ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ শ’ টন পেঁয়াজ নিয়ে দুই জাহাজ চট্টগ্রামে, খালাস শুরু

প্রকাশিত: ১১:০০, ১ অক্টোবর ২০১৯

পাঁচ শ’ টন পেঁয়াজ নিয়ে দুই জাহাজ চট্টগ্রামে, খালাস শুরু

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ দেশে চাহিদার কাছাকাছি পেঁয়াজ উৎপাদন হয়ে থাকে। কিন্তু সংরক্ষণ তথা স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি গড়ে না ওঠায় বিপুল পেঁয়াজ সরবরাহ প্রক্রিয়ার আগেই পচে নষ্ট হয়ে যায়। মাঠ পর্যায়ে উৎপাদনকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপরদিকে, চাহিদা মেটাতে বিপুল বাড়তি পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আর এর পেছনে মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা চলে যায়। স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি প্রতিষ্ঠা করা এবং উৎপাদনকারীদের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে না- সরকারের পক্ষে এমন বার্তা আগে ভাগে পৌঁছে দেয়া হলে পেঁয়াজের উৎপাদন বর্তমান সময়ের চেয়ে আরও বহু গুণ বাড়বে। যা পেঁয়াজের চাহিদা মেটাতে অনেকাংশে সক্ষম হবে। এ তথ্য আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী এবং পেঁয়াজ নিয়ে যারা বিভিন্ন পর্যায়ে গবেষণা করেন এমন সংশ্লিষ্ট সূত্রসমূহের। দেশীয় বাজারে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পেঁয়াজের মূল্য উর্ধমুখী ছিল। রবিবার ভারত সরকার পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণা দিলে দেশে পেঁয়াজের মূল্য এক লাফে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যায়। দেশের বড় বড় শহরগুলোতে বর্তমানে প্রতি কেজি পেঁয়াজ কেজি প্রতি ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সোমবার কোন কোন স্থানে তা ১১০ টাকায় গিয়েও দাঁড়িয়েছে বলেও বিভিন্ন সূত্রে দাবি করা হয়েছে। এ অবস্থায় গত রবিবার মিসর ও তুরস্ক থেকে আমদানির প্রায় ৫শ’ টন পেঁয়াজ দুই জাহাজ বোঝাই হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে এবং খালাসও শুরু হয়েছে। এছাড়া সোমবার টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে মিয়ানমার থেকে এসেছে সাড়ে ৩শ’ টন পেঁয়াজ। আগামী সপ্তাহের মধ্যে মিসর ও তুরস্ক থেকে আরও আসবে পেঁয়াজের চালান। এদিকে, প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ভারতে বন্যার কারণে পেঁয়াজের ফলন এবং সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সেদেশে পেঁয়াজের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সামলাতে সেদেশের সরকার গত রবিবার বিকেল ৩টায় পেঁয়াজের রফতানি বন্ধ করে দেয়। এর ফলে সীমান্তের স্থলবন্দরসমূহ দিয়ে পেঁয়াজ বোঝাই কোন ট্রাক আর প্রবেশ করেনি। এ ঘটনা প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে পেঁয়াজের বাজার সম্পূর্ণভাবে অস্থিতিশীল পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সোমবার পেঁয়াজের বিষয়টি খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টন। দেশে উৎপাদিত হয় প্রায় ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। মওসুমে এ পেঁয়াজ উৎপাদিত হওয়ার পর বিক্রি পর্যায়ে তা সম্পন্ন করার প্রক্রিয়ায় প্রায় ৯ লাখ টনই পচে নষ্ট হয়ে যায়। অবশিষ্ট ১৫ লাখ টন অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে যোগান হয়। এর ফলে চাহিদার অবশিষ্ট অর্থাৎ ৯ থেকে ১০ লাখ টন বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। মূলত পেঁয়াজের শীর্ষ ভাগ আমদানি হয় পাশর্^বর্তী দেশ ভারত থেকে। একেবারে সামান্য পরিমাণ আমদানি হয় মিয়ানমার, তুরস্ক, পাকিস্তান ও মিসর থেকে। শুধু তাই নয়, মাঝে মধ্যে চীন থেকেও পেঁয়াজ এসে থাকে। এবারের উদ্ভূত পরিস্থিতিতেও আমদানির সম্ভাবনা রয়েছে। মসলার বাজারে আদার বড় অংশটি আসে চীন থেকে। এদিকে, ভারতীয় পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণার আগে যে সমস্ত পেঁয়াজ আমদানির পাইপলাইনে ছিল সেগুলো আপাতত বন্ধ রয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ পেঁয়াজ ভারত সরকারকে ছাড়তে হবে। কেননা, এলসি করার পর সেদেশে সংশ্লিষ্ট পরিমাণ পেঁয়াজের টেন্ডার পাস হয়ে আছে। সুতরাং এগুলো ছাড়তেই হবে। কিন্তু এদিকে, পেঁয়াজের বাজার মূল্যে যে ঝাঁজ সৃষ্টি হয়েছে তা ভোক্তা মহলে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। এসব ঘটনা নিয়ে বাণিজ্য সচিব ড. মোঃ জাফর উদ্দিন সোমবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ভারত সরকার পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণার পর ইতোমধ্যে মিয়ানমার, তুরস্ক ও মিসর থেকে পেঁয়াজ আমদানি এলসি খুলেছে ব্যবসায়ীরা। এছাড়া গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পেঁয়াজের মূল্য উর্ধগতি থাকায় দুই জাহাজ যোগে ১৩ কন্টেনার বোঝাই অর্থাৎ প্রায় প্রায় ৫শ’ টন পেঁয়াজ তুরস্ক ও মিসর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে। এর মধ্যে রবিবার থেকে এ পেঁয়াজ খালাস শুরু হয়েছে। সোমবারও খালাস কাজ অব্যাহত ছিল। পরবর্তীতে তুরস্ক, মিসর থেকে সহসা পেঁয়াজের চালান পৌঁছাবে। এর পরেই দেশের বাজারে পেঁয়াজের মূল্য হ্রাস পাবে। আমদানিকারকদের সূত্রে জানানো হয়েছে, সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাবে এদেশে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। অথচ ইতোমধ্যে অন্য বেশ কয়েকটি সেক্টরসহ দেশীয় পেঁয়াজের উৎপাদন চাহিদা মেটাতে সক্ষম। কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে সরবরাহ প্রক্রিয়ায় বছরে যে প্রায় ৯ লাখ টন পচে যায় সেটাই চাহিদা মেটাতে ঘাটতি হয়ে যায়। ফলে এই পরিমাণ পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় এবং এর পুরো ভাগই আসে ভারত থেকে। অর্থাৎ পেঁয়াজের ক্ষেত্রে এদেশের ভারত নির্ভরতা রয়েছে। ব্যবসায়ীদের পক্ষে জানানো হয়েছে, পেঁয়াজ খাদ্য তালিকায় মসলা হিসেবে ব্যবহার না হয়ে রীতিমতো সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। ফলে এর চাহিদা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। অথচ এ পেঁয়াজকে মসলা হিসেবে ব্যবহার করা হলে এর চাহিদা যেমন অনেক হ্রাস পাবে তেমনি আমদানি নির্ভরতাও কমবে। অপরদিকে, সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে এদেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ পুরো চাহিদা মেটাতে সক্ষম। আমদানিকারকদের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ভারতে বছরে কমপক্ষে ৫ বার পেঁয়াজ উৎপাদনের মওসুম চলে। আর এদেশে পেঁয়াজের মওসুম হয় শুধু এক দফায়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, ভারতে বছরজুড়ে পেঁয়াজ উৎপাদিত হচ্ছে। সে পেঁয়াজ নিজ দেশে চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে পেঁয়াজের সংরক্ষণ ব্যবস্থা একদিকে যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি অন্যদিকে সাগরে মাছ ধরার ক্ষেত্রে যেমন বছরের বিভিন্ন সময়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয় অনুরূপভাবে দেশীয় পেঁয়াজ উৎপাদনের মওসুমের সময় আমদানির ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলে দেশীয় উৎপাদনকারীরা যেমন উৎপাদন বৃদ্ধিতে উঠে পড়ে লাগবে তেমনি চাষীরা লাভবানও হবে। অথচ বর্তমানে সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকার কারণে উৎপাদনকারীরা ব্যাপক হারে উৎপাদনে যায় না। দেশের উত্তরবঙ্গের পাবনা, দিনাজপুর, ফরিদপুর, মেহেরপুর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, জামালপুরসহ ১০ জেলায় দেশীয় পেঁয়াজের মূল উৎপাদন হয়ে থাকে। কিন্তু নেই শুধু সংরক্ষণ ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা কার্যকর করা গেলে দেশে পেঁয়াজ আমদানির কোন প্রয়োজনীয়তা থাকবে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মত ব্যক্ত করেছে। সূত্র জানায়, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাজারে পেঁয়াজের মূল্য উর্ধগতি ছিল। সর্বশেষ টন প্রতি ৩৫০ ডলার থেকে ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানি মূল্য ৮৫০ ডলারে উন্নীত হয়। এরপর গত রবিবার রফতানিও বন্ধ করে দেয়া হয়। এর ফলে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের প্রধান প্রধান পাইকারি বাজারগুলোতে পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যায়। চট্টগ্রামে খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ ইদ্রিছ জানিয়েছেন, পেঁয়াজের ক্ষেত্রে আমাদের ভারত নির্ভরতা যেভাবেই হোক কমাতে হবে। তার মতে, ‘পেঁয়াজকে মসলা হিসেবে ব্যবহার করতে হবে, সবজির আকারে নয়।’ চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারে পরিস্থিতি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে আমদানির পেঁয়াজ বাজারে ঢুকতে শুরু করেছে। আর এছাড়া ভারতীয় পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণার পর চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে কেজি প্রতি পেঁয়াজের মূল্য ৯০ টাকা ছাড়িয়েছে। এর কাছাকাছি রয়েছে মিয়ানমারের পেঁয়াজের মূল্য।’ তিনি আরও জানান, আগামী সপ্তাহের মধ্যে মিসর ও তুরস্ক থেকে আরও পেঁয়াজের চালান এসে পৌঁছবে। কিছু ব্যবসায়ী পেঁয়াজ আমদানির এলসি করেছেন বলে তিনি জেনেছেন। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ঢাকার কাওরানবাজার, শ্যামবাজার, চট্টগ্রামের হামিদুল্লাহ বাজারসহ দেশের বড় বড় বাজারগুলোতে পেঁয়াজের মূল্য শুধু বাড়েনি, কোন কোন স্থানে আরও অধিক মূল্যের আশায় বিক্রিও বন্ধ রাখা হয়েছে। একজাতীয় লোভী ব্যবসায়ী এমন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছেন।
×