ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে মিয়ানমারকে

প্রকাশিত: ১১:০৭, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে মিয়ানমারকে

এম শাহজাহান, নিউইয়র্ক থেকে ॥ সন্ত্রাস ও দুর্নীতি প্রশ্নে বাংলাদেশের জিরো টলারেন্স অবস্থানের কথা আবারও দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস নির্মূলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। এ বিষয়ে কাউকেই ছাড় দেয়ার কোন সুযোগ নেই। এছাড়া রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমিতে নিরাপদ, সম্মানজনক ও স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি করতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বুধবার স্থানীয় সময় বিকেলে কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন আয়োজিত ‘এ কনভারসেশন উইথ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’ শীর্ষক ইন্টারএ্যাকটিভ ডায়ালগে তিনি এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশের উন্নয়ন ভয়ানক চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। এদিকে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সহায়তার যে প্রতিশ্রুতি বিশ্বনেতারা দিয়েছেন তা বাস্তবায়নে তাদের প্রতি জোর আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে স্থানীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে অর্থবহ অংশীদারিত্ব এবং সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। নিউইয়র্কেও স্থানীয় সময় বুধবার দুপুরে জাতিসংঘ সদর দফতরে টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক ফোরামে ‘লিডারস ডায়ালগ অন লোকালাইজিং এসডিজিস’ শীর্ষক সংলাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কো-মডারেটরের দায়িত্ব পালনকালে এ আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের সর্ববৃহৎ বদ্বীপ। যার ফলে জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, পরিবেশ এবং বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পরিকল্পিত নৃশংসতার মাধ্যমে মিয়ানমার সরকার উত্তর রাখাইন রাজ্যেও রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের নিধন করেছে। তারা নৃশংসতা ও সন্ত্রাস থেকে পালিয়েছিল। আমরা মানবিক দিক বিবেচনা করে সীমান্ত খুলে দেই। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বাঙালীর দুঃসহ স্মৃতির কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়া ১০ লাখ বাংলাদেশীর অভিজ্ঞতা থেকে এই মানবিক (রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া) সিদ্ধান্ত আসে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর ছোট বোন শেখ রেহানাসহ নিজের উদ্বাস্তু জীবনের কথাও উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমার ছোট বোন এবং আমি দেশের বাইরে থাকায় সে সময় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই। মিলিটারি স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের সময় ছয় বছর দেশে ফিরতে পারিনি এবং ভারতে উদ্বাস্তু জীবন যাপন করতে হয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ সরকার তার সাধ্যমত মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা এ সঙ্কটের একটি শান্তিপূর্ণ এবং দ্রুত সমাধান চাই। মিয়ানমারে এ সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে এবং মিয়ানমারকেই এ সঙ্কটের সমাধান করতে হবে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধান করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে খুবই সহায়তা করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সবাইকে বাংলাদেশের কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, আপনারা যখন ক্যাম্পে যাবেন এবং মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী এবং স্থানীয় সন্ত্রাসীদের হাতে নির্যাতনের ভয়ানক ঘটনা শুনবেন তখন আপনাদের হৃদয় কেঁপে উঠবে। ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা আপনাদের হৃদয় নাড়িয়ে দেবে এবং আপনারা চাইবেন খুব দ্রুতই যেন তাদের (রোহিঙ্গা) এই কষ্টকর জীবনের সমাপ্তি হয়। বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও চরমপন্থা নির্মূলে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং সফলতার কথাও তুলে ধরেন তিনি। পরে প্রধানমন্ত্রী এক প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন। সেখানে তিনি রোহিঙ্গা সঙ্কট, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক সেক্টর, খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী, নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা হয়েছিল এবং সে আলোচনা এখনও চলমান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এখন সমস্যা হলো, নিরাপত্তাহীনতার কারণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চায় না। তাছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কিছু লোক তাদের ফিরে যেতে নিরুৎসাহিতও করছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৮২ সালে মিয়ানমার তাদের সংবিধান পরিবর্তন করে। সেখানে রোহিঙ্গাদের তাদের নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি এবং তাদের বহিরাগত হিসেবে উল্লেখ করা হয়। শেখ হাসিনা বলেন, জাতিসংঘ এবং অন্যান্য সংগঠন রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করে আসছে। রোহিঙ্গারা যেন তাদের নিজেদের ভূমিতে ফিরে যেতে পারে এবং থাকতে পারে সেজন্য মিয়ানমারের উচিত সে পরিবেশ তৈরি করা। জোরপূর্বক বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক চাপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। মুসলিম উম্মাহ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মক্কায় ওআইসি সম্মেলনে বলেছিলাম-যদি মুসলমান দেশগুলোর মধ্যে কোন সমস্যার সৃষ্টি হয়, তবে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হওয়া উচিত। কিন্তু যে কারণেই হোক এটা হচ্ছে না এবং আপনারা জানেন সমস্যা কোথায়। এসডিজি অর্জনে অর্থবহ অংশীদারিত্বের ওপর গুরুত্বারোপ ॥ টেকসই লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনে স্থানীয় এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে অর্থবহ অংশীদারিত্ব এবং সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এসডিজি বাস্তবায়নে কার্যকর অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা স্থানীয় এবং বৈশ্বিক উভয় পর্যায়ে সমভাবেই প্রয়োজনীয়। জাতিসংঘ সদর দফতরের ট্রাস্টিশিপ কাউন্সিলে বুধবার বিকেলে টেকসই উন্নয়নের (এসডিজি সম্মেলন) ওপর উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ফোরামে ‘লোকালাইজিং দ্য এসডিজিস’ এ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কো-মডারেটরের দায়িত্ব পালনকালে ভাষণে এ কথা বলেন। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচীর প্রশাসক এ্যাচিম স্টেইনার, ইন্টার পার্লামেন্টারিয়ান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট গ্যাবরিয়েলা চ্যুয়েভাস ব্যারন, ইন্দোনেশিয়ার সুরাবায়র মেয়র ত্রি রিসমহারিনি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়কারী মোঃ আবুল কালাম আজাদ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন এবং পররাষ্ট্র সচিব মোঃ শহিদুল হক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। শেখ হাসিনা বলেন, এসডিজি বাস্তবায়নে কার্যকর অংশীদারিত্ব এবং সহযোগিতা স্থানীয় এবং বৈশ্বিক উভয় পর্যায়ে সমভাবে প্রয়োজনীয়। তিনি বলেন, ২০০০ সালে সহ¯্রাব্দের ঘোষণাপত্র এবং ২০১৫ সালে এসডিজি গ্রহণের অনুষ্ঠানের সময় তিনি ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন। এসডিজি হলো মানুষের প্রয়োজন, আকাক্সক্ষা এবং অধিকারের বহিঃপ্রকাশ। শেখ হাসিনা বলেন, দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এসডিজি বাস্তবায়নে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৪০টি সূচক নির্ধারণ করেছে। এর বাইরে ১৭টি লক্ষ্য থেকে ৩৯টি সূচক বাছাই করা হয়েছে। বাকি একটি সূচক জরুরী প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে স্থানীয় প্রশাসন শনাক্ত করবে। তিনি বলেন, এসডিজির সুফল জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে স্থানীয়দের ক্ষমতায়নে ২০৩০ এ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এমডিজির অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এসডিজির লক্ষ্যসমূহকে সম্পৃক্ত করেছি এবং আবার আমাদের ২০২১ সাল থেকে ২০২৫ পর্যন্ত অনুষ্ঠেয় ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও জুড়ে দিয়েছি।
×