ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কলঙ্কিত দায়মুক্তি আইন-১৯৭৫

প্রকাশিত: ০৯:১৩, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

কলঙ্কিত দায়মুক্তি আইন-১৯৭৫

(শেষাংশ) ড. সিদ্দিকীর এ কথা বলার আগ থেকেই সুশীল প্রশাসনে কর্মরত বেশ সংখ্যক সহযোগীর সঙ্গে আমি ও সহযোগীরা জাতি, বিশেষত প্রশাসনের ওপর দায়মুক্তি আইনের অন্যায় অভিঘাত বিষয়ে আলোচনা করেছি। আমি সেই সময়ে প্রশাসন সার্ভিস সমিতির মহাসচিব ছিলাম। কয়েকজন সহকর্মীসহ আমরা সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে সুশীল প্রশাসনের নির্বাহীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সংবিধান অনুযায়ী সকল নাগরিকের আইনের দৃষ্টিতে সমান বিবেচনা করে আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকার (অনুচ্ছেদ-২৭), আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইনানুযায়ী এবং একমাত্র আইন অনুযায়ী ব্যবহার লাভের নিশ্চয়তা (অনুচ্ছেদ-৩১), আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে কাউকে বঞ্চিত না করার বিধান (অনুচ্ছেদ-৩২), রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রকৃতির ভিত্তিতে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা করণের প্রতিশ্রুতির (অনুচ্ছেদ-১১) আলোকে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করার দায় থেকে রেহাই দেয়ার বিধান প্রত্যাহার করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ঐকমত্য অর্জন ও পোষণ করতে অনুশাসন দিয়েছি। আমরা প্রশাসনের সকল ক্ষেত্রে অন্যায় ও অনৈতিকভাবে ৫ম সংশোধনীর মোড়কে দায়মুক্ত অপরাধীদের সম্পত্তি রক্ষণ, অর্জন ও সমাবেশ করার সুযোগ অস্বীকার বা সীমিত রাখা জনস্বার্থিক হবে বলে সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে যথা সিভিল সার্ভিস একাডেমি ও জনপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সুশীল প্রশাসকদের প্রশিক্ষণক্রমে মত প্রকাশ করেছি। আমাদের এই লক্ষ্যে বিশেষ সহায়তা ও সমর্থন দিয়েছিলেন সচিব মনজুরুল করিম, যুগ্মসচিব মনজুরে মাওলা, উপসচিব ফজলুল আহাদ, মুক্তাদির চৌধুরী, ইব্রাহিম হোসেন, সিরাজউদ্দীন ও অন্যরা। জিয়াউর রহমানের শাসনামলের স্বরাষ্ট্র সচিব সালাউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে যখন এই কথাটি আমি তুলেছিলাম তখন তিনি আমাদের অবস্থানের নৈতিকতা সমর্থন করে বলেছিলেন চেতনা সৃষ্টি ও প্রসারে এগিয়ে যাও। মনে রেখ কুকুরেরও হয়ত সুদিন বা সময় থাকে কিন্তু সময়ান্তরে কুকুরের সে দিন ফুরিয়ে যায়। সচিব মনজুরুল করিমের মাধ্যমে আমরা সুশীল প্রশাসনের এই অবস্থান প্রকারান্তরে তখনকার রাষ্ট্রপতি এরশাদকে জানিয়েছিলাম। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, সাংবিধানিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতার মর্যাদা দিয়ে তিনি তার হত্যার দায়মুক্তি প্রত্যাহার করার পদক্ষেপ নিবেন। তিনি তার সেই কথা রাখেননি বা রাখতে পারেননি। এই প্রসঙ্গে ১৯৯০-এর এখনও অজানা এক ঘটনার কথা উল্লেখ করা সমীচীন মনে হচ্ছে। সেই বছরের মাঝামাঝি এরশাদের পদত্যাগের দেশব্যাপী যে দাবি ছড়িয়ে গিয়েছিল তা দমন করার উদ্দেশ্যে তিনি জেলা প্রশাসকদের দিয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা অনুযায়ী বিক্ষোভকারীদের ওপর বল প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন। এই প্রেক্ষিতে তিনি প্রশাসন সার্ভিস সমিতির মহাসচিব হিসেবে আমার সমর্থন চেয়েছিলেন। আমি বলেছি যেÑ তার বিরুদ্ধে আন্দোলন স্থায়ীভাবে দমন করা সম্ভব হবে না। সাময়িকভাবে দমন করতে হলেও ন্যূনপক্ষে ৩০০০০ বিক্ষোভকারীর বল প্রয়োগে জীবননাশ হয়ে যাবে এবং এরূপ হত্যার দায় সুশীল প্রশাসনের নির্বাহীদের নিতে আমি বলতে পারব না। তিনি বলেছিলেন, এই লক্ষ্যে ম্যাজিস্ট্রেসি ও পুলিশের অনুকূলে তিনি ৫ম সংশোধনী বিস্তৃত করে দায়মুক্তি দিবেন। আমি বলেছিলাম এরূপ দায়মুক্তির প্রচ্ছায়ে এখনকার সুশীল প্রশাসনের নির্বাহীরা তার নির্দেশ মানবেন না। একই মত, আমার সঙ্গে কথা বলে প্রকারান্তরে তাকে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নুরউদ্দীন জানিয়েছিলেন। ফলত, তখন এরশাদ রাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে অনৈতিক, অযৌক্তিক অত্যাচার ও রক্তপাত থেকে জাতিকে রেহাই দিয়েছিলেন। পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বা সময়ে এরশাদ তার উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদের মতও জানতে চাননি। এরশাদ যখন পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন তখন মওদুদ ঢাকার অদূরে ভাড়াটে রাজনৈতিক কর্মীদের এক সমাবেশে দম্ভের সঙ্গে বলেছিলেন যেÑ রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের প্রশ্নই উঠতে পারে না। রাজনৈতিক আলোচনা কিংবা বিস্তৃত জনসমর্থন ব্যতীত দায়মুক্তির আইন প্রত্যাহার করা যাবে না বলে আমরা সুশীল প্রশাসনে কর্মরত প্রায় সকলে বুঝতে পেরেছি। আমাদের সঙ্গে একমত হয়ে একই কথা রাজনৈতিক মহলে বলেছেন আওয়ামী লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক। আমরা হতবাক হয়ে মনে রেখেছিলাম যেÑ ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তৎকালীন জাতীয় সংসদকে দিয়ে জিয়াউর রহমান সংবিধানের ৫ম সংশোধনী অনুমোদন করিয়ে কুখ্যাত দায়মুক্তির আইন সংবিধানের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করিয়েছিল। হতবাক ও লজ্জিত হয়ে লক্ষ্য করেছি যে, তখনকার জাতীয় সংসদ প্রায় বিনা বিতর্কে ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন দিয়ে এই সংশোধনী অনুমোদন করেছিল। ১৯৮১-এর ১৭ মে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা দেশবাসীর কাছে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার চেয়ে তখন থেকে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ভিত্তিতে দায়মুক্তির বিলোপন দাবি করে আসছিলেন। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জনসমর্থনের বলে জয়ী হয়ে ঐ বছরের ১২ নবেম্বর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংসদ এই কুখ্যাত দায়মুক্তি আইনটি বিলোপ করে। আর তার পরপরই বঙ্গবন্ধুর ১৫ জন হত্যাকারীর বিচার দেশের প্রচলিত সাধারণ আইনে শুরু হয়। এই প্রক্রিয়ায় স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এগিয়ে এসেছিলেন তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, প্রখ্যাত আইনজীবী মোহাম্মদ সিরাজুল হক ও তার সুযোগ্য পুত্র এ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আনিসুল হক (বর্তমান আইনমন্ত্রী)। তাদের সহযোগী হিসেবে অন্যদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ও মোশারফ হোসেন কাজল। মন্ত্রিপাড়ায় তৎকালীন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে আমার অনুকূলে বরাদ্দ লাল ইটের দোতলা বাংলোটি আমরা এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলার নথিপত্র প্রস্তুত, সাক্ষ্য উপস্থাপনের ক্রম ও উপস্থাপনীয় যুক্তির মোসাবিদা করার জন্য ব্যবহার করেছি। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় দিনের কাজ শেষ করে আমরা মিলিত হতাম এই বাংলোয় মামলার প্রস্তুতি ও কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত প্রাক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপক্ষের অবস্থান ও উপস্থাপন স্থির করতে। এই সকল আইনজীবী ও সাক্ষীর ওপর চোরাগোপ্তা হামলার আশঙ্কায় পুলিশ বিভাগ থেকে বিশেষ প্রহরার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল আমাকে। তেমনি বিচারককে বিশেষ নিরাপত্তা দিতে হয়েছিল মহানগরী পুলিশের মাধ্যমে। গর্বের সঙ্গে মনে রেখেছি, এই বিচারকার্য প্রভাবিত করার কোন চেষ্টাই করেননি আইনের শাসনের দৃঢ়তম সমর্থক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯৮-এর ৮ নবেম্বর বিচারিক আদালত উপস্থাপিত সাক্ষ্য ও দলিলাদি বিশ্লেষণ করে ১৫ আসামির মৃত্যুদ- দেয়া হয়। সেই সন্ধ্যায় সেই বাংলোয় উপস্থিত আমরা সকলে আমাদের জীবনের এক দুঃসহ কালো অধ্যায় শেষ হয়েছে বলে নিঃশব্দে উপলব্ধি করি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে রায়ের একটি অনুলিপি হাতে নিয়ে গণভবনে বেশ রাত্তিরে যখন পৌঁছি তখন অপলকভাবে চোখের পানি মুছে আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, বিচারের রায় তাহলে আমরা পেয়েছি, আপনার কাছে ওটাইত রায়ের অনুলিপি। শুনেছি, রায়ের অনুলিপিটি তার হাতে নিঃশব্দে তুলে দিয়েছি কিন্তু কিছু বলতে পারিনি সেই দুঃখিনি পিতৃমাতৃহারা অথচ সাহসে সমুজ্জ্বল আইনের শাসনে বিশ্বাসী জনগণের নেত্রীকে। দায়মুক্তি আইনের রেশ কিন্তু বিচারিক আদালতের রায় পাওয়ার পরপরই শেষ হয়নি। পরে বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদ-ে দ-িত ১৫ আসামির মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগ ১২ জনের দ- বহাল রেখে ৩ জনকে খালাস দেন। ২০০৮ সালে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ এই ১২ আসামির মৃত্যুদ- দৃঢ়কৃত করে। ২০১০ এর ২৭ জানুয়ারি এই ১২ জনের মধ্যে দেশে আটককৃত ৫ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়। কলঙ্কিত দায়মুক্তির যবনিকা এবং আইনানুগ দ-াদেশ কার্যকর করার পর আরও ৩টি পদক্ষেপ কলঙ্ক মোচনের পথে এই জাতির নেয়া সমীচীন হবে। এক. ৫ম সংশোধনী সংসদে অনুমোদনক্রমে যে সকল সংসদ সদস্য স্বৈরশাসনের পদভারে তাদের হ্যাঁ-বাচক ভোট দিয়েছিলেন তাদের শনাক্ত করে তাদের লজ্জাজনক ভূমিকা জাতির কাছে তুলে ধরতে হবে। জনপ্রতিনিধিত্বের পতাকা ধরে গণতান্ত্রিক সমাজে কোন দিন সংবিধান লংঘন হত্যাকরণ, জোর করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকরণের কোন ও ম্যান্ডেট বা অধিকার জনগণ তাদের প্রতিনিধিদের দিতে পারে না- এই সত্যটি সকলের হৃদয়ে গেথে রাখতে হবে। দুই. বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধীদের সকল সম্পদ ও সম্পত্তি বায়েজাফত করতে হবে। বাংলাদেশের স্থপতিকে সপরিবারে হত্যার জন্য যারা দোষী তারা বা তার উত্তরাধিকারীরা তার সৃজিত দেশের সীমানার মধ্যে অবস্থিত কোন সম্পত্তি বা সম্পদের মালিক বা দাবিদার হতে পারে না। তিন. এই নির্মম হত্যাকা-ের নেপথ্যে বা পরোক্ষে যারা ভূমিকা রেখেছিল বা সহায়তা করেছিল তাদেরকে একটি কমিশনের মাধ্যমে শনাক্ত করে হত্যার দায়ে বিচারের আওতায় আনতে হবে। দেশের প্রচলিত আইনে হত্যাকারীদের সহায়তা বা সমর্থন করা হত্যাসম অপরাধ- এই বিধানটি সংশ্লিষ্ট সকলকে স্মরণ করিয়ে রাখতে হবে। এই ৩টি পদক্ষেপ নিলে আর কোনদিন এই ধরনের কোন হিংসাত্মক কর্ম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জনগণকে কলঙ্কিত করতে পারবে না। লেখক : সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী
×