ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দোষীদের শাস্তি কমানোর চেষ্টা

সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের উদ্যোগ!

প্রকাশিত: ০৯:৫২, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের উদ্যোগ!

রাজন ভট্টাচার্য ॥ এক বছর আগে করা ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ বাস্তবায়ন শুরু না করেই সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মূলত মালিক-শ্রমিক নেতাদের চাপের মুখেই পিছু হটেছে সরকার। তাদের দাবি আইনে যে কোন মূল্যে শাস্তি কমাতে হবে। অপরাধ হতে হবে জামিনযোগ্য। চালকদের শিক্ষার কোন বাধ্যবাধকতা থাকতে পারবে না। এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সড়ক নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিনিধিরা। পুলিশসহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দীর্ঘদিন দাবির মুখে ২০১৮ সালে আইন পাস করা হলেও নানা জটিলতায় তা বাস্তবায়ন শুরু সম্ভব হয়নি। পুরনো আইনে সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত মামলা হচ্ছে। ফলে অপরাধীরা সহজ শাস্তিতে পার পেয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া মানেই পরিবহন সেক্টরের মালিক শ্রমিকদের কাছে নতি স্বীকার করার শামিল। তাছাড়া এ ঘটনায় দেশে একটি নেতিবাচক নজির স্থাপন হবে। সেইসঙ্গে গণপরিবহন ব্যবস্থা শৃঙ্খলা ও সড়ক নিরাপত্তা প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করা হবে বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। সারাদেশে গণপরিবহন ব্যবস্থা শৃঙ্খলায় ফেরানো ও সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ পাস হয়। গত ১৯ সেপ্টেম্বর আইনটির এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এখন পর্যন্ত আইনটি বাস্তবায়ন শুরু সম্ভব হয়নি। সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের বাধার মুখে আইনটি পুনরায় সংশোধনের সুপারিশ করেছে আইন বিশ্লেষণ কমিটি। আইনটি সংসদে পাস হওয়ার পর থেকেই এর বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। একটি পক্ষ বাস্তবায়নের পক্ষে অবস্থান নিলেও অন্য পক্ষটি সমাধানের চেষ্টা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় মালিক ও শ্রমিকদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবি দাওয়া পাঠানো হয় মন্ত্রণালয়ে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে সভাপতি করে তিন সদস্যের ওই কমিটি গঠন করে সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল। কমিটির অন্য সদস্য হলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। গত বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন কমিটির ওই তিন সদস্য। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সাবেক নৌমন্ত্রী, সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি ও সংসদ সদস্য শাজাহান খান, সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গাসহ মালিক ও শ্রমিক নেতারা। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ এর প্রায়োগিক দিক নিয়ে মতামত প্রদান সংক্রান্ত কমিটি নিজেদের মতামত ও সুপারিশ জমা দিয়েছে। মতামতে বলা হয়েছে, এই আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, মোটরযান চালানোর সময় দুর্ঘটনায় কোন ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে। কোন ব্যক্তির বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের কারণে সংঘটিত দুর্ঘটনায় কারও প্রাণহানি ঘটলে দায়ী ব্যক্তিকে সর্বনিম্ন পাঁচ বছরের কারাদন্ড এবং পাঁচ লাখ টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত করতে হবে। কমিটি সূত্রে এই তথ্য পাওয়া গেছে। সড়ক আইনের ১৩ ধারায় দুটি উপধারা নতুনভাবে যোগ করতে মতামত দেয় এই প্রায়োগিক কমিটি। মতামতে বলা হয়, ১৩ ধারার ২ ও ৩ উপধারায় বিধান লঙ্ঘনের জন্য কোন দন্ড আরোপের ধারা না থাকায় এভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ৭০(ক), যদি কোন ব্যক্তি ১৩ ধারার উপধারার ১ ও ২ লঙ্ঘন করেন, তাহলে ওই লঙ্ঘন হবে একটি অপরাধ। সেজন্য তিনি অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। এ বিষয়ে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামছুল হক বলেন, সড়কে আইন বাস্তবায়নে অনীহা ও আইন না মেনে বিশৃঙ্খলা তৈরি করা যায়- এই অভয়ারণ্যের কারণে শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না। দুর্ঘটনাও কমানো যাচ্ছে না। ‘মোটর ভেহিক্যাল অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩’ একাধিক বিধিমালা ছিল। তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। যদি সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য আইন বাস্তবায়ন আগ্রহী না হই, তাহলে ১০টি আইন করেও শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না। এক্ষেত্রে সরকার প্রধানের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া পরিবহন সেক্টরের বড় বড় মাফিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আমরা একটা প্রতিবেদন তৈরি করব। ওই প্রতিবেদন মূল কমিটির (জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল) কাছে হ্যান্ডওভার করব। মূল কমিটি পরবর্তী কার্যক্রমের বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে। যেসব অসুবিধা ছিল, তা নিয়ে এতদিন ৩-৪টি সভা করেছি। ওইসব সভায় একটি সিদ্ধান্তে এসে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রতিবেদন পাঠাতে পারব। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলেই হবে। এ সময় পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের আইনে থাকা শাস্তির মেয়াদ কমানোর দাবি ছিল বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুধু সাজা কমানো নয়, অনেক দাবি ছিল। সবকিছু নিয়েই আলোচনা হয়েছে। সব বিশ্লেষণ করে যে সিদ্ধান্তে যাচ্ছি তা চূড়ান্ত করেছি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ও অন্য দেশে এ আইনগুলোয় (সড়ক পরিবহন) কী আছে, সেখানে কী ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে- তা আমরা দেখেছি এবং সেগুলো এনে পর্যালোচনা করেছি। ওই অনুযায়ী সিদ্ধান্তটি নিতে যাচ্ছি। বাধার কারণে সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যারা বাধা দিচ্ছে, তারা কী সরকারের চেয়ে বেশি শক্তিশালী বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান খান বলেন, আমরা আইনটি যখন তৈরি করেছি, তখন তাদের (পরিবহন মালিক-শ্রমিক) কিছু দাবি ছিল। তা সম্পূর্ণভাবে আইনে আসেনি। এটি তাদের ডিমান্ড ছিল। এ জন্য পাস হওয়া আইন প্রয়োগের কোথায় সমস্যা হচ্ছে, কেন হচ্ছে- তা আমরা দেখার জন্য বসেছি। এর মানে আইনটি আবার সংশোধন হতে পারে কি না- সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, এটি হতে পারে। যদি জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল মনে করে এ আইনটি সংশোধন হতে পারে, তাহলে তারা প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সংসদে নিয়ে যাবে। সড়ক পরিবহন আইনের অপরাধ জামিন অযোগ্য করার বিষয়ে গত বছর শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছে। তবে পরিবহন শ্রমিকরা এটিকে জামিনযোগ্য করার দাবি জানিয়ে আসছেন। আপনাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জামিনযোগ্য করলে তা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে অবজ্ঞা করা হয় কি না বিষয়ে সংবাদিকরা জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি বলেছি, পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এ আইন কীভাবে প্রয়োগ করছে, বিধান কী কী রয়েছে- তা আমরা দেখেছি। আমরা সেগুলো বিশ্লেষণ করে স্টেকহোল্ডাররা কী চাচ্ছে, এগুলো আমরা বিস্তারিতভাবে দেখেছি। সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থানে যাওয়ার জন্য হয়তো আমরা একটি সুপারিশ করতে পারি। এখানে জামিন পাবে কী পাবে না, কারও শাস্তি আরও বৃদ্ধি হবে কী হবে না- এটি সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের ব্যাপার। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, জামিনযোগ্য হচ্ছে- এ কথাটি বলা ঠিক হবে না। দেখুন, একটি আইন করার পর সংসদে পাস হওয়ার পরও যখন প্রয়োগ করা হয়, তখন কিছু সুবিধা-অসুবিধার কথা উঠে আসে। আমরা চাই, এটি (সড়ক পরিবহন আইন) সর্বজনীন প্রয়োগে যাতে কোন অসুবিধা না হয়। আমরা এই আইনের মাধ্যমে যে সমস্যাগুলো দূর করার চেষ্টা করছিলাম, সেটি যাতে আরও ভালভাবে হয়- এ জন্য জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল আমাদের এই কমিটির কাছে দায়িত্ব দিয়েছিল। তিনি বলেন, আমরা অনেক সভা করেছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাব-কমিটির আহ্বায়ক। তিনি যেটি বলেছেন, আমরা সব দিক বিবেচনা করে একটা সুপারিশ করেছি। যদি জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল গ্রহণ করে, তাহলে এই আইনের যে পরিবর্তনগুলো করতে হবে, অবশ্যই সেটি একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গিয়ে। সর্বশেষ প্রক্রিয়া হচ্ছে, জাতীয় সংসদে গিয়ে পাস হবে। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, এই আইনটা সবার জন্য গ্রহণযোগ্য একটা আইন এবং এই আইনটার যে উদ্দেশ্য ছিল, সেটিই যেন আমরা এই আইনের (পরিমার্জিত আইন) মাধ্যমে সাধন করতে পারি- এটিই আমাদের চেষ্টা। জানা গেছে, গত বছর আইন পাস হওয়ার পর গত ৮ অক্টোবর ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’-এর গেজেট জারি হয়। তবে এখন পর্যন্ত আইনটি বাস্তবায়নের জন্য বিধিমালা তৈরি করা হয়নি। এছাড়া আইনটি জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার পর থেকে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা পরিবহন ধর্মঘটসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করেছে। তাদের বাধার মুখে এখনও আইনটি বাস্তবায়ন করেনি সরকার। মালিক-শ্রমিকদের দাবির মধ্যে রয়েছে সড়ক পরিবহন আইনের সব ধারা জামিনযোগ্য করা, সড়ক দুর্ঘটনায় শ্রমিকের অর্থ ৫ লাখ টাকার বিধান বাতিল, ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণী করা ইত্যাদি। জানতে চাইলে নিরাপদ নৌ সড়ক রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, আমাদের কথা হলো যে আইনে মানুষ সন্তুষ্ট হবে না তা চাই না। সকলের বারবার মতামত নিয়ে এক বছর আগে আইন করার পর এখন সংশোধের বিষয়টি দুর্বলতারই ইঙ্গিত দেয়। তাহলে আগে থেকেই এসব বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত ছিল। বড় কথা হলো দেশের মানুষ চায় সড়কে নৈরাজ্য বন্ধ হোক। দোষী চালকদের বিচার হোক। তাহলে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
×