ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০৮:৫২, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 বাংলাদেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও শেখ হাসিনা

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব সময় বলতেন- ‘স্বাধীনতা অর্জন করা কঠিন, তার চেয়ে কঠিন রক্ষা করা। জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি না হলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে ।’ ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের সহায়তায় সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যা করে বাঙালীর অর্থনৈতিক মুক্তির পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। ২১ বছর বাংলাদেশ চলেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, পাকিস্তানী রাজনীতির ভাব ধারায়। রাজনীতি হয়েছে কলুষিত, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বঞ্চিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার, হাজার বছরের কৃষ্টি, ঐতিহ্য সংস্কৃতির ধারা থেকে বঞ্চিত। ১৯৮১ সালের ১৭ মে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বুকের ভেতর কষ্টের পাথর বেঁধে পা রেখেছিলেন তাঁরই স্নেহময়ী প্রাণপ্রিয় পিতা-মাতা, ভাই-ভ্রাতৃবধূসহ নিকটাত্মীয়ের রক্তে ভেজা বাংলার মাটিতে। নিজের স্বামী, দুটো শিশু সন্তান- সংসারের অবশিষ্ট সুখটুকু পেছনে ফেলে বাবার মতোই কোন পিছুটান না রেখে কেবল বাবার অবশিষ্ট কাজটুকু সম্পন্ন করতে। পঁচাত্তরে খুনীরা তখনও তৎপর- সব জায়গায় ওত পেতে আছে। এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকন্যা পিতার পথ ধরে জীবনের সকল ঝুঁকি নিয়ে শুরু করলেন বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রাম। সে দিন ঝড়বৃষ্টিতে বিপন্ন ঢাকা মহানগরে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সব কিছু হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে ফিরে এসেছি। বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ^াসী আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের সঙ্গে থাকতে চাই’। সেদিন যদি তিনি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন না করতেন তাহলে এতদিনে দেশ পুরোপুরি পাকিস্তানের মতো স্বৈরাচারী, বিশৃঙ্খল, সাম্প্রদায়িক, জঙ্গী রাষ্ট্রে পরিণত হতো। শেখ হাসিনা সে অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছেন এবং বাংলার মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে নতুন করে অভিসিক্ত করেছেন। ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তিপাক’- ’৮১ থেকে ৯০ পর্যন্ত দীর্ঘ আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন শেখ হাসিনা এবং প্রধান শক্তি ছিল তাঁর দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সঙ্গে সহযোগী সংগঠনসমূহ। ১৯৯১ সালের কারচুপির নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা হয়। শুরু হয় আবার নতুন করে আন্দোলন সংগ্রাম। এর মধ্যে বাংলাদেশের নাম আর পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন না করে পুরোপুরি পাকিস্তানের রাজনীতি, কৃষ্টি-সংস্কৃতি জায়গা করে নেয় লক্ষ শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলার মাটিতে। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বিরোধী হোতা গোলাম আযমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া হয়। রাজনীতিতে দাপুটে অবস্থান করে নেয় ’৭১-৭৫ এর খুনীরা। প্রচন্ড প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আন্দোলন সংগ্রাম করে দেশের মানুষের সমর্থন নিয়ে ’৯৬-এর ভোটারবিহীন নির্বাচন বাতিল করে সুদীর্ঘ ২১ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিনিধি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। তখন সরকার রাজনীতিতে সমাজে স্বাধীনতা বিরোধীদের শক্ত অবস্থান। এর মধ্যেই দেশে-বিদেশে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে বাংলাদেশকে একদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় ফিরিয়ে আনেন অন্যদিকে বিশে^র দরবারে শান্তিকামী নেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ’৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত নতুন সোনালি যুগের সূচনা হয় দেশের অর্থনৈতিক, উৎপাদন, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-কৃষিসহ সকল ক্ষেত্রে। এলো ২০০১-এর জাতীয় নির্বাচন- শুরু হলো জাতীয়-আন্তর্জাতিক যড়যন্ত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খোদ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন চলে এলেন ঢাকায়। বাংলাদেশকে গ্যাস রফতানি করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশের স্বার্থ বিকিয়ে কোন কাজ করবেন না। বললেন, ‘দেশ বিক্রি করে আমি প্রধানমন্ত্রী হতে চাই না।’ জাতীয়-আন্তর্জাতিক চক্র ২০০১-এর নির্বাচনে জনপ্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রিয় দল আওয়াগী লীগকে হারিয়ে দিল কৌশলে মোট ভোটের হিসেবে জয়যুক্ত হলেও। নেমে এলো আবার আওয়ামী নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন-হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, বাড়ি ছাড়া। ইতিহাসের জঘন্যতম ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতো নারকীয় হত্যাকা- শেখ হাসিনাকে হত্যার গভীর ষড়যন্ত্র- আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার পরিকল্পনা নিয়ে। শেখ হাসিনাকে ২১ বার হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যাত্রাকে চিরতরে স্তব্ধ করার জন্য। ২০০১-০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নৈরাজ্য, অনাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন শেখ হাসিনা। ২০০৭-এর মে মাসে শেখ হাসিনাকে ইংল্যান্ডের হিথরো এয়ারপোর্ট তৎকালীন তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশে ফেরার জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। শেখ হাসিনা সেদিন যদি নিজের চিন্তা, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, সাহস এবং ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফিরে না আসতেন তবে বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রের মুখ দেখত কিনা দেশবাসীয় আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে। দেশে ফেরার পরই বঙ্গবন্ধু কন্যাকে অন্যায়ভাবে কারাগারে নিক্ষেপ করা হলো দেশকে বিরাজনীতিকরণের গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে। জনতার উত্তাল আন্দোলনে শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ২০০৮ এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে দেশের মানুষ বিপুল ভোটে নির্বাচিত করে শেখ হাসিনা এবং তাঁর দলকে। তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে ঢাকার মাটি ছুঁয়ে যে কথা দিয়েছিলেন তা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছেন। একইভাবে সেদিন ঢাকা শহরে লাখ লাখ কর্মী যে শপথ নিয়েছিলেন যে, দেশের সকল পরিস্থিতিতেই তাদের মায়ের মতো বোনের মতো নেত্রীকে আগলে রাখবেন- সেটিও তারা প্রমাণ করেছেন। আজকে বাংলাদেশে বারবার সঙ্কটাপন্ন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আবহে, হাজার বছরের বাঙালী কৃষ্টি-সংস্কৃতির অবগাহনে ফিরে পেয়েছে বাংলাদেশের প্রাণ। বাংলাদেশ আজকে বিশে^র বিস্ময়। বিশে^র দরবারে উন্নয়নের রোল মডেল। গত ২০১৮ সালে স্যাটেলাইট-১ এর উৎক্ষেপণের মাধ্যমে আকাশ বিজয় করেছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আকাশ-সমুদ্র-সীমান্ত বিজয় পূর্ণ করেছে। গত ২০১৭ সালে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে সকল শর্ত পূরণ করে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করেছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন প্রায় ২০০০ ডলার। অর্থনৈতিক অনেক সূচকে বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় এগিয়ে। প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের উপরে। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ধাপে ধাপে পূরণ হয়ে যাচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ বা রূপকল্প ২০২১-এর সকল কর্মসূচী। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, বিদ্যুত, যোগাযোগসহ সকল ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে জাজ¦ল্যমান পরিবর্তন। দারিদ্র্য হ্রাস, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণ, আঞ্চলিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ এসব কারণেই বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে বিশেষ অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ যোগাযোগ ব্যবস্থায় দৃশ্যমান হচ্ছে আমূল পরিবর্তন। শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে এবং বাংলাদেশের উন্নয়নে অসাধারণ ভূমিকার জন্য অর্জন করছেন ৩৭টি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে হয়েছেন মাদার অব হিউম্যানিটি। বঙ্গবন্ধু বাঙালীকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, স্বাধীনতা পরবর্র্তী সঙ্কট নিরসন করে গেছেন, দেশের সকল ক্ষেত্রে শক্ত ভিত করে গেছেন যার ওপরই হচ্ছে সকল উন্নয়ন। তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পুনরায় গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ে তুলেছেন, বাস্তবায়ন করে চলেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অর্থনৈতিক মুক্তির পথ ধরে সার্থক করে তুলছেন স্বাধীনতা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করে তার বাস্তবায়ন করছেন। সম্প্রতি ছাত্রলীগের প্রধান নেতৃদ্বয়কে পরিবর্তন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যুবলীগসহ সকল অন্যায়কারী অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে শক্ত অভিযান শুরু করেছেন। দেশের সকল ক্ষেত্রে নির্মোহভাবে এ দৃষ্টান্তের প্রতিফলন ঘটবে এবং অব্যাহত থাকবে এটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা। বঙ্গবন্ধু কন্যার দুর্নীতিবিরোধী যুদ্ধে দেশের মানুষ পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে এবং অভিনন্দন জানিয়েছে। সঙ্গে দ্রুত সুশাসন বাস্তবায়ন করতে হবে। সত্যিকার বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হতে হলে তাঁর আদর্শ অনুসরণ করতে হবে ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক জীবনে। চলমান বিশ^ রাজনীতির তান্ডবের সময় শক্তভাবে শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়াতে হবে তবেই চূড়ান্ত মুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছবে বাংলাদেশ এবং বাঙালী জাতি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এখন বিশে^র অন্যতম সেরা, সৎ, যোগ্য, মেধাবী, কর্মঠ, মানবতাবাদী, গণতান্ত্রিক, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন (ভিশনারি) নেতা। গণতন্ত্রের মানসকন্যা এখন গণতন্ত্রের মূর্তপ্রতীক। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন, গণতন্ত্রের এ ধারা অব্যাহত রাখার জন্য, দেশকে একটি সম্পূর্ণ কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত করার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য আজকে দেশের মানুষের সামনে শেখ হাসিনার কোন বিকল্প নেই। সকল বিবেচনায় পরিস্থিতিটা এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যে, শেখ হাসিনা বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বিক কল্যাণে সকল বিষয়ে দেশের মানুষের গভীরভাবে অনুধাবন করা এখন জরুরী। শুভ জন্মদিন শেখ হাসিনা। আপনার দীর্ঘায়ু এবং সুস্থ জীবন কামনা করি। লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×