ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশাল নগরীর দুস্থ পরিবারের শিক্ষার্থীরা সরকারের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

  বরিশাল নগরীর দুস্থ পরিবারের শিক্ষার্থীরা সরকারের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ নতুন বছরের প্রথমদিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন, শ্রেণীকক্ষে বিস্কুট বিতরণ, শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করতে উপ-বৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি এবং আসন্ন নতুন বছর থেকে শিক্ষার্থীদের স্কুল ড্রেস বিতরণসহ দেশের প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মানোন্নয়ে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। বরিশাল নগরীর ২২ নম্বর ওয়ার্ডের একমাত্র রুস্তুম আলী তালুকদার শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দিন দিন শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীরা সরকারের উল্লেখিত মহতী উদ্যোগের কোন সুযোগ সুবিধাই ভোগ করতে পারছে না। সরকারের এসব সুযোগ সুবিধা পেতে স্কুল কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট দফতরের উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে দীর্ঘদিন থেকে ধর্ণা দিয়েও কোন সুফল পাননি। শুধু শিশু শিক্ষার্থীরাই নয়; শিক্ষক হিসেবেও এ স্কুলে যারা কর্মরত রয়েছেন তারাও পাচ্ছেন না সরকারী বেতন-ভাতা। মাস শেষে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতার কাছ থেকে পাওয়া নাম মাত্র সম্মানি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে শিক্ষকদের। সরকারের সুযোগ সুবিধার অভাবে দিন দিন জনপ্রিয়তা হারাতে বসেছে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ৩০টি ওয়ার্ডের প্রায় প্রতিটিতে রয়েছে একটি করে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। কোন কোন ওয়ার্ডে দুটি স্কুলও রয়েছে। কিন্তু একমাত্র ২২ নম্বর ওয়ার্ড যেখানে ছিল না কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়। একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকলেও সেখানে নেই প্রাথমিক স্তর। অথচ শহর থেকে অদূরে বর্ধিত এলাকা নিয়ে গঠিত জনবহুল ২২ নম্বর ওয়ার্ডে রয়েছে অনেক সুবিধাবঞ্চিত এবং দুস্থ পবিবার। যাদের সন্তানদের প্রাথমিক স্তরে শিক্ষায় শিক্ষিত করার শেষ ভরসা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২২ সহ¯্রাধিক জনসংখ্যার ওই ওয়ার্ডটিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোন ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিবছর প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিল অসংখ্য শিশু। বিষয়টি মাথায় রেখে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি ও সরকারের প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন সাবেক কাউন্সিলর মোঃ শহিদুল ইসলাম তালুকদার। সে অনুযায়ী ২০১২ সালে ওয়ার্ডের কাজীপাড়া আব্দুল আজিজ সড়কে ১১ শতক জমিতে তিনি রুস্তুম আলী তালুকদার শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করেন। টিন শেডের ওই বিদ্যালয়ে প্রাক প্রাথমিক থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান করানো হয়। প্রথম বছর ৩১৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হয় বিদ্যালয়টির পথচলা। এরপর বছর বছর বাড়তে থাকে স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীর সংখ্যা। মুহূর্তেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে স্কুলটি। কিন্তু সেই জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে গিয়ে বর্তমানে হিমশিম খেতে হচ্ছে স্কুল কর্তৃপক্ষকে। নগরীর কাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা আলমগীর হোসেন বলেন, ২২ নম্বর ওয়ার্ডটিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দাবি ছিল দীর্ঘবছর ধরে। কেননা ওয়ার্ডটিতে কোন সরকারী বা বেসরকারী স্কুল ছিল না। এমনকি ওয়ার্ডের ২/৩ কিলোমিটারের মধ্যেও কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। যাও আছে সেখানে যেতে হলে মহাসড়ক পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। এজন্য ইতিপূর্বে অনেক দুর্ঘটনাও ঘটেছে। তাই নতুন এই স্কুলটির গুরুত্ব অনেক বেশি। তাইজুল ইসলাম নামের এক অভিভাবক বলেন, স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যা কম কিন্তু তার পরেও তারা যেভাবে ছেলে- মেয়েদের পাঠদান করাচ্ছে তা সন্তোষজনক। তবে সমস্যা হচ্ছে সুযোগ সুবিধার। এ স্কুল থেকে আমাদের সন্তানরা কোন সুযোগ সুবিধাই পাচ্ছে না। যেখানে সরকারী স্কুলে শিক্ষার্থীরা বছরের শুরুতে নতুন বই, দুপুরের টিফিন (বিস্কুট) এবং উপবৃত্তি পাচ্ছে সেখানে বেসরকারী এ স্কুলে কোন সরকারী সুযোগ সুবিধাই পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটির মানোন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে স্কুলটিতে সরকারী সুযোগ সুবিধা প্রধান করা জরুরী বলে মনে করছেন তিনি। সংশ্লিষ্ট স্কুল সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর রুস্তুম আলী তালুকদার শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন-পুরাতন মিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল তিন শ’র অধিক। কিন্তু সরকারের সুযোগ সুবিধার অভাবে বর্তমানে তা কমে গিয়ে ২৬৫ জনে দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে স্কুল থেকে সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিবে ২৩ জন। এছাড়া চতুর্থ শ্রেণীতে ৩৫ জন, তৃতীয় শ্রেণীতে ৬০ জন, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ৬৫ জন, প্রথম শ্রেণীতে ৩৮ জন ও প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪২ জন। এরা সবাই ২২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ৩০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন করে শিক্ষক থাকবেন। পাশাপাশি প্রাক-প্রাথমিকের জন্য থাকবে আলাদা শিক্ষকের ব্যবস্থা। কিন্তু রুস্তুম আলী তালুকদার শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হলেও শিক্ষকের সংখ্যা মাত্র পাঁচজন। যারমধ্যে একজন প্রধানশিক্ষক, একজন সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং বাকি তিনজন সহকারী শিক্ষক। তবে প্রাক-প্রাথমিকের জন্য এখানে নেই কোন আলাদা শিক্ষকের ব্যবস্থা। বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক আসাদুজ্জামান সুজন বলেন, আমাদের সন্তানেরা যেখানে ভাল নেই, সেখানে আমাদের শিক্ষকদের ভাল থাকার সুযোগ কোথায়। নানা সঙ্কটের মধ্যদিয়ে আমরা প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। একমাত্র বস্তুনিষ্ঠ পাঠদান ছাড়া সরকারী কোন সুযোগ সুবিধাই আমরা শিক্ষার্থীদের দিতে পারছি না। তিনি আরও বলেন, আমাদের স্কুলে যেসব শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করছে তারা সবাই দুস্থ এবং অসহায় পরিবারের সন্তান। যে কারণে তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে বেতন বা পরীক্ষার ফিও আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। তার মধ্যে মাস শেষে আমরা পাঁচজন শিক্ষক এবং একজন এমএলএসএস’র ভেতন ভাতার বিষয় রয়েছে। প্রতিমাসে আমরা প্রতিজন শিক্ষক দুই হাজার টাকা করে সম্মানি পাচ্ছি। যা স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা তার নিজের পকেট থেকে দিচ্ছেন। সুযোগ সুবিধা না থাকার বিষয়ে প্রধানশিক্ষক বলেন, আমাদের স্কুল সরকারী তালিকায় নেই তাই শিক্ষা অফিস থেকে কোন ধরনের সুযোগ সুবিধাও আমাদের দেয়া হচ্ছে না। ৭/৮ মাস পূর্বে একবার সরকারী বিস্কুটের জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু তিনি নিরুপায় বলে আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছেন। সরকারী তালিকাভুক্ত না হওয়া পর্যন্ত কোন সুযোগ সুবিধা দেয়া যাবে না বলে সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে জানানো হয়েছে। স্কুলটি জাতীয়করণের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে স্কুলের জমির দলিল, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের তালিকাসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেয়ে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে বিষয়ে পরবর্তীতে আর কিছুই জানানো হয়নি। আদৌ স্কুলটি জাতীয়করণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র প্রেরণ করা হয়েছে কিনা তাও বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট স্কুলের শিক্ষকরা। রুস্তুম আলী তালুকদার শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মোঃ শহিদুল ইসলাম তালুকদার বলেন, নিজের স্বার্থে নয়, ওয়ার্ডবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে আমি স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। এজন্য কারোর কাছ থেকে কোন সাহায্য-সহযোগিতা নেয়া হয়নি। এখনও স্কুলটির পেছনে প্রতি মাসে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। বিশেষ করে মাস শেষে বিদ্যুত বিল, পাঁচজন শিক্ষক এবং একজন এমএলএসএস’র সম্মানী, আপ্যায়ন খরচ ইত্যাদি। তিনি আরও বলেন, এ স্কুলের শিক্ষার্থীরা নিতান্তই গরিব পরিবারের হওয়ায় তারা পরীক্ষার ফি বা বেতন ভাতা দিতে পারছে না। যে কারণে তার নিজের পকেট থেকেই সব ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। যে যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসলে রুস্তুম আলী তালুকদার শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়টি টিকে থাকবে। নতুবা যেকোন সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে অসহায় পরিবারের সন্তানদের লেখা-পড়ার একমাত্র ভরসাস্থল এ বিদ্যালয়টি। তাই জরুরী ভিত্তিতে স্কুলটি সরকারীকরণের মাধ্যমে সুযোগ সুবিধা প্রদানের জন্য বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষানুরাগী শহিদুল ইসলাম তালুকদার সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, সদর আসনের এমপি, জেলা প্রশাসক ও শিক্ষা কর্মকর্তার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
×