ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রুশো এবং সূর্য

প্রকাশিত: ০৯:১০, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

রুশো এবং সূর্য

অনেক অনেক দিন আগের কথা। তখন শুধু মানুষ না, পশুপাখি, গাছপালা, সূর্য, মেঘ- সবাই কথা বলতে পারত। সেই সময়ে একটা ছোট্ট গ্রামে থাকত রুশো নামে এক ছোট্ট ছেলে। সে থাকত তার বাবা-মা আর ছোট বোন লিয়ার সঙ্গে একটা ছোট্ট বাড়িতে। একদিন সকালে মা কিছু খাবার দিয়ে রুশোকে পাঠালেন তার দাদা-দাদির সঙ্গে দেখা করতে। রুশো বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। দাদা-দাদি এই গ্রামেরই অন্য প্রান্তে থাকতেন। সে সময়ে গ্রামে গাড়ি-ঘোড়া ছিল না তেমন। তাই রুশোকে হেঁটেই যেতে হবে পুরো পথটা। সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল। একটু বেলা হতেই সূর্যের তেজ বাড়তে থাকল। রুশো ঘামতে শুরু করল। প্রথমে অল্প অল্প কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু একটু পর তার খুব বেশি কষ্ট হতে লাগল। পুরো জামাটা ঘেমে ভিজে গেল। তাকে দেখে একটা দেবদারু গাছের ডালে বসা একটা পাখি বলল, এই রুশো! তুমি একদম ঘেমে গেছ যে! অবশ্য যা গরম! সূর্যের তাপে আমি উড়তেই পারছি না। একটু খাবার আনতে যাব, তা যেতেই পারছি না। ডানাগুলো পুড়ে যাচ্ছে একদম। এই সূর্যটার যে কেন এমন তাপ! রুশো পাখিটাকে বলল, একদম ঠিক বলেছ। সূর্যটার জন্য কোন কাজ ঠিক করে করা যায় না। সব কাজ কঠিন হয় যায়। সেই সময়ে ঝোপ থেকে একটা বেগুনি ফুল মন খারাপ গলায় বলল, আর বোলো না, সূর্যের তাপে আমার পাপড়িগুলো একদম ঝলসে যাচ্ছে। এমন সুন্দর পাপড়িগুলো বুঝি নেতিয়ে শুকিয়েই যাবে! রুশো তখন একটু ভেবে বলল, সূর্যের জন্য দেখি সবারই খুব অসুবিধে হচ্ছে। এই সূর্যটার তাহলে কী দরকার রোজ রোজ উঠে এমন সবাইকে বিপদে ফেলার? ওকে আমাদের বলা উচিত, ওর জন্য অসুবিধা হচ্ছে আমাদের। ফুল আর পাখি সায় দিল। সেই সঙ্গে আশপাশের গাছপালা, বাতাস সবাই একমত হলো। সবাই মিলে ঠিক করল, তারা সূর্যকে ডেকে বলবে, সে যেন আর না ওঠে। সে উঠলে সবার খুব অসুবিধা হচ্ছে। সবাই মিলে চেঁচামেচি করে সূর্যকে ডাকতে শুরু করল। সূর্য সবার চেঁচামেচি শুনে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে গো তোমাদের? অমন চেঁচাচ্ছ কেন? রুশো তখন সবার হয়ে বলল, তোমার জন্য আমাদের কাজকর্মে বড্ড অসুবিধা হচ্ছে সূর্য। তুমি না উঠলেই পার। তুমি উঠলেই সবার এত এত ঝামেলা হয়। সূর্য তার কথা শুনে হেসে ফেলল। বলল, আমি না উঠলে যে তোমরা বেঁচেই থাকতে পারবে না গো ছোট্ট ছেলে। রুশো বলল, ইশ! কে বলেছে তোমাকে? আমরা আগুন দিয়ে বাতি জ্বালিয়ে নেব। তোমার আলো ছাড়াও আমাদের চলবে। সূর্য হেসে বলল, চলবে না। তারপর একটু ভেবে বলল, আচ্ছা বেশ। আমি কিছুদিনের জন্য ঘুমাতে চলে যাচ্ছি। তোমরা দেখ, থাকতে পার কিনা। সবাই তো খুব খুশি। সূর্য চলে গেল। পুরো গ্রাম অন্ধকার হয়ে গেল। তবে তাতে কার অসুবিধা হলো না। মাথার ওপর থালার মতো বিশাল রুপালি চাঁদ পুরো গ্রামে স্নিগ্ধ একটা আলো ছড়িয়ে রাখল। প্রথমে সবাই খুব খুশি হলো। আলো একটু কম হলেও তারা ঠিকই চাঁদের আলো আর বাতি দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে পারে। এখন আর গরম নেই গ্রামে। কেউ ঘামে না। পাখিদের ডানা পুড়ে যায় না। ফুলের পাপড়ি শুকিয়ে যায় না। সবাই খুশি। কিন্তু দুই-তিন দিন পরেই শুরু হলো বিপত্তি। সূর্যের আলোর অভাবে গাছরা খাবার তৈরি করতে পারে না। যতই পানি দেয়া হোক, সূর্যের আলো ছাড়া এই পানি কোন কাজেই আসে না তাদের। ফুলেরা সবাই নেতিয়ে পড়তে শুরু করল। ফলমূল, শস্য- সব নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করল। সূর্যের আলোর অভাবে মানুষ এবং পশুপাখিরা অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করল। তখন রুশো বুঝতে পারল, সূর্য ঠিকই বলেছিল। তাকে ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব না পৃথিবীতে। রুশো তখন আবার চিৎকার করে সূর্যকে ডাকল। বলল, আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পেরেছি সূর্য। তোমাকে ছাড়া সত্যিই আমরা কেউ ভাল থাকি না। কেউ চলতে পারি না। তুমি ফিরে এসো দয়া করে। আস্তে আস্তে পাহাড়ের পেছন থেকে সূর্য উঠল আকাশে। হাসিমুখে সূর্য বলল, পৃথিবীতে প্রত্যেকটা জিনিসই গুরুত্বপূর্ণ, রুশো। কোন কিছুই অপ্রয়োজনীয় নয়। খালি চোখে যাকে দেখে তোমার অপ্রয়োজনীয় বা ক্ষতিকর মনে হয়, আসলে সেও কোন না কোনভাবে পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে যাচ্ছে। তাই আমাদের উচিত পৃথিবীর প্রত্যেকটা জিনিসকেই ভাল রাখা, তার নিজের পরিবেশে নিজের মতো থাকতে দেয়া। রুশো বলল, হ্যাঁ সূর্য, আমি খুব ভাল করেই সেটা বুঝতে পেরেছি। এরপর থেকে আমি না বুঝে কাউকে আর অপ্রয়োজনীয় ভাবব না।
×