়নে টেকনিক্যাল দিকগুলোর তারাই পথিকৃত সম্প্রসারিত ঢাকায়। আজকের মহিলা সমিতি মঞ্চ ও গাইড হাউসের জন্মে লালকুঠির অবদান অনেক। যতœ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে নাট্য চর্চার প্রাণকেন্দ্র কালের সাক্ষী লালকুঠি হারিয়ে গেছে। পুরান ঢাকা থেকেই ঢাকায় খেলাধুলার সূত্রপাত ঘটে। আরমানিটোলার কয়েকটি যুব সংগঠন সেদিন ফুটবল ও হকি দল গড়ে তোলে। তারা সামজিক ও সেবামূলক কাজেও জড়িয়ে পড়ে। সব ধর্মের মানুষের মিলনকেন্দ্র ছিল পুরান ঢাকা। সম্প্রীতির বন্ধনে মুসলমানের ঈদ উৎসব, শিয়া মুসলমানদের মহররমের তাজিয়া উৎসব, হিন্দু ধর্মাবলাম্বীদের পূজা-পার্বণ, মাদার তেরেসা মিশনারিজসহ খ্রীস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উৎসব ছাড়াও পৌষ সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানো উৎসব, পহেলা ফাল্গুন, চৈত্র সংক্রান্তি, নববর্ষ বরণসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকত সারাবছর। খাবার-দাবারের আয়োজনে মোরগ পোলাও, বিরিয়ানি, কয়েক ধরনের কাবাব, বাখরখানি, ফালুদাসহ বাহারি কত যে খাবার তৈরি হয় পুরান ঢাকায়। ভোজনবিলাসী খ্যাতিও আছে কুট্টিদের। পুরান ঢাকার সামাজিক বন্ধন ও বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠানে যে ধুমধাম হয় তা বিরল। তারা পুত্রবধূ ও জামাইকে খুবই সম্মান দেয়। শাঁখারিবাজার ছিল সঙ্গীতের যন্ত্রপাতি তৈরির এলাকা। যেখানে গহনা তৈরিও হতো। বাংলাবাজার সর্ববৃহৎ পুস্তক বিপণিবাজার। পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে দেশী-বিদেশী সব ধরনের বইয়ের প্রকাশ ও পরিবেশনা কেন্দ্র। বড় লাইব্রেরি, ছাপাখানা ঘিরে এই এলাকা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লেখক বুদ্ধিজীবী, ভিড় জমায় বাংলাবাজারে। কাছেই স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও সংলগ্ন হাসপাতাল (মিটফোর্ড) গড়ে তোলা হয়। ঢাকার প্রধান নদী বন্দর সদরঘাট টার্মিনাল, লালবাগের কেল্লা, তারা মসজিদ, ঢাকেশ^রী মন্দির, আহসান মঞ্জিল, হোসেনি দালান, ইমামবাড়া, বড় ও ছোট কাটরা সবই ঢাকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে ঐশ্বর্যপূর্ণ।
×