ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চরাঞ্চলে ভূমিহীন লোকমানের বাতিঘর

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 চরাঞ্চলে ভূমিহীন লোকমানের বাতিঘর

শিশু শিক্ষার্থীরা কেউ লোকমানকে দাদু, কেউ চাচা আবার কেউ ভাইয়া ডাকে। লেখার ব্ল্যাকবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করেন ঘরের কাঠের দরজা। এভাবেই ভূমিহীন লোকমান আলী শিক্ষা দিচ্ছেন তিস্তা চরের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের। শুধু পড়াচ্ছে তা কিন্তু নয়। নিজের সাধ্যমতো গরিব শিশু শিক্ষার্থীদের খাতা, কলম, মুখরোচক খাবার ও কখনও পোশাকও কিনে দিচ্ছেন নিজের টাকায়। স্বল্প শিক্ষিত লোকমানের এরূপ কার্যক্রমে মুগ্ধ ও অভিভূত তিস্তা চরাঞ্চলের মানুষ। লোকমান এখন গ্রামটির ‘আলোর বাতিঘরে পরিণত হয়েছেন। জানা যায়, লোকমান একবার দুইবার নয়, তিস্তার গ্রাসে পাঁচবার বসতভিটা হারিয়েছেন। বার বার হয়েছেন নিঃস্ব, রিক্ত ও ভূমিহীন। এরপরও মনোবল হারাননি। মাদুর বিছিয়ে চার ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছেন। পাশাপাশি অন্যের সন্তানদের শিক্ষা দিতে চরাঞ্চলের ছেলে-মেয়েদের বিনামূল্যে পড়িয়ে মানুষের মতো মানুষ গড়ার কাজে সহায়তা করে চলেছেন। লোকমান আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের তিস্তা নদীর তীর বারঘড়িয়া আদর্শপাড়া গ্রামের আবদার আলীর একমাত্র ছেলে। ছোটবেলা থেকেই প্রাচুর্যের মাঝে বড় হয় লোকমান। ১৯৯২ সালে তিস্তার হিংস্র থাবায় নদী গর্ভে বিলীন হয় যায় লোকমানের বাবার রেখে যাওয়া বসতভিটাসহ সব সম্পত্তি। ভূমিহীন হয়ে পড়েন তিনি। তাকে আশ্রয় নিতে হয় অন্যের জমিতে। একবার নয় কয়েক বছরের মধ্যে টানা পাঁচবার ভিটেবাড়ি সরাতে হয় তার। শেষ পর্যন্ত বারঘড়িয়া আদর্শপাড়ায় মামার দেয়া মাত্র চার শতাংশ জমিতে বসবাস শুরু করেন। সম্পদহানির দুঃচিন্তায় কয়েক বছর পর হঠাৎ তার বাবার মৃত্যু হয়। পুরো সংসারের দায়িত্ব পড়ে লোকমানের কাঁধে। ১৯৯৬ সালে অভাবের তাড়নায় স্ত্রী লোকমান ও তার ৪ সন্তানকে ফেলে অন্যের ঘরে চলে যায়। সেই থেকে চার সন্তান ও মা নবিয়ন নেছাকে নিয়ে লোকমানেরও নতুন জীবন সংগ্রাম শুরু হয়। এক বেলা চা ও এক বেলা ডাল-ভাত খেয়ে অভাবের সঙ্গে লড়াই করে চার সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নিজে না খেয়ে থাকলেও প্রতিবেশীদের মুখে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। দীর্ঘ সংগ্রামের এ জীবনে এখন তার একমাত্র মেয়ে কলেজের অধ্যাপিকা, বড় ছেলে এমবিবিএস চিকিৎসক। সদ্য বিসিএস স্বাস্থ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন। সরকারী হাসপাতালে মানব সেবায় যোগদানের অপেক্ষায়। মেঝ ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সমাপ্ত করেছে। সে বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছোট ছেলে স্নাতক শাখায় অধ্যয়ন করছেন। কষ্টেভরা জীবনে নিজের সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এতেই ক্ষান্ত হননি লোকমান। অন্যের ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত করে মানুষ করতে তিস্তার চরে বিনামূল্যে শিক্ষা দিতে স্কুল খুলে বসেছেন। সেখানে চরাঞ্চলের শিশুদের বিনামূল্যে সকাল বিকেল পড়াচ্ছেন তিনি। এজন্য বাড়ির একটি ঘরকে পাঠশালা বানিয়ে মাদুর বা চাটাই বিছিয়ে পরম যত্নে পড়াচ্ছেন তিনি। তার ছাত্রছাত্রী সংখ্যা এমনি প্রায় ৭০ জন। লোকমান বলেন, জীবনে শেষ বলে কিছু নেই। শেষ থেকেই শুরু করতে হয়। কষ্ট জীবনের একটা অংশ বা পাঠ মাত্র। কষ্ট না করলে জীবন রঙিন হয় না। শত কষ্টের মাঝেও অর্থাভাবে নিজের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হতে দেইনি। নিজের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছি। তাই চরাঞ্চলের শিশুরা যেন অর্থের অভাবে ঝরে না পড়ে। সেজন্য নিজ উদ্যোগে তাদের শিক্ষা দিচ্ছি। সেখানে বিনামূল্যে ও বিনা পারিশ্রমিকে প্রায় ১০ বছর ধরে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। এ প্রচেষ্টার একটি লক্ষ্য যাতে চরাঞ্চলের ছিন্নমূল পরিবারের শিশুরা লেখাপড়া শিখে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। লেখাপড়ায় আগ্রহী হয়। লোকমান আরও বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যালয়ের ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে সকাল ও বিকেলে দুই শিফটে প্রায় ৭০ শিক্ষার্থী তার অবৈতনিক কোচিংয়ে লেখাপড়া করছে। লোকমান আলী আগে মাদুর বিক্রি করে সংসার স্কুল চালাত। এখন তাকে আর মাদুর বিক্রি করতে হয় না। চিকিৎসক সন্তানের আয়ের একটি অংশ দিয়ে সাধ্যমতো স্কুলের শিশু শিক্ষার্থীদের সাহায্যের চেষ্টা করি। গরিব শিক্ষার্থীদের খাতা কলম কিনে দেয়ার পাশাপাশি পোশাকও কিনে দিয়ে থাকেন সাধ্যমতো। মূলত সুবিধাবঞ্চিত ছিন্নমূল পরিবারের শিশুদের সুন্দর শৈশব ও কৈশোর গড়ে তুলতে এমন উদ্যোগ তার। নিজের সন্তানের মতই পুরো গ্রামের শিশুদের আলোকিত করতে চান লোকমান আলী। এ জন্য মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অবৈতনিক এ বিদ্যালয়টি চালিয়ে যেতে চান তিনি। লোকমান আলীর শিক্ষার্থী নাদিয়া সুলতানা নিপু, জান্নাতি ও সুমাইয়া জানায়, কোন টাকা ছাড়াই পড়ার সুযোগ পেয়ে সময়মতো স্কুলে উপস্থিত হয় তারা। খাতা কলম বা পোশাকই নয়, ক্ষিদে লাগার কথা শুনলেই ঘরে যা থাকে খেতে দেন লোকমান দাদু। লোকমান আলীর বৃদ্ধ মা নবিয়ন নেছা বলেন, অনেক দিন নিজের খাবার অন্যকে দিয়ে পানি খেয়ে রাত কাটিয়েছে লোকমান। অভাবের তাড়নায় যে ঘর ছেড়ে আমার ছেলের বউ পালিয়েছে, সেই ঘর আজ গ্রামের শিশুদের কোলাহলে মুখরিত। গ্রামজুড়ে সন্তানের প্রশংসা শুনে মা হিসেবে নিজেকে খুব গৌরবান্বিত মনে করেন নবিয়ন নেছা। ওই গ্রামের কলেজ শিক্ষক মোঃ রবিউল আলম জানান, লোকমান আলীর মতো সাদা মনের মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তার মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। তবুও চার সন্তানকে মানুষ করার পাশাপাশি গ্রামের শিশুদের শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করে গ্রামজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। সমাজের শিক্ষিত ও বিত্তবানরা যা করতে পারেননি, অর্ধশিক্ষিত ও ভূমিহীন এ লোকমান আলী তা সম্ভব করে উচ্চশিক্ষিত ও বিত্তবানদের অবাক করে দিয়েছেন। দক্ষিণ বালাপাড়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মোঃ আবদুল বাতেন ফারুক বলেন, না খেয়ে থাকলেও লোকমান কারও সাহায্য গ্রহণ করেন না। তবে পুরস্কারস্বরূপ তার মেধাবী চার সন্তানকে ফরম পূরণসহ সব বিষয়ে ছাড় দেয়া হতো। অন্যের জমিতে আশ্রিত থেকে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে অন্যের সন্তানকে বিনা বেতনে পাঠদান করিয়ে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন তিনি। মহিষখোচা স্কুল এ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ শরওয়ার আলম জানান, লোকমান আলী একজন সহজ সরল সাদা মনের মানুষ। চরাঞ্চলে শিক্ষার বাতিঘর জ্বালিয়েছেন। সমাজ এর সুফল একদিন পাবে। মহিষখোচা ইউপি চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন চৌধুরী জানান, মাঝে মধ্যে না খেয়ে থাকত লোকমান আলী। সাহায্যের জন্য সরকারী সহায়তা পাঠানো হতো। তিনি গ্রহণ না করে পাশের দুস্থ প্রতিবেশীকে দিতে বলতেন। এমন স্বার্থহীন ও সাদা মনের মানুষ এ এলাকায় বিরল। -জাহাঙ্গীর আলম শাহীন, লালমনিরহাট থেকে
×