ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে দুুুই বছরে লাপাত্তা ২ ডজন কোম্পানি

প্রকাশিত: ০৯:৫০, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে দুুুই বছরে লাপাত্তা ২ ডজন কোম্পানি

রহিম শেখ ॥ ডেসটিনি-যুবক ব্যবসা গুটিয়েছে ’১০ সালেরও আগে। কিন্তু গত দুই বছরেই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে অন্তত দুই ডজন ‘এমএলএম প্রতারক’ কোম্পানি। এসব কোম্পানি হুন্ডির মাধ্যমে এসব টাকা পাচার করেছে। এরপর সপরিবারে পাড়ি জমিয়েছে বিদেশে। তবে রাজধানীতে এখনও অন্তত শতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা এমএলএম বা পিরামিড ব্যবসার আড়ালে গড়ে তুলছে ‘নেটওয়ার্ক মার্কেটিং’। ফুড সাপ্লিমেন্ট, প্রসাধনসামগ্রী ও হারবাল ওষুধ বিপণনের নামে সদস্য সংগ্রহ করে এমএলএম কার্যক্রম চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। আর ভবিষ্যত আয়ের আশায় তাদের সেই পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছেন বেকার যুবক-যুবতীরা। সাধারণ মানুষের কষ্টে জমানো অর্থ লুটে নিয়ে সংঘবদ্ধ প্রতারকরা রাতারাতি উধাও হয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার তৈরি ‘দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা’ তালিকা বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়েও প্রতারকদের বিদেশ পালানো বন্ধ করা যাচ্ছে না। সরকার লাইসেন্স না দিলেও থামানো যাচ্ছে না এমএলএম নামের ভুঁইফোড় হায় হায় কোম্পানিগুলোর প্রতারণা, জালিয়াতি। ডেসটিনি-২০০০, যুবক, ইউনিপেটুইউসহ শতাধিক ‘হায় হায় কোম্পানি’র বিরুদ্ধে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিলেও প্রতারণার ধরন পাল্টে নতুন নতুন এমএলএম কোম্পানি তাদের প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। ’১০ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এসব কোম্পানির সংখ্যা। ফুড সাপ্লিমেন্ট, প্রসাধনসামগ্রী ও হারবাল ওষুধ বিপণনের নামে এমএলএম কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা। যদিও ওষুধ (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৮২তেও ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আছে। কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই ব্যবসার ধরন ‘এমএলএম’ বলতে চায় না। তারা বলছে, ‘নেটওয়ার্ক মার্কেটিং’। গত দুই বছরে অন্তত ১২ কোম্পানি অফিস গুটিয়ে হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে। এগুলো হচ্ছে নোভরা প্রোডাক্টস লিমিটেড, তিয়ানশি বাংলাদেশ লিমিটেড, কে লিংক ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ লিমিটেড, সামি ডিরেক্ট কোম্পানি লিমিটেড, ডিএক্সএন ফার্মাসিউটিক্যালস, ডব্লিউএম-২১, আপনজন, ইউটুইউ, রিচ, মিঙ্গেল লিমিটেড, গ্রেট ইন্টারন্যাশনাল ও ওয়ার্ল্ড মিশন-২১। এরপরও নতুন নতুন কোম্পানি ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে। খোদ রাজধানীতেই শতাধিক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কৌশলে এমএলএম ব্যবসা করছে। ব্যবসা করতে নেয়া হচ্ছে ট্রেড লাইসেন্স, কেউবা নিচ্ছে বিএসটিআইর সার্টিফিকেট। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জনকণ্ঠকে বলেন, এমএলএম কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক। এরা নানাভাবে মানুষকে প্রতারণা করে। এজন্য এখন এগুলো বন্ধ আছে, কাউকে লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে না। ই-কমার্সের নামে এমএলএম ॥ ই-কমার্সের আড়ালে ’১৬ সাল থেকে অবৈধ মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা করে আসছিল নোভরা প্রোডাক্টস লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি। সারাদেশের অন্তত ৪০ হাজার ডিস্ট্রিবিউটরের কাছ থেকে ৬শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ভেগেছে প্রতিষ্ঠানটি। রাজধানীর পল্টনের রূপায়ণ তাজ সেন্টারের অফিস গুটিয়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে যায় এ প্রতিষ্ঠনের হোতারা। শুরুতে বিনিয়োগে আগ্রহীদের বিভিন্ন ধরনের লোভ দেখিয়ে বলা হতো, নোভরা ই-কমার্স বা সরাসরি মার্কেটিংয়ের প্রতিষ্ঠান। এখানে বিনিয়োগ করলে প্রোডাক্টস, কমিশন ও মাসিক বেতন দেয়া হবে। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা প্রায় তিন বছর আগে বিনিয়োগ করেও কোন টাকা বা কমিশন ফেরত পাননি। পল্টনের পাশাপাশি নোভরার অফিস ছিল মিরপুর ডিওএইচএসে। সেখানে মূলত অফিস করতেন কোম্পানির উর্ধতন কর্মকর্তারা। গত বৃহস্পতিবার পল্টন ও মিরপুর ডিওএইচএসে গিয়ে দেখা যায়, এই নামে এখন কোন কোম্পানির এখানে অস্তিত্ব নেই। কিন্তু ভুক্তভোগী গ্রাহকরা টাকার জন্য প্রতিদিনই আসেন। ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে পল্লবী থানায় এ বছরের ২৩ এপ্রিল মামলা দায়ের করেন এফ আই মানিক নামে এক গ্রাহক। পরবর্তীতে মামলাটি অনুসন্ধানের দায়িত্ব পায় ডিবির সিরিয়াস ক্রাইম বিভাগ। নোভরা প্রোডাক্টের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) ফজলুল রশিদ মৃধা। শুক্রবার তার ব্যবহৃত নম্বরে একাধিকবার ফোন করলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। চাকরির নামে লাইফওয়ের প্রতারণা ॥ ২০ হাজার বেকার যুবক ও তরুণকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি ও পণ্য বিক্রির মাধ্যমে টাকা উপার্জনের প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় ৭০ কোটি টাকা হাতিয়ে কেটে পড়েছে লাইফওয়ে বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি শুরুতে ঢাকায় প্রতারণার ব্যবসা করলে র‌্যাবের অভিযানে উত্তরার অফিস গুটিয়ে পালিয়ে যায়। পরে কখনও গাজীপুর, কখনও ব্রাহ্মহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জে অফিস করে প্রতারণা চালিয়ে যায়। প্রতারণার শিকার আকবর হোসেন নামে এক ভুক্তভোগী জনকণ্ঠকে বলেন, পরিচিত একজনের মাধ্যমে ভাল চাকরির খবর পেয়ে বগুড়া থেকে ঢাকায় আসি। উত্তরায় লাইফওয়ে প্রতিষ্ঠানে এসে ৪৮ হাজার টাকা জমা দেই। আমার মতো এমন আরও অনেকের কাছ থেকেই টাকা নিয়েছে ওরা। এরপর ওই প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয়- ‘চাকরি’ চলবে তিন মাস, থাকা খাওয়া বাবদ মাসে ১০ হাজার ৫শ’ টাকা কাটা হবে। আর বাকি টাকা ফেরত দেয়া হবে। কিন্তু তিন মাস হয়ে গেলেও টাকা ফেরত দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। পরে জানা যায়, ওই টাকার বিনিময়ে তারা ইলেকট্রনিক্স ও সিরামিক পণ্য দেবে, সেগুলো বিক্রি করে টাকা তুলতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গাজীপুরের ভোগড়া চান্দনা-চৌরাস্তার শহীদ হুরমত আলী ভবনে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ তলায় অনুমোদন ছাড়াই লাইফওয়ে বাংলাদেশ নামের একটি মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। স্বাধীন প্রধান নামে গাজীপুরের এক ভুক্তভোগী জনকণ্ঠকে জানান, থাকা-খাওয়ার সুবিধাসহ ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিতে মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি দেয়ার কথা বলে। এরসঙ্গে পণ্য বিক্রির ওপর কমিশনের প্রলোভন দেখিয়ে বেকার তরুণদের আকৃষ্ট করা হয়। তারপর প্রশিক্ষণের কথা বলে তাদের কাছ থেকে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা জামানত নেয়া হয়। সেখানেও একইভাবে বেকার-যুবকদের প্রতারণা করা হয়েছে। গত বুধবার নারায়ণগঞ্জ শহরের অফিসে গিয়ে জানা যায়, গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে অফিসে কোন কর্মকর্তা আসছেন না। প্রায় দুইশ’ জনকে চাকরি দেয়ার নামে ৩০ লাখ টাকা নিয়ে কর্মকর্তারা সটকে পড়েছে। ‘সরকার নতুন একটি কর্মসূচী চালু করেছে, পাঁচ হাজার পঞ্চাশ টাকা জমা দিলেই প্রতি মাসে ৫ থেকে ৯ হাজার টাকা পাওয়া যাবে। আরও পাওয়া যাবে মূল্যবান সামগ্রী। গ্রাহক যত বাড়াবেন, ভাতা তত বেশি পাবেন। আপনাদের পরিবার চালানোর দায়িত্ব আমাদের’- এমন প্রলোভন দেখিয়ে ব্রাহ্মহ্মণবাড়িয়ার ১ হাজার দুই শ’ ৬২ দুস্থ নারীর কাছ থেকে ৬০ লাখের বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে লাইফওয়ে। প্রতারকদের বিদেশ পালানো বন্ধ করা যাচ্ছে না ॥ এমএলএম প্রতারণার বিরুদ্ধে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির সুপারিশসহ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণেই প্রতারকরা দলে দলে নির্বিঘেœ দেশত্যাগের সুযোগ পাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জনসাধারণের সঙ্গে প্রতারণা বন্ধে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা নিয়ে গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি দেশের সব মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি বন্ধের সুপারিশ করে। এ ছাড়া এমএলএম কোম্পানির নামে প্রতারণার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশও করে কমিটি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও এমএলএম প্রতারণার বিষয়ে বিশেষ জরুরী পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত, সুপারিশ, বিশেষ নির্দেশ কোন কিছুই কার্যকর হচ্ছে না। ফলে বন্ধ হচ্ছে না এমএলএম প্রতারণা, কাড়ি কাড়ি টাকা লুটে নেয়ার বাণিজ্য। উল্লেখ্য, আইন অনুযায়ী অবস্তুগত বা অলীক পণ্য ও সময়ের ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতে বিপণনযোগ্য হবে এমন পণ্য ও সেবা বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া পিরামিডসদৃশ বিক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে নতুন এমএলএম আইনে।
×