ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত

সীমান্তচূর্ণি সাহিত্যের প্রবাহ

প্রকাশিত: ১২:৪৪, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

সীমান্তচূর্ণি সাহিত্যের প্রবাহ

তৃতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সংখ্যা জলধি আমার হাতে। এবারের বিষয় ‘দু’পার বাংলার বই পাঠ-পর্যালোচনা’। সম্পাদক নাহিদা আশরাফী এই পত্রিকাটি নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পাদনা করছেন। তাঁর নানা পরিকল্পনা এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের খবর আমি রাখি। এ কারণেই কিছুটা পূর্বানুভূতি আমার লেখাকে প্রভাবিত করবে, আমি জানি। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়াই বিচ্ছিন্নতায় থাকে না। সামগ্রিকতা একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তি। তাকে অবজ্ঞা করব না, বলা বাহুল্য। লিটল ম্যাগাজিনের বৈশিষ্ট্যই হলো যে তা আভান গার্ড অর্থাৎ অগ্রসর প্রহরীর কাজ করবে। এটি আকারে ছোট হবে, গভীর হবে, সচরাচর অব্যবসায়িক এবং চলতি ধারাকে অতিক্রম করে যাবে। এটা আমার কথা নয়। বিদেশী ব্যাখ্যা এরকমই। ১৮৮০ থেকে শুরু করে বিংশ শতকের পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষত মার্কিন মুলুক এবং ইংল্যান্ড এই লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল। ফরাসি সিম্বোলিক কবি এবং অঙ্কন শিল্পীদের প্রভাব এই আন্দোলনকে দিশা দেখিয়েছিল। ১৯২০ সালের জার্মান সাহিত্যকেও এই আন্দোলন বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। উল্লেখ্য এই যে, এই উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনকালের শেষ লগ্নে তথা বিভক্ত ভারতবর্ষের উৎপত্তি লগ্ন এমনকি তার বহু পরেও লিটল ম্যাগাজিন অপ্রতিরোধ্য গতি পেয়েছে এবং সেই গতিময়তা দিনে দিনে বিকশিত হচ্ছে পুষ্ট হচ্ছে। জলধি পত্রিকা এই ধারাকে অব্যাহত রেখেছে এবং সেই ধারার বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে এমন কিছু আয়োজন করে চলেছে, যা বাণিজ্যিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিম-লের আওতায় থেকে করাটা দুরূহ। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের আলোচ্য পুস্তকাদি যা দুটি দেশের বিগত বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলোকে সংগ্রহ করা, ক্রস-বর্ডার আলোচকদের কাছে পৌঁছান, ক্রস বর্ডার আলোচনাগুলোকে একত্রিত করা কাজটি যথেষ্ট সময় এবং শ্রমসাপেক্ষ। বৈদ্যুতিক মাধ্যমের যোগাযোগবিপ্লব কাজটিকে অনেকটা সহজ করেছে বটে, তথাপি গোটা বিষয়টাকে ঝাড়াই বাছাই করে দু’মলাটের মধ্যে মুদ্রিত আকারে পেশ করা যথেষ্ট মুনশিয়ানার কাজ, এবং সেই কাজ যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে নির্বাহ করা হয়েছে একথা বলাটা একেবারেই অত্যুক্তি নয়। বরং কিছুটা প্রশংসা অনুক্তই থেকে যায়। আমরা গোটা পত্রিকাটা নিয়ে যদি পর্যালোচনা করি তবে ভারত ও বাংলাদেশের কিছু প্রতিষ্ঠিত ও কিছু অনাবিষ্কৃত প্রতিভার সন্ধান পাব। আমি নিজে ভারতের কিছু সমালোচকদের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছি। এক কথায়, বাংলাদেশের লেখক কবিদের লেখা সম্পর্কে তাদের অনুভূতি বিমুগ্ধতা, বিস্ময় এবং অজানা আবিষ্কারের সমতুল। এখন পুস্তকাদির গমনাগমনের ক্ষেত্রে সীমানা কোন বড় সমস্যা নয়। এছাড়াও ত্বরিত যোগাযোগের মাধ্যমেও কিছু সাহিত্যের আদান-প্রদান ঘটে যাচ্ছে। তথাপি কলকাতায় বসে বাংলা দেশের সাহিত্য সংগ্রহ, যে কোন একটা বিভাগীয় বিপণি থেকে সাবান অথবা পারফিউম কেনার মতো সহজও নয়। এক কথায়, বাংলাদেশের সদ্য প্রকাশিত পুস্তকাদি কলকাতার সমালোচকেরা এইভাবে কোনদিনই পেতেন না, যদি না নাহিদা আশরাফী, জলধি সম্পাদক, বইগুলো পড়া এবং সমালোচনা করার উদ্দেশ্যে তাঁদের করকমলে অর্পণ না করতেন। কাজেই সমালোচনা করার বাধ্যবাধকতায় কলকাতায় যে উপকারটি ঘটল যে তা হলো, কলকাতার সমালোচকেরা বাংলাদেশের, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের লেখা বইগুলো পড়লেন এবং তাঁদের জ্ঞান, চিন্তার গভীরতা এবং সাহিত্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সাহস দেখে মুগ্ধ হলেন। আমি নিজে আমার পরিচিত অন্তত পাঁচজন সমালোচকের সঙ্গে মতবিনিময়ের সুবাদেই এই সিদ্ধান্তে এসেছি এবং এখানে সামান্যতম অতিরঞ্জন করার অবকাশ নেই। সত্য ভাবনাটাই তুলে ধরেছি। দ্বিতীয়ত লেখার আঙ্গিক তথা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াও তথ্যাদির বিচারে পত্রিকাটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এই তথ্যাদির অবতারণা এখানে দুভাবে ঘটেছে। এক, বিভিন্ন আলোচিত লেখকদের সাহিত্য কর্মের উল্লেখনীয় অংশের মাধ্যমে এবং দ্বিতীয়ত সমালোচকদের নিজস্ব জ্ঞানের প্রকাশের মাধ্যমে। একথা বলাই যায় যে আলোচকদের যে বক্তব্যগুলো স্থান পেয়েছে সেগুলো একত্রে একটি তৃতীয় ধারা যোগ করেছে। অর্থাৎ কিনা, এক ভারতের সাহিত্য ধারা, দুই, বাংলাদেশের সাহিত্যধারা এবং তিন সমালোচকদের নিজস্ব প্রতিবেদনের সাহিত্যধারা। আরও উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের সাহিত্য যে কেবল মুক্তিযুদ্ধ তথা একাত্তর বা বাহান্ন কেন্দ্রিক নয় এটা বার বার প্রমাণিত হচ্ছে। আত্ম ও সমাজ দর্শনের নানা আঙ্গিক আমরা লেখাগুলোর মধ্যে পাচ্ছি। ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণের গুরুত্ব সাহিত্যের ওপর সব সময়েই থাকে। সেটাকে নিয়ে রাজনীতিও ঘটনাগুলোকে পাঠক মানসে দীর্ঘ সময় ধরে জিইয়ে রাখে। কিন্তু সেই প্রভাবের বাইরে দাঁড়ালে মানুষ বড্ড এক এবং অভিন্ন। সাতচল্লিশ, দেশভাগ, বাহান্ন, সত্তরের দশক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ভারতের নকশাল আন্দোলন, একাত্তর, বামপন্থার চর্বিত চর্বণ বা যে কোন ধর্মসর্বস্বতা সমস্ত যদি সরিয়ে নেয়া যায় তবে সেখানে ভারত-বাংলাদেশ-তথা সমগ্র বিশ্ব এক এবং অভিন্ন। বেশ কিছু লেখাতে এই বিশ্বজনীনতার আবেদন আমাকে মুগ্ধ করেছে। হয়ত কোথাও কোথাও উল্লিখিত ঘটনাবলী বহিরঙ্গ বা প্রেক্ষাপটকে সমৃদ্ধ করেছে, কিন্তু অন্তরাত্মা থেকে উন্মোচিত হয়েছে সার্বজনীনতার আবেদন। বাংলাদেশ ও ভারত দু’পার বাংলার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী ও সাহিত্যের ছোট কাগজ সব মিলিয়ে মোট পঁয়ষট্টটি বই নিয়ে জলধির পুস্তক পর্যালোচনা সংখ্যাটি প্রকাশ পেয়েছে। দু’পারের মোট বাইশটি কাব্যগ্রন্থ, বারোটি গল্পগ্রন্থ, তেরটি উপন্যাস, ছ’টি প্রবন্ধ, চারটি অনুবাদ গ্রন্থ, একটি আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ও সাতটি লিটলম্যাগ রয়েছে। চারশত পৃষ্ঠায় আলোচনা, পর্যালোচনা ও কোথাও কোথাও সমালোচনার ঠাস বুনোটে পত্রিকাটি পরিপূর্ণ। আমার জানা মতে বাংলা সাহিত্যের লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাসে দু’পার বাংলার সদ্য প্রকাশিত বই নিয়ে এতবড় ক্রস বর্ডার আয়োজন আর হয়নি। পত্রিকাটি আরও একটি আন্দোলনকে সামনে রেখে পথ চলছে যা তার বিষয় বৈচিত্র্যের সঙ্গে ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করেছে বৈকি। প্রায় শুরু থেকেই কাগজটি তার লেখকদের লেখক সম্মানী প্রদান করে আসছে যা ছোট কাগজ হিসেবে এক চ্যালেঞ্জই বটে। সম্মানীর কথা মাথায় রেখে একজন লেখক কখনই লেখেন না কিন্তু লেখার জন্যে সম্মান পেলে, হোক তা যৎসামান্য; তাতে আত্মতৃপ্তি যে যথেষ্টই মেলে তা অস্বীকারের উপায় নেই। গল্প কবিতা প্রবন্ধ, সাহিত্যের ত্রিমাত্রিকতা সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছে জলধি। কোন বিশেষ ধারার প্রতি পক্ষপাতিত্ব নয়, কোন বিশেষ ছক বা মানচিত্রের প্রতিও নয়, জলধি যে ছক সৃষ্ট করেছে তা কেবলই ভূগোল ভাঙার ছক। দেশ নির্বিশেষে নাগরিক অনুভূতির মিলনাত্মক ছক। এই অমোঘ সূত্রে আমিও বিশ্বাসী। আমার দৃষ্টিভঙ্গিও তাই সামগ্রিকতার পক্ষে। কোন বিশেষ লেখা বা কবি-সাহিত্যিকের নাম তাই উল্লেখ করলাম না। কেবল প্রার্থনা করি বিশ্বের সর্বত্র বাংলা ভাষাভাষীদের হাতে জলধি পৌঁছে যাক তার নিত্য নতুন সম্ভার নিয়ে। জনপ্রিয়তার শীর্ষনামে পরিণত হোক এই পত্রিকাটি।
×