ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কবীর চৌধুরী তন্ময়

বাঙালীর আশার বাতিঘর

প্রকাশিত: ০৭:৩১, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 বাঙালীর আশার বাতিঘর

তখন স্কুলের ছাত্র। পাড়ার বড় ভাই নিয়ে গেল মিছিলে, কি নিয়ে মিছিল সেটা মনে করতে পারছি না। তবে, মিছিলের সময় পাড়ার বড় ভাই হঠাৎ বলল, ‘এই কোটটা খুলে ফেল। এটা আমাদের নয়।’ আমি তাকে পাত্তা না দিয়ে ওই মিছিল থেকে বের হয়ে রিক্সা করে সোজা বাসায় চলে এলাম। কারণ, বাবা আমাকে ওই কোট পরানোর সময় বলেছিলেন, এটা কিন্তু সাধারণ কোট নয়। এটা একটা আদর্শ। এটায় কখনও কলঙ্ক লাগতে দিবি না। এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার জন্য ২৩ বছরের নেতৃত্বের মূর্তপ্রতীক। এই কোটের প্রতিটি সুতায় নেতা ও নেতৃত্বের গুণাবলী বিদ্যমান যা খোলা চোখে দেখা যায় না। সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে বাবাকে বিষয়টি বলায় তিনি বেজায় চটেছেন। কারণ, স্বাধীনতাবিরোধী ও রাজাকারের বংশধর এবং তাদের অনুসারীরা এই কোট দেখলেই জ্বলে ওঠে। এরা মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা-সংগ্রামের ২৩ বছরের অর্জিত লাল-সবুজের পতাকার কাছে চূড়ান্ত পরাজয় ১৯৭১ সালেও মেনে নিতে পারেনি, আজও নয়। তাই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ও তার পরবর্তী প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে ভুল পথে পরিচালিত করতে সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করাসহ মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পাল্টে পাকিস্তানী ভাবধারা বজায় রাখতে শুধু ইতিহাস বিকৃতি করেই ক্ষান্ত হয়নি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে সেই হত্যার বিচারকাজ চিরতরে বন্ধ করার জন্য বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাককে ব্যবহার করে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি’ করে। বাঙালী জাতির ওপর কলঙ্ক লেপন করে দেয়। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এরপর ৩৮ বছর ধরে নিজ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও আপোসহীন নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশের রাজনীতির মূল স্রোতধারার প্রধান নেতা হিসেবে তিনি নিজেকে শুধু উপমহাদেশেই নয়, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের নজর কাড়েন। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক জোট-দলগুলো ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে চূড়ান্ত বিজয়ী হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন আন্দোলন-সংগ্রাম করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেন। আইনী বাধা অপসারণের জন্য সংবিধান বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে সেই কালো আইন ও কলঙ্কময় অধ্যায় ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিতকরণ বিল’ সপ্তম সংসদে উত্থাপন করেন। ওই বছর ১২ নবেম্বর আইনটি সংসদে পাস হয় এবং ১৪ নবেম্বর মহামান্য রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর এটি পরিপূর্ণভাবে আইনে পরিণত হয়। ফলে বিশ্বাসঘাতক মোশতাকের মাধ্যমে জারি করা এবং মেজর জিয়াউর রহমানের সময় বৈধতা পাওয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বিলুপ্ত বলে গণ্য হয়। আর এভাবেই ওই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বিলুপ্ত করার মাধ্যমে শুরু করে বাঙালী জাতির কলঙ্ক মোচনের কাজ। স্বাধীনতাকামী বাঙালীর আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে বাংলাদেশের অশুভ ছায়া যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী অপরাধী, চিহ্নিত রাজাকারদের বিচারের মাধ্যমে স্বাধীনতার পরবর্তী প্রজন্মকে অভিশাপমুক্ত করেন একমাত্র শেখ হাসিনা। ত্রিশ লাখ শহীদ আর দুই লাখেরও বেশি নারী মুক্তিযোদ্ধার সম্ভ্রম বিনাশের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে তার সঠিক স্রোতধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিটি সময়ে সেকেন্ড কিংবা মিনিটে-মিনিটে ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ও অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠত হওয়া মেজর জিয়া-খালেদার অশিক্ষিত সন্তান তারেক জিয়ার ষড়যন্ত্রে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় স্বয়ং স্রষ্টাই নিজ উদ্যোগে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেছেন আজকের বাংলাদেশের জন্য, স্বাধীনতার পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের জন্য। শেখ হাসিনা আমাদের শিখিয়েছেন, সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থেকে মাথা উঁচু করে কিভাবে পশ্চিমাদের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে সঠিক বিচারের মাধ্যমে মানবতাবিরোধীদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলাতে হয়। দেশী-বিদেশী সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে কিভাবে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস রেখে দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতুর দৃশ্যায়ন করতে হয়। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি কতটুকু দায়িত্ববান হলে নিজ দলের কোন নেতাকর্মী অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও আপোসহীনভাবে কিভাবে আইনের আওতায় আনতে হয়- এটি একমাত্র শেখ হাসিনাই আমাদের সামনে উদাহরণ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রথম সন্তান শেখ হাসিনা ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তখন কেউ কি ভেবেছে, ৭২ বছর আগে জন্ম নেয়া এই হাসু মেয়েটিই হবে বাংলাদেশ ও বাঙালীর মর্যাদার প্রতীক। কেউ কি ভেবেছিল, এই হাসু আপাই হবে আমাদের নেত্রী, আমাদের অহঙ্কার, বাঙালীর আশার বাতিঘর। হাসু আপার রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পিতার রাজনীতি তার অস্থিমজ্জায়। তাঁর বাবার রাজনৈতিক উত্থান নিজের চোখে তিনি দেখেছেন। কিভাবে শেখ মুজিব তাঁর রাজনীতির গগন পথে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে কিভাবে সবাইকে পেছনে ফেলে একদল বিশ্বস্ত সহযোগীদের নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে- এগুলো দেখে-শিখেই বেড়ে উঠেছেন শেখ হাসিনা। আর ছাত্রলীগের কর্মী থেকে রাজনীতির পাঠ গ্রহণ, স্কুল-কলেজে পড়ার সময় থেকেই নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতাও তখন সবার দৃষ্টি কাড়েন এবং বিশ্বস্ত-গ্রহণযোগ্য হয়ে ১৯৬৬ সালে বেগম বদরুন্নেছা কলেজছাত্রী সংসদ নির্বাচনে ছাত্র লীগের প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে সহ-সভাপতি নির্বাচিতও হন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এই পর্যন্ত ৪ মেয়াদে ক্ষমতাসীন হয়েছে। গণতন্ত্র ও দেশের মানুষের ভোট এবং ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামে অসামান্য অবদান রাখার পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনায়ও ব্যাপক সাফল্যের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৯৬-২০০১ সালে তাঁর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি ও গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি তাঁর সরকারের অন্যতম সাফল্য হিসেবে এখনও বিবেচিত হয়ে আসছে। আর বর্তমানে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত ও মধ্যম আয়ের আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য পূরণে কাজ করে যাচ্ছে। গণতন্ত্র, শান্তি ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং নারী শিক্ষার বিস্তার, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস ও দারিদ্র্য বিমোচনের সংগ্রামে অসামান্য ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি হিসেবে দেশী-বিদেশী বেশকিছু পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এর মধ্যে সাউথ-সাউথ ভিশনারি পুরস্কার-২০১৪, শান্তি বৃক্ষ-২০১৪, জাতিসংঘ পুরস্কার-২০১৩ ও ২০১০, রোটারি শান্তি পুরস্কার-২০১৩, গোভি পুরস্কার-২০১২, সাউথ-সাউথ পুরস্কার-২০১১, ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কার-২০১০, পার্ল এস বার্ক পুরস্কার-২০০০, সিইআরইএস মেডাল-১৯৯৯, এম কে গান্ধী পুরস্কার-১৯৯৮, মাদার তেরেসা শান্তি পুরস্কার-১৯৯৮, ইউনেস্কোর ফেলিক্স হোফুয়েট-বোয়েগনি শান্তি পুরস্কার-১৯৯৮ প্রভৃতি উল্লেযোগ্য। এছাড়াও পরিবেশ সংরক্ষণে অসামান্য অবদানের জন্য জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন শেখ হাসিনা। অন্যদিকে বিশ্বের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় শেখ হাসিনাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিও প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৬৮ সালে বিজ্ঞানী এম ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের এক ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও এক মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ হোসেন। শেখ হাসিনা তাঁর সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে দেশ ও মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত রেখেছেন। পাকিস্তানের জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে, বার বার মৃতুর মুখে দাঁড়িয়ে ১৯৭১ সালে অধিকারবঞ্চিত বাঙালীদের যেভাবে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ঠিক তেমনিভাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের যেখানেই মানুষ তার অধিকারবঞ্চিত হবে, যেখানেই শোষণ আর নির্যাতনের শিকার হবে, নিষ্পেষিত হবে মানুষ আর মানবতা; সেখানেই ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা- এই শুভ কামনা নিরন্তর। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)
×